Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

বাইফোকাল লেন্স

সরষের ভেতরের ভূতগুলোই যত নষ্টের গোড়া

Icon

একেএম শামসুদ্দিন

প্রকাশ: ১১ মার্চ ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

সরষের ভেতরের ভূতগুলোই যত নষ্টের গোড়া

বেইলি রোডের আটতলা গ্রিন কোজি কটেজে ভয়ংকর অগ্নিকাণ্ডের পর সংশ্লিষ্ট মহলের দৌড়ঝাঁপ দেখে মনে হচ্ছে, এই বুঝি ঘনঘন আগুন লাগার ঘটনা নিয়ন্ত্রণের পথ খুঁজে পাওয়া গেল। কিন্তু নাহ্, ‘যাহা লাউ তাহাই কদু!’ অবস্থাদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, ঘটনার পর সরকার সেই পুরোনো পথেই হাঁটছে। সাঁড়াশি অভিযানের নামে এখন যা হচ্ছে, তা লোকদেখানো ছাড়া কিছু নয়। সরকারের এমন তোড়জোড়, আগের প্রতিটি ঘটনার পরও দেখা গেছে। নিমতলী থেকে বেইলি রোড; প্রতিটি ঘটনায় যেসব সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান দায় এড়াতে পারে না, তাদের দিয়েই সরকার এসব অভিযান চালিয়েছে। ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে। পেটের দায়ে চাকরি করা রেস্তোরাঁর ম্যানেজার ও কর্মচারীদের গ্রেফতার করে নিজেদের দায় এড়ানোর চেষ্টা করছে সরকারের এসব সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিরা! ঘটনার পর থেকে সংশ্লিষ্ট সংস্থার এরূপ কার্যকলাপ নিয়ে বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলো ধারাবাহিকভাবে সংবাদ প্রতিবেদন প্রকাশ করে যাচ্ছে। সরকারের যেসব প্রতিষ্ঠানের অবহেলা ও দায়িত্বহীনতা এসব ঘটনার জন্য দায়ী, তাদের বিষয়ে উদাসীন থেকে অপেক্ষাকৃত দুর্বলদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে কাজের কাজ কিছুই হবে না। অর্থাৎ সমস্যার মূলে না গিয়ে এসব ধরাধরি করে কোনো লাভ হবে না।

নিমতলী থেকে চুড়িহাট্টা, বনানীর এফআর টাওয়ার থেকে বঙ্গবাজার গড়িয়ে বেইলি রোড, এক যুগে একের পর এক অগ্নিকাণ্ডে যে এতগুলো মানুষের মৃত্যু হলো, এত সম্পদের ক্ষতি হলো, এর দায় কে নেবে? এ যাবত যতগুলো ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে, এর সব ক্ষেত্রেই গাফিলতির যে চিত্র বেরিয়ে এসেছে, তাতে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো কোনোভাবেই তাদের দায় এড়াতে পারে না। একটি ভবনের নির্মাণকাজ শুরুর আগ থেকে সম্পন্ন হওয়া পর্যন্ত এবং ভবনের কার্যক্রম চলা অবধি সরকারের কয়েকটি সংস্থা যুক্ত থাকে। এসব সংস্থা হলো: রাজউক, পরিবেশ অধিদপ্তর, সিটি করপোরেশন, বাণিজ্য ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। কাজেই এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় ভবন ও দোকান মালিক থেকে শুরু করে সরকারের এসব সংস্থার গাফিলতি ও অবহেলাজনিত মৃত্যুর দায় এড়ানোর কোনো সুযোগ নেই।

ঢাকার বিভিন্ন আবাসিক এলাকার ভবনগুলোয় ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার, ল্যাবেরেটরি, কোচিং সেন্টার, রেস্তোরাঁর মতো বাণিজ্যকেন্দ্র খুলে পুরোদস্তুর ব্যবসা চালানো হচ্ছে। এসব দেখার কেউ নেই। অথচ এসব ভবন মালিকের ‘আবাসিক ভবন’ হিসাবেই প্রাথমিক সনদ দেওয়া হয়েছিল। এসব আবাসিক ভবন, কী করে বাণিজ্যিক ভবনে পরিণত হয়? বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। গ্রিন কোজি কটেজ আবাসিক ভবন থেকে বাণিজ্যিক কেন্দ্রে রূপান্তরিত হওয়ার ব্যাপারে রাজউক ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন তাদের দায়িত্ব এড়াতে পারে না। প্রশ্ন হচ্ছে, রাজউক কর্তৃপক্ষ কি এ ভবনটিকে বাণিজ্যিক ভবন হিসাবে ব্যবহারের জন্য চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছিল? ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনই বা কী করে গ্রিন কোজি কটেজের সাতটি ফ্লোরে আলাদাভাবে রেস্তোরাঁসহ সাতটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খোলার বাণিজ্যিক লাইসেন্স দিয়েছে? এসব অনুমোদন দেওয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সংস্থার যেসব কর্মকর্তা জড়িত ছিলেন, তাদের সবার পরিচয় প্রকাশ করে আইনের আওতায় আনতে হবে। জানা যায়, আবাসিক এ ভবন মালিকের ক্ষমতার হাত বেশ লম্বা ছিল। ফায়ার সেফটি সার্টিফিকেট না পাওয়ায় ভবন মালিক, ফায়ার সির্ভিসের বিরুদ্ধে সংবাদ সম্মেলন করার হুমকিও নাকি দিয়েছিলেন। কথিত আছে, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুর কাছাকাছি এমন অনেক বহুতল ভবন মালিকদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে সংশ্লিষ্ট সংস্থার কর্মকর্তাদের দশবার হিসাব করতে হয়।

এ প্রসঙ্গে, ২০১৯ সালে বনানীর ২২ তলা ভবনে অগ্নিকাণ্ডের পর বেসরকারি টেলিভিশনে রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মো. নূরুল হুদার অসহায়ত্ব প্রকাশের কথা মনে পড়ে গেল। সেদিন টেলিভিশনে তিনি বলেছিলেন, ‘তার সময়ে বিল্ডিং কোড অগ্রাহ্য করে ঢাকার বিভিন্ন স্থানে উঁচু ভবন নির্মিত হয়েছে এমন একশ পঞ্চাশেরও কিছু বেশি মামলা তিনি করেছিলেন; কিন্তু মামলার পর প্রভাবশালী ভবন মালিকরা আদালত থেকে স্থগিতাদেশ নিয়ে শুধু ভবন নির্মাণ সম্পন্ন করেননি, সেসব ভবনে দিব্যি বাণিজ্য চালিয়ে গেছেন। অথচ তখন পর্যন্ত মামলা নিষ্পন্ন হয়নি’। তাকে প্রভাবশালী মহলের দু-একজনের নাম উল্লেখ করতে বললে তিনি অধিকতর উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলেন, “তাদের নাম বলার সাহস আমার নেই, আজ যদি তাদের নাম বলি তাহলে আগামীকালই আমি ‘গুম’ হয়ে যাব। ক্ষমা করবেন আমি তাদের নাম বলতে পারব না।” এখানে উল্লেখ করার মতো বিষয় হলো, এসব ব্যক্তি এতটাই প্রভাবশালী, তারা মানুষ ‘গুম’ করার ক্ষমতাও রাখেন। রাজউক চেয়ারম্যান যদি প্রভাবশালী মহলের ভয়ে এমন আতঙ্কগ্রস্ত থাকেন, তাহলে অন্যদের কথা বলাই বাহুল্য।

এফআর টাওয়ার অগ্নিকাণ্ডের পর ফায়ার সার্ভিস ঢাকা শহরের ২৪ হাজার ১৯৩টি ভবনে তত্ত্বানুসন্ধান করে এক-তৃতীয়াংশ ভবনকে অগ্নিঝুঁকি হিসাবে চিহ্নিত করেছিল। এ অগ্নিঝুঁকি ভবনগুলোর মধ্যে আবার ১ হাজার ৮০৩টি ভবনকে অতি-অগ্নিঝুঁকির আওতায় পাওয়া গেছে। এসব ভবন মালিককে প্রয়োজনীয় অগ্নিনিরাপত্তাব্যবস্থা নিশ্চিত করার নির্দেশও দেওয়া হয়েছে। ফায়ার সার্ভিস বলেছে, ২০২০ সালের পর ঢাকায় যতগুলো বড় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে, এর সবই তাদের অগ্নিঝুঁকির তালিকায় ছিল। বেইলি রোডের ভবনটিতে যে কোনো সময় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে উল্লেখ করে কয়েক দফা চিঠি দিয়ে জানানোর পরও কর্তৃপক্ষ কোনো পদক্ষেপই নেয়নি। এ বিষয়ে গণমাধ্যমে অনেকেই ফায়ার সার্ভিসকে দোষারোপ করে লিখেছেন, শুধু চিঠি দিয়েই কেন তারা বসে ছিলেন? ভবনটিকে সিলগালা করে দেওয়া হলো না কেন? আমি ফায়ার সার্ভিসের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, কিছু বিধিনিষেধ থাকায় সিলগালা করার ক্ষমতা তারা প্রয়োগ করতে পারছেন না। অগ্নিপ্রতিরোধ ও নির্বাপণ-২০০৩ আইনে তাদের মামলা করার ক্ষমতা দেওয়া হলেও অদৃশ্য কারণে তা স্থগিত আছে। তবে এ ব্যাপারে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন চাইলে ব্যবস্থা নিতে পারত। ফায়ার সার্ভিস তাদের চিঠির একটি অবগতি কপি সিটি করপোরেশনকেও দিয়েছিল বলে ওই কর্মকর্তা জানান। ২০২৩ সালে বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সে অগ্নিকাণ্ডের ব্যাপারেও তাই হয়েছে। ফায়ার সার্ভিস ওই সময় বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সে যে কোনো সময় অগ্নিকাণ্ড ঘটতে পারে জানিয়ে ১০ বার চিঠি দিয়েছিল। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনকেও চিঠি দিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ করেছিল তারা; কিন্তু কোনো ব্যবস্থাই গ্রহণ করা হয়নি। ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে। খবরের কাগজে দেখেছি, এ ব্যাপারে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বরং তাদের অসহায়ত্বের কথাই বলেছেন। তারা কোনো পদক্ষেপ নিতে গেলেই ভবন মালিক ও বিপণিবিতানের মালিক সমিতির লোকরা ভবন না ভাঙার বিষয়ে উচ্চ আদালতের নির্দেশ নিয়ে আসেন। এসব পর্যালোচনা করে মনে হয়, অগ্নিপ্রতিরোধকল্পে সার্বিক সমন্বয়ের বিষয় আছে। যেখানে মানুষের জীবনমৃত্যুর ঝুঁকি আছে, গরিবের রুটি-রুজি বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা আছে, সেখানে নির্দেশনা দেওয়ার ক্ষেত্রে সব মহলের ভেতর বোঝাপড়ার প্রয়োজন আছে।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বেইলি রোডের অগ্নিকাণ্ড প্রসঙ্গে হতাশা ও ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, সেখানে বহুতল ভবনে অগ্নিনির্গমন পথ ছিল না। ছিল না কোনো অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা। তিনি আরও বলেছেন, ‘আমরা অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রের ব্যবস্থা করেছি, তবুও মানুষ এতটা সচেতন নয় কেন?’ প্রধানমন্ত্রী সঠিক কথাই বলেছেন। কিন্তু তিনি বললে কী হবে; যদি তা মান্য করা না হয়। প্রধানমন্ত্রী কেবল হতাশা এবং ক্ষোভ প্রকাশ করলেই হবে? দেশের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলো যাতে এসব বিষয় বাস্তবায়ন করে, তাও নিশ্চিত করতে হবে। দেশের প্রখ্যাত স্থপতি ও নগর-পরিকল্পনাবিদরা বলেন, রানা প্লাজার ঘটনার পর মাত্র দেড় বছরে পুরো পোশাকশিল্প খাতের কমপ্লায়েন্সে পরিবর্তন আনতে পারলে অন্যান্য ক্ষেত্রে তা সম্ভব নয় কেন? তারা বলেন, আমাদের সামর্থ্য আছে; এখন শুধু রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রয়োজন। রাজনৈতিক অঙ্গীকার ছাড়া এ সমস্যা থেকে উত্তরণের কোনো পথ নেই। এসব বিষয়ে দেশে আইন আছে, নীতিমালা আছে, কৌশলপত্রও আছে। তাহলে এসবের সঠিক প্রয়োগ নেই কেন? এসব নিশ্চিত করার দায়িত্ব যাদের কাঁধে, তাদের বাধ্য করতে হবে সঠিক কাজটি যেন তারা করে। তা না হলে তাদেরও আইনের আওতায় এনে শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। মনে রাখতে হবে, সরষের ভেতর যদি ভূত চেপে বসে, তাহলে কিছুতেই কিছু হবে না। সবার আগে ভূত তাড়াতে হবে এবং সেই ভূত তাড়ানোর দায়িত্ব সরকারকেই নিতে হবে।

একেএম শামসুদ্দিন : অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম