ভোজ্যতেল নিরাপত্তায় পাম অয়েলে থাকুক সতর্ক দৃষ্টি
হাসান মামুন
প্রকাশ: ১৯ মার্চ ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
রমজানের এ সময়টায় চাহিদা অনেক বেড়ে যায়-এমন যেসব খাদ্যপণ্য বা খাদ্য উপকরণের দাম কমানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, তাতে অবধারিতভাবে ছিল ভোজ্যতেল। এর মধ্যে অবশ্য কেবল সয়াবিন তেলের দাম লিটারপ্রতি ১০ টাকা কমাতে সফল হয় সরকার। আমরা কিন্তু পাম অয়েলও বিপুল পরিমাণে পরিভোগ করে থাকি। আর দুটোই হয়ে আসছে আমদানি; তবে পাম অয়েল তুলনামূলক বেশি।
নিজ নিজ পরিবারে সয়াবিনের ব্যবহার এত বেশি যে, তাতে অবশ্য ভেবে ওঠা কঠিন যে দেশে পাম অয়েলের পরিভোগই বেশি। এর বিপুল ব্যবহার রয়েছে রেস্তোরাঁসহ খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ, এমনকি কসমেটিকস শিল্পে। আমরা সবাই পাম অয়েল ব্যবহারকারী খাতগুলোয় উৎপাদিত পণ্যসামগ্রী কিনে এর পরোক্ষ পরিভোগেও যোগ দিচ্ছি। সেজন্য সয়াবিনের সঙ্গে পাম অয়েলের দামও কমে এলে সেটা ভোক্তার জন্য ভালো। কিন্তু সয়াবিনের দাম কমানোর উদ্যোগ থাকলেও পাম অয়েল বিষয়ে কিছু বলা হয়নি।
রোজার আগ দিয়ে, পয়লা মার্চ থেকে বোতলজাত সয়াবিন তেলের সঙ্গে খোলা সয়াবিনের দামও কমানো হয়েছে লিটারপ্রতি ১০ টাকা। এ অবস্থায় সারা দেশে তুলনামূলকভাবে বেশি ব্যবহৃত পাম অয়েলের দামটা সম্ভবত রেখে দেওয়া হয়েছে বাজারশক্তির ওপর।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন (বিটিটিসি) সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বসে উৎপাদন ব্যয়, অন্যান্য খরচ, মুনাফা ইত্যাদি হিসাব করে যেসব পণ্যের দাম স্থির করে আসছে, তাতে বরাবরই আছে ভোজ্যতেল। এর চাহিদার প্রায় ৯০ শতাংশই আমদানিকৃত বলে এক্ষেত্রে আমদানি ব্যয় হিসাব করা হয় গুরুত্বের সঙ্গে। বিশ্ববাজারে ভোজ্যতেলের দাম মাঝে অনেক বেড়ে গিয়েছিল। দেশে এর দাম, বিশেষত সয়াবিনের দাম লিটারপ্রতি ২০০ টাকা হয়ে যাওয়ার ঘটনাও ঘটে। সে পরিস্থিতি অবশ্য আর নেই। বিশ্ববাজারে ভোজ্যতেলের দাম কমে প্রায় অর্ধেক হয়ে গেলেও দেশে সে অনুপাতে কমেনি, এটাও সত্য। এর মূল কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, একই সময়ে ডলারের দাম বিপুলভাবে বাড়ার কথা। এটা কেন ঘটলো, তা ভিন্ন আলোচনার বিষয়।
তবে ঘটেছে বৈকি। দাম বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ডলার দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠেছে আর তাতে আমদানি ব্যয় শুধু বাড়েনি; অনেক ক্ষেত্রে এলসি খোলায় সৃষ্টি হয়েছে জটিলতা। এতে ভোজ্যতেলের মতো নিত্যপণ্যের বাজারও হয়ে উঠেছে অস্থিতিশীল। এমন একটা বাজারে দাম কমিয়ে আনার পদক্ষেপও দ্রুত সুফল দেয় না। এ অবস্থায় সয়াবিন ও পাম অয়েল দুটোর দামই যথেষ্ট ভুগিয়েছে ভোক্তাকে। ঘরে ঘরে রান্নাবান্নায় খরচ যেমন বেড়েছে; তেমনি বেড়ে গেছে বেকারি ও রেস্তোরাঁয় খাবারের দাম। সয়াবিনের দাম অপেক্ষাকৃত বেশি থাকায় নিম্ন আয়ভুক্ত পরিবারে পাম অয়েলের ব্যবহার যে এর মধ্যে বাড়েনি, তাও বলা যাবে না। দামের উল্লেখযোগ্য পার্থক্যের কারণে খোলা সয়াবিনের ব্যবহারও কিন্তু বেশি। আর পাম অয়েলের প্রায় পুরোটাই খোলা অবস্থায় বিক্রি হয়ে থাকে। আমরা জানি, রমজানে ভোজ্যতেলের চাহিদা হয়ে যায় প্রায় দ্বিগুণ। তার মানে, পাম অয়েলের চাহিদাও বাড়ে তখন। দেশজুড়ে ইফতার সামগ্রী তৈরিতে এর চাহিদা অধিক হারে বাড়ে। এ অবস্থায় সয়াবিনের পাশাপাশি পাম অয়েলেরও দাম কমানোর উদ্যোগ কেন পরিলক্ষিত হলো না, বোধগম্য নয়।
পাম অয়েলের দাম যে কখনো ঠিক করে দেওয়া হয়নি, তা নয়। গেল বছরের জুনেই সয়াবিনের সঙ্গে পাম অয়েলের দাম কমানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল একই প্রক্রিয়ায়। এর আগের বছর চিনির সঙ্গে কমানো হয় পাম অয়েলের দাম। তা কার্যকর করা নিয়ে কিছু সমস্যাও মোকাবিলা করতে হয়, যেটা আমাদের বাজার ব্যবস্থাপনায় রয়েই গেছে। এবারও মার্চের শুরুতে মিলছিলো নতুন দামে সয়াবিন তেল পাওয়া না যাওয়ার খবর।
এর গতানুগতিক কিছু কারণও বর্ণনা করছিলেন ব্যবসায়ী প্রতিনিধিরা। রোজা শুরু হতে হতে সয়াবিন তেলের নতুন দাম কার্যকর হয়েছে, এটা অবশ্য কিছুটা স্বস্তির। তাতে খোলা পাম অয়েলের সঙ্গে বিশেষ করে খোলা সয়াবিনের দামের তফাৎ কমে আসবে। এতে পাম অয়েলের চাহিদা কিছুটা কমবে কি? বিপুল ব্যবহারের ক্ষেত্রগুলোয় দামের সামান্য পার্থক্যও কিন্তু ‘ম্যাটার’ করে। তাছাড়া কিছু ক্ষেত্রে বিশেষ ধরনের উপকরণ ব্যবহার অনেকটা বাধ্যতামূলক। খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ ও কসমেটিকস শিল্পে পাম অয়েল গুরুত্বপূর্ণ উপাদান বৈকি। এ কারণে পাম অয়েলের সরবরাহ স্বাভাবিক রাখাটাও জরুরি বলে বিবেচিত। এ অবস্থায় যেসব দেশ থেকে এর আমদানি হয়ে থাকে, সেখানে পাম অয়েল উৎপাদন পরিস্থিতির দিকে রাখতে হয় সতর্ক দৃষ্টি। বিশ্বের প্রায় ৮৫ শতাংশ পাম অয়েল উৎপাদন হচ্ছে ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ায়। আমরাও মূলত এ দুই দেশ থেকেই এটা আমদানি করে থাকি। এক দেশ থেকে কঠিন হলে অন্য দেশ থেকে আমদানি বাড়াই। তখন বেশি দামও গুনতে হয়।
কথা হলো, সরকার ভোজ্যতেলের শুল্কে যেটুকু ছাড় দিয়েছে, সেটা তো পাম অয়েল আমদানিতেও প্রযোজ্য। এ কারণে ‘অন্যান্য অবস্থা অপরিবর্তিত থাকলে’ পাম অয়েলের আমদানি ব্যয়ও কিছুটা কমার কথা। সয়াবিনের সঙ্গে দাম কমানো না হলেও আমদানি ব্যয় কমে আসায় পাম অয়েলের দামও কিছুটা কমবে। সে কারণেই কি এর দাম কমাতে গা করেনি সরকার? বছরের শুরুতে সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরে দেখা যাচ্ছিল, সয়াবিন আমদানি উল্লেখযোগ্যভাবে কমে এলেও পাম অয়েল আমদানি না কমে বরং কিছুটা বেড়েছে। পরে পরিস্থিতিটা বদলেছে নিশ্চয়। এ মুহূর্তে বাজারে কোনো ভোজ্যতেলেরই ঘাটতি আছে বলে মনে হয় না। বিশ্ববাজারে বিশেষত সয়াবিন তেলের সরবরাহ বা দাম নিয়ে কোনো সমস্যার কথা শোনা যাচ্ছে না।
তবে পাম অয়েল উৎপাদক দেশগুলো থেকে কিছু নেতিবাচক খবর মিলছে। আছে পুরোনো পাম বাগানে উৎপাদন কমে আসার খবর; সঙ্গে জানা যাচ্ছে বিরূপ আবহাওয়ার প্রভাবের কথা। এ অবস্থায় পাম অয়েলের বৈশ্বিক চাহিদা বেড়ে গেলে আলাদা করে এর দাম বাড়বে বলে প্রক্ষেপণ রয়েছে। ভারতসহ পাম অয়েলের বড় আমদানিকারক দেশগুলোয় একযোগে চাহিদা বাড়লে কী হবে? তাছাড়া প্রধান দুই উৎপাদক দেশেই পাম অয়েল থেকে বায়ো ডিজেলের উৎপাদন বৃদ্ধির খবর রয়েছে। প্রচলিত জ্বালানি, যেমন ডিজেলের সঙ্গে বায়ো ডিজেলের ব্যবহার বাড়াচ্ছে তারা নিজেরাই। নিচ্ছে জ্বালানি ব্যবহারসংক্রান্ত নতুন নীতিমালা। গতানুগতিক জ্বালানির ওপর নির্ভরতা কমানো এবং এর আমদানিতে মূল্যবান বিদেশি মুদ্রার ব্যবহার হ্রাসের চেষ্টা তাদের থাকতেই পারে। এ অবস্থায় আমাদের মতো পাম অয়েলনির্ভর দেশ নতুন করে বিপদে পড়তে পারে, এমনকি সয়াবিনের দাম উল্লেখযোগ্যভাবে কমে আসার সময়টায়। বলা যায় না, পাম অয়েল ও সয়াবিন তেলের দাম সমান হয়ে যেতে পারে। আমদানির উৎস দু-তিনটি দেশে সীমিত আর বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে পাম অয়েলের আলাদা চাহিদা রয়েছে বলে এর দাম সয়াবিনকেও ছাড়িয়ে গেলে অবাক হওয়া যাবে কি?
আমরা প্রায় ৯০ শতাংশ চাহিদাই মেটাই আমদানিকৃত সয়াবিন ও পাম অয়েল দিয়ে। সরিষাসহ বাকি যেটুকু ভোজ্যতেল নিজেরা উৎপাদন করি, তার পরিমাণ ‘দ্রুত বাড়ানো’র একটি পরিকল্পনা অবশ্য নেওয়া হয়েছে। কিছু সয়াবিন বীজও আমরা উৎপাদন করছি। এতে কিছু বৃদ্ধির খবরও আছে।
তবে অধিক গতিতে বাড়ছে সরিষার ফলন। আমন ও বোরো ফসলের মধ্যভাগে সরিষার আবাদ বৃদ্ধির চেষ্টা রয়েছে চাষিদের মধ্যেও। সরকারি কিছু সহায়তাও পাচ্ছে তারা। সরিষা বীজ এবং সঙ্গে এর মধুর ভালো দাম মিলছে বলেও প্রক্রিয়াটি হচ্ছে ত্বরান্বিত। তবে বিশ্ববাজারে সংকট ঘনিয়ে ওঠার সঙ্গে দেশে এর ফলন দ্রুত বাড়বে বলে মনে হয় না। তাছাড়া বিশেষ গন্ধযুক্ত ও অধিক দামের সরিষার তেল এরই মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে ওঠা সয়াবিনকে কতটা প্রতিস্থাপন করতে পারবে, সে প্রশ্ন রয়েছে।
বেশি সম্ভাবনা বরং ছিল রাইস ব্রান অয়েলের। ধান-চাল উৎপাদনে সফল এদেশে যথেষ্ট পরিমাণ রাইস ব্রান বা চালের কুঁড়া মিলছে দেখে এক পর্যায়ে তা থেকে ভোজ্যতেল উৎপাদনও শুরু হয়েছিল। ভোজ্যতেল চাহিদার অন্তত এক-তৃতীয়াংশ আমরা চালের কুঁড়া থেকেই পেতে পারি বলে জানিয়েছিল খোদ সরকারি সংস্থা। বাস্তবে এ জায়গাটায় কিছু অগ্রগতি হয়েও তা আবার পিছিয়ে গেছে। ভোজ্যতেল ঘিরে চরম ভোগান্তি চলাকালেও রাইস ব্রান অয়েল নিয়ে আলাপ তেমন হয়নি। এর অধিক দামের প্রশ্ন অবশ্য রয়েছে। স্বাস্থ্যগত দিক থেকে এর সবিশেষ গ্রহণযোগ্যতাও কিন্তু কম আলোচিত হয়নি।
চালকলে উৎপাদিত কুঁড়ার সিংহভাগ এখন আবার ভারতে চলে যাচ্ছে বলে খবর রয়েছে। আমরা তো রপ্তানির জন্যও রাইস ব্রান অয়েলের উৎপাদন বাড়াতে পারতাম-যেহেতু স্বাস্থ্যকর ভোজ্যতেল হিসাবে এর ভালো চাহিদা রয়েছে। তা থেকে অর্জিত ডলার না হয় ব্যয় করতাম প্রচলিত ভোজ্যতেল আমদানিতে। দামের বিষয় বিবেচ্য অবশ্য। প্রাপ্যতার দিকটিও গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্ব বাণিজ্যে এমনও হয়ে থাকে-অধিক দাম দিয়েও কখনো কখনো বিশেষ একটি পণ্য আনা যায় না। পাম অয়েলের ক্ষেত্রে এমন একটা পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে কিনা, কে জানে! সয়াবিন আমদানির তুলনায় বিকল্প উৎস খুব কম বলেই এটা নিয়ে দুশ্চিন্তাও বেশি।
হাসান মামুন : সাংবাদিক, বিশ্লেষক