মশার চোখ রাঙানিতে বিপর্যস্ত নগরজীবন

ড. মো. গোলাম ছারোয়ার
প্রকাশ: ২১ মার্চ ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের একটি ব্যঙ্গ কবিতার লাইন : ‘রেতে মশা দিনে মাছি, এই নিয়ে কলকেতায় আছি’। এখন কবিতার এ লাইনটির ছান্দিক পরির্বতন করে বলা যায় : ‘রাতে কিউলেক্রা, দিনে এডিস, এই হলো নগরাবেশ’। গত ২২ বছরের সব রেকর্ড ভেঙে এডিসের ভয়াল আক্রমণে ডেঙ্গুতে ২০২৩ সালে সর্বোচ্চসংখ্যক আক্রান্ত রোগী (৩ লাখ ২১ হাজার) এবং মৃত্যুর সংখ্যা (১ হাজার ৭০৫) ও হার (০.৫ শতাংশ) দুটোই জানান দিয়েছিল এডিসের তাণ্ডবলীলা। এবারও, এই ২০২৪ সালে, এডিস মশার সেই তাণ্ডবলীলা বহাল রয়েছে। আজ যখন এই লেখা লিখছি, ১৬ মার্র্চ, এই দিনে মোট আক্রান্তের সংখা ১ হাজার ৫৩৭ এবং মৃত্যুর সংখ্যা ২০। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা ২০২৩ সালের এ সময়ের তুলনায় ২০২৪ সালের এ পর্যন্ত প্রায় দ্বিগুণ। তাহলে এখন বুঝতেই পারছেন ভয়াবহতা কতটা আতঙ্ক জাগাচ্ছে। ডেঙ্গুর এই ভয়াবহতা রোধে এ পর্যন্ত গৃহীত পদক্ষেপগুলোর কার্যকারিতা মুল্যায়ণ ও তদারকির কত বেশি প্রয়োজন, তা সহজেই অনুমেয়।
ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশার প্রজননস্থল চিহ্নিত করা এবং এর ধ্বংস নিশ্চিত করার সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োগকৃত লার্ভিসাইড ও এডালটিসাইডের কার্যকারিতা, প্রয়োগ পদ্ধতি, ব্যবহৃত মেশিনের কর্মদক্ষতা, প্রয়োগকারীর প্রশিক্ষণের প্রায়গিক দক্ষতা, সর্বোপরি এডিস মশার প্রতিরোধী হয়ে ওঠার তীব্রতা-এ সবকিছুই যদি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি আর বিশেষজ্ঞদের তদারকিতে না হয়, তাহলে সময় যত গড়াবে এর ভয়াবহতা আর চোখরাঙানি ততই বৃদ্ধি পাবে।
বাদশাহ নমরুদের ইতিহাস আমরা সবাই জানি। একটি পা-বিহীন ল্যাংড়া মশা বিশাল প্রতাপশালী এক বাদশাহকে ধরাশায়ী করেছিল। তার শেষ পরিণতি মৃত্যুতে শেষ করে, অতি স্বচ্ছন্দে মশা উড়ে গিয়েছিল। ওই মশাটি কোন প্রজাতির ছিল তা অতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল না; কারণ মশাটি এখানে কোনো অনুজীবের বাহক হিসাবে কাজ করেনি। কাজ করছে অস্বস্তি আর বিরক্তিকর এক কীট হিসাবে। মশাটি যদি কোনো বাহক হিসাবে কাজ করতো, তাহলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হতো।
এডিসের এ ভয়াবহতার পাশাপাশি সন্ধ্যা থেকে সারা রাত পর্যন্ত যে পতঙ্গটি চরম বিরক্তি আর রক্ত শোষণ করে আমাদের নাজেহাল করে চলেছে, সেটি হলো কিউলেক্রা প্রজাতির মশা। এ মশা যে শুধু গুনগুন করে আমাদের নিদ্রাভঙ্গ করে তাই নয়, বরং ফাইলেরিয়া, ইনক্যাপালাইটিস (জাপানিজ ও সেন্টলুইস) ওয়েস্টনিল ভাইরাস ইতক্যাদির মতো মারাত্মক রোগ ছড়ায়। এ প্রজাতির মশা আমাদের দেশে অত্যাধিক। কৃষক ও খামারিরা গরুকে এ মশার দংশন থেকে রক্ষা করার জন্য মশারি ও ক্ষেত্রবিশেষে ছালার চট ব্যবহার করেন। গো-মুত্র যে স্থানে জমা হয় সে স্থানটি এ মশার উর্বর প্রজনন স্থল। একইভাবে দূষিত পানি, জমে থাকা পানি, ডোবা-নালা, শহরের পরিত্যক্ত ম্যানহোলসহ অপরিচ্ছন্ন স্থানে জমা পানি এ মশার প্রজনন উৎস। এ মশা এডিস মশার মতো কোনো শীত, গ্রীষ্মের তোয়াক্কা করে না। সারা বছরই প্রজনন চালিয়ে যায়। ঢাকা শহরের যেসব অপরিচ্ছন্ন লেক, নালা ও জমানো পানি রয়েছে, সে স্থানগুলোতে সন্ধ্যার সময় এ মশার বিশাল বিশাল দল যে কোনো মনুষ্যজাতির চারদিকে কম্বো স্টাইলে আক্রমণ করে ভয়ংকরভাবে, রক্ত শোষণ করে রোগজীবাণু শরীরে প্রবেশ করিয়ে দেয় এবং চরম বিরক্তি সৃষ্টি করে। এ মশার প্যানপ্যানানিতে অসহ্য হয়ে পড়েছে নগরজীবন। বিশেষ করে ঢাকা শহরের যে এলাকাগুলোয় এরা বিস্তৃতি লাভ করছে, সে এলাকাগুলোয় তাদের দাপট চরমে পৌঁছেছে।
নগরজীবনের অনেক সমস্যার মধ্যে এ মশার সমস্যাটি অন্যতম। এখন প্রশ্ন হলো, এ ভয়ংকর সমস্যা সৃষ্টিকারী কিউলেক্রা ও এডিস মশার উপদ্রব থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায় কী? এডিস মশার ভয়াবহতা সংখ্যাধিক্যের কিউলেক্রার তুলনায় অনেক ভয়ংকর। এডিস মশা নিধনের কর্মকাণ্ডে নগরের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা গলদঘর্ম হয়ে চলেছেন। কিন্তু বিশাল শত্রু বাহিনী কিউলেক্রার জন্য নেই তেমন কোনো সুব্যবস্থা। মশাবাহিত রোগকে বলা হয় নেগলেকটেউ ট্রপিক্যাল ডিজিজ। অর্থাৎ এ রোগগুলো সুবিধাবাঞ্চিত মানুষের রোগ, বিশেষ করে মানসম্মত বাসস্থানে যাদের বসবাস করার সামর্থ্য নেই, তাদের রোগ। কিন্তু বাংলাদেশে যাদের মানসম্মত বাসস্থান বা বিলাসবহুল অট্টালিকায় যাদের বসবাস, সমাজের সেইসব বিত্তবান ব্যক্তির বাসস্থানের পাশেও সাংঘাতিক বিরক্তির ও ক্ষতিকর মশার আবাস্থল রয়েছে। ধানমন্ডি, গুলশান, উত্তরা ইত্যাদি আবাসিক এলাকায় প্রচুর কিউলেক্রা মশার উৎপাত রয়েছে।
এ কিউলেক্রার কবল থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য সর্বপ্রথম যে ব্যবস্থাটি প্রয়োজন তা হলো, অপরিষ্কার জলাশয় পরিপূর্ণ সংস্কারের মাধ্যমে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা। নাগরিক সচেতনতা ও সম্পৃক্ততা পূর্ণ নিশ্চিতকরণ। জনগণকে শুধু সচেতন হলেই হবে না, এ কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত থাকতে হবে। শুধু একবার পরিষ্কার করলেই চলবে না, নিয়মিত তদারকি এবং প্রয়োজনীয় কীটনাশক সহনীয় মাত্রায় প্রয়োগের মাধ্যমে মশার প্রজনন স্থল ধংস করতে হবে। লেক ও বিনোদন পার্কের ক্ষেত্রে নাগরিক সচেতনতা আরও বেশি প্রয়োজন। কারণ এ স্থানগুলোতে বিভিন্ন ধরনের ক্যান ও প্লাস্টিকের সামগ্রী ফেলার কারণে এডিস মশার প্রজনন বৃদ্ধি পেয়েই চলেছে। দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি ও জনপ্রতিনিধিদের পূর্ণ সম্পৃক্ততার মাধ্যমে এ মশার অত্যাচার ও অস্বস্তি থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব।
ড. মো. গোলাম ছারোয়ার : অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, কীটতত্ত্ব বিভাগ, জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান (নিপসম)