প্রতারকরা এত বেপরোয়া হয়ে উঠছে কেন?
ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী
প্রকাশ: ২৯ মার্চ ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
এটি প্রতিষ্ঠিত সত্য যে, কোনো রাষ্ট্রই দুর্নীতি ও প্রতারণামুক্ত নয়। তবে সাম্প্রতিককালে দেশবাসী প্রায় প্রতিদিনই এ ধরনের নানা ঘটনার তথ্য গণমাধ্যম সূত্রে অবগত হচ্ছেন। দেশব্যাপী নানা ধরনের জালিয়াতি, মিথ্যাচার, কদাচার, অরাজকতাসহ প্রতারণামূলক অপরাধ সর্বত্রই সংঘটিত হচ্ছে। জনগণ এতে ভীষণ বিভ্রান্ত ও আতঙ্কগ্রস্ত। সর্বনিু থেকে উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ব্যাংক-বীমা, পুঁজিবাজার, আবাসন প্রকল্প, সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে পদ-পদায়ন, ভর্তি-নিয়োগ-টেন্ডার বাণিজ্যসহ এমন কোনো কর্মকাণ্ড নেই, যেখানে অধিকাংশ মানুষ বা প্রতিষ্ঠান কোনো না কোনোভাবে প্রতারণা-জালিয়াতির শিকার হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে সর্বস্ব হারিয়ে প্রায় দেউলিয়ার সম্মুখীন হচ্ছে মানুষ। যদিও জনশ্রুতি ও বিভিন্ন আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক গণমাধ্যম সূত্র থেকে এসব প্রতারক-জালিয়াতচক্রের পৃষ্ঠপোষকদের পরিচয় তাদের নিজ নিজ অঞ্চলে কমবেশি সবারই জানা, তবু অদৃশ্য কারণে তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের বিষযটি যেন সুদূরপরাহত।
চিহ্নিত ব্যক্তিরা ছলচাতুরী, লবিং, তদবির ও অনৈতিক লেনদেনের মাধ্যমে এসব কদর্য কর্মকাণ্ড অব্যাহত রেখে দেশকে কোন পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছে, তা খতিয়ে দেখার বিষয়। অবৈধ পন্থায় উপার্জিত অর্থ, আরোপিত ক্ষমতা ও প্রতিপত্তির প্রভাবে এরা এত বেশি শক্তিশালী যে, সৎ-যোগ্য-দক্ষ-মেধাবী-দেশপ্রেমিক সাধারণ মানুষের পক্ষে এদের প্রতিরোধ করা একেবারেই অসম্ভব হয়ে পড়েছে। দুর্নীতি-ঘুস, অবৈধ লেনদেনের মাধ্যমে সংঘটিত জঘন্য অপরাধকর্মে জড়িতদের নেতৃত্বে রয়েছে অন্ধকারের পূজারি অর্থ ও ক্ষমতালিপ্সু দানবরূপী মাফিয়া চক্র। ‘ম্যানেজ’ অপসংস্কৃতির মাধ্যমে এদের আগ্রাসী তৎপরতা সরকারের বিভিন্ন অভিযানে কিছুটা স্তিমিত হলেও স্বল্প সময়ের মধ্যে আবার তাদের এত বেশি অদম্য শক্তিতে সক্রিয় হয়ে ওঠার কারণ বিশ্লেষণ জরুরি।
বিজ্ঞজনদের মতে, দেশে প্রতারণামূলক অপরাধ ক্রমেই বাড়ছে। আমাদের সমাজে সুদূর অতীতকাল থেকে প্রতারণামূলক অপরাধ বিরাজ করলেও নতুন নতুন কৌশলের আবির্ভাবে এ ধরনের অপরাধ নতুন মাত্রা পেয়েছে। ডিজিটাল প্রযুক্তির বদৌলতে এর মাত্রা বেড়েছে আরও বহুগুণ। আগে প্রতারকচক্র মানুষের অসচেতনতার সুযোগে তাদের আস্থা অর্জন করে প্রতারণার মাধ্যমে টাকা হাতিয়ে নিলেও তা ছিল সামান্য বা কিছু পণ্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ। এ ধরনের অপরাধের শিকার হতো একটি নির্দিষ্ট শ্রেণি-পেশার মানুষ। মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতা এবং চাওয়া-পাওয়ার স্বল্পতার কারণে সহজে কোনো কিছু অর্জন করা থেকে তারা নিজেদের দূরে রাখত। কিন্তু অর্থনৈতিক গতি-প্রকৃতি এবং অর্থের প্রবাহ বৃদ্ধি মানুষের জীবনযাত্রায় ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করছে। বর্তমানে মানুষের নিত্যপ্রয়োজন বহির্ভূত চাহিদা তথা উচ্চাভিলাষী চিন্তা-চেতনা পরিলক্ষিত হচ্ছে। এর সুযোগ নিয়ে প্রতারকচক্র আমাদের সর্বস্ব কেড়ে নিচ্ছে, আবার অনেকে অল্পে রক্ষা পাচ্ছে।
সাম্প্রতিককালে দেশব্যাপী ডিজিটাল, অ্যানালগসহ নানা প্রতারণার বেড়াজালে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে অনেকের জীবনে বিপর্যয় নেমে আসছে। প্রতারণার বহুমাত্রিকতায় সব স্থানে নিরাপদে থাকা দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফেসবুক, ইউটিউবসহ ডিজিটাল দুনিয়ার বৃহৎ অংশজুড়েই ওত পেতে আছে বিভিন্ন প্রতারণার ফাঁদ। ডিজিটাল প্রতারণার পর্বতসম অভিযোগ রয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে। দেশে ডিজিটাল প্রতারণার ঘটনাগুলোর বেশিরভাগই মোবাইলে অর্থ লেনদেনের প্লাটফর্মকেন্দ্রিক। বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতারণার সংবাদ পর্যালোচনায় দেখা যায়, প্রতারকদের নিত্যনতুন কৌশল অবলম্বনের কারণে প্রতিনিয়ত শিক্ষিত-অশিক্ষত অনেকেই কুপোকাত হচ্ছেন। সাধারণ মানুষের পাশাপাশি ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার চাকরিজীবীরাও এদের কদর্য প্রতারণার শিকার। ভুক্তভোগীরা প্রতারণায় সর্বস্বান্ত হয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শরণাপন্ন হলে প্রতারণার ভয়ংকর কৌশলগুলো কদাচিৎ জনসম্মুখে উন্মোচিত হয়।
ব্যাংক খাতে অনলাইনের প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে জালিয়াতি ও প্রতারণাও বাড়ছে। বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে দেওয়ার কথা বলে মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করার দৃষ্টান্তও নেহায়েত কম নয়। গণমাধ্যমে প্রকাশিত বাংলাদেশ ব্যাংকের বিজ্ঞপ্তি মারফত জানা যায়, অবৈধভাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের মনোগ্রাম-লোগো ব্যবহার করে বিভিন্ন মোবাইল অ্যাপ্লিকেশনে সহজ শর্তে ঋণ, রি-পেমেন্ট, ইন্টারেস্ট রেট ইত্যাদি বিষয়ে বিনিয়োগ ও মানুফাকেন্দ্রিক বিজ্ঞাপন প্রচার করা হচ্ছে। এসব প্রতারকের ফাঁদে পড়ে মানুষের মোটা অঙ্কের টাকা খোয়ানোর শঙ্কা থাকায় এ বিষয়ে বিভ্রান্ত না হয়ে সতর্ক থাকার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে বিকাশ, নগদ ও রকেটের মতো মোবাইল ব্যাংকিং সংশ্লিষ্টরা নানাভাবে প্রতারণার শিকার হয়েছেন বলে গণমাধ্যমে অভিযোগ প্রকাশ পেয়েছে।
২০২৩ সালের জুলাই মাসে জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্য ফাঁস হওয়ার পর থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম টেলিগ্রামে জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্য বিক্রি এবং এসব তথ্য দিয়ে ব্যাংকের কার্ড ও মোবাইল ব্যাংকিং সেবার নামে নানা প্রতারণামূলক ব্যবসার অভিযোগ রয়েছে। ভুয়া তথ্যের এসব ব্যবসার প্রসার ঘটাতে সক্রিয় রয়েছে তথ্যপ্রযুক্তিতে দক্ষ শক্তিশালী একটি অসাধু চক্র। তথ্য বিক্রি বাড়াতে দেশের প্রতিষ্ঠিত মোবাইল ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান এবং কয়েকটি ব্যাংকের নামও ব্যবহার করে কৌশলে গ্রাহকদের ধোঁকা দেওয়ার এ ব্যবসা চালাচ্ছে দুর্বৃত্তরা। তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের মতে, যেহেতু জাতীয় পরিচয়পত্রের ডেটাবেজ থেকে তথ্য বেরিয়ে যাওয়ার ঘটনা এর আগে ঘটেছে, তাই এমনিতেই মানুষ এ নিয়ে অস্বস্তিতে আছে; এখন তাদের বিভ্রান্ত করাটা আগের চেয়ে সহজ। ফলে সত্য-মিথ্যা নানারকম কথা বলে সুযোগসন্ধানী কেউ কেউ ব্যবসা করে থাকতে পারে। এ ধরনের তথ্য যারা অনলাইনে বিভিন্ন মাধ্যমে বিক্রি করছে এবং প্রলোভনে পড়ে যারা কিনছে, উভয়েই সমান অপরাধী। বিশেষ করে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮ এবং ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষা আইনের খসড়া উভয় ক্ষেত্রেই জেল-জরিমানার বিধান রয়েছে। কাজেই যারা এমন ঘটনার সঙ্গে জড়িত তারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারিতে এলে শাস্তির সম্মুখীন হবে। এর চেয়ে বড় বিষয় হলো, এমন তথ্য কিনে কখনোই টাকা পাওয়ার কোনো সুযোগ বাংলাদেশে নেই।
গত ২৩ মার্চ গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, অনলাইনে রেলের টিকিট বিক্রির দায়িত্বে থাকা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সহজ ডটকম, রেলওয়ের অসাধু কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী, রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনী এবং ট্রেনে খাবার সরবরাহের ক্যাটারিং কর্মীদের যোগসাজশে গড়ে ওঠা সিন্ডিকেট অভিনব প্রতারণায় টিকিট জালিয়াতি করে হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা। নিবন্ধনে জাতীয় পরিচয়পত্রের বাধ্যতামূলক ব্যবহার, টিকিট ব্যবস্থাপনার আধুনিকায়ন, কালোবাজারি প্রতিরোধ, বিনা টিকিটে ভ্রমণে জরিমানা এবং ভাড়া আদায় সহজকরণে অনলাইন প্লাটফর্ম থেকে শতভাগ টিকিট বিক্রি চালু করার পর কালোবাজারি কমার আশাবাদ ব্যক্ত করা হলেও নতুন পদ্ধতিতে টিকিট সংগ্রহ করে যাত্রীদের কাছে তা চড়াদামে বিক্রি অব্যাহত আছে। টিকিট কালোবাজারির পাশাপাশি পাওয়া যায় জাল টিকিট বিক্রির প্রমাণ। ভুক্তভোগী যাত্রীদের অভিযোগ-ঈদ কিংবা বিভিন্ন উৎসবে অনলাইনে টিকিট বিক্রি শুরুর ২০ থেকে ৩০ মিনিট পর্যন্ত বা তারও বেশি সময় ধরে সার্ভারে ঢোকা যায় না। আবার সার্ভারে ঢোকার পর দেখা যায় সব টিকিট বিক্রি শেষ। এক্ষেত্রে টিকিট বিক্রির সার্ভারটি ইচ্ছা করেই ডাউন করে রাখা হয়। এছাড়াও সিন্ডিকেটের সদস্যরা বিভিন্ন গন্তব্যের টিকিট সংগ্রহ করে পরে তা স্টেশনে, ফেসবুকসহ নানা মাধ্যমে যাত্রীদের কাছে বেশি দামে বিক্রি করে।
দুর্নীতি-জালিয়াতি-প্রতারণা সমাজের এত বেশি গভীরে প্রোথিত হয়েছে যে, তা সমূলে উৎপাটন করা না গেলে জাতির সব উন্নয়ন-অর্জন বিফলে যাওয়ার সমূহ আশঙ্কা রয়েছে। প্রতারণা ও জালিয়াতি প্রতিরোধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হলে অচিরেই দেশ বহুমুখী চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবে। কাজেই যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ এবং সৎ ও যোগ্য ব্যক্তিদের মাধ্যমে অপরাধীদের বিচারিক আদালতে শাস্তির ব্যবস্থা দৃশ্যমান করতে হবে। দেশের স্বাধীনতাকে অর্থবহ করতে হলে সমাজ থেকে সব অপশক্তির তৎপরতা বন্ধ করতে হবে।
ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী : শিক্ষাবিদ; সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়