নারীরা দেশের উন্নয়নের সমঅংশীদার
মনজু আরা বেগম
প্রকাশ: ০৮ মার্চ ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
নারীরা দেশের উন্নয়নের সমঅংশীদার
প্রতি বছর নতুন নতুন প্রতিপাদ্য নিয়ে বিশ্বজুড়ে নারীর প্রতি সম্মান, অধিকার আদায়ের জন্য আন্তর্জাতিক নারী দিবস উদযাপিত হয়ে আসছে। ১৮৫৭ সালের ৮ মার্চ যুক্তরাষ্ট্রের একটি সেলাই কারখানায় নারী শ্রমিকরা ভোটাধিকারসহ তাদের সম্মান ও মর্যাদা রক্ষার সঙ্গে সঙ্গে বেশ কিছু সুনির্দিষ্ট দাবিতে আন্দোলন করলে পুলিশি নির্যাতনের শিকার হন। ১৯১০ সালে জার্মান নারী নেত্রী ক্লারা জেটকিন প্রস্তাব করেন। পরবর্তীকালে ১৯৮৪ সালে জাতিসংঘ ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসাবে ঘোষণা করে। এর পর থেকে জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলো এ দিনটিকে বিশ্ব নারী দিবস হিসাবে সরকারিভাবে পালন করে আসছে। জাতিসংঘের সদস্য দেশ হিসাবে বাংলাদেশও এ দিনটি যথাযথভাবে উদযাপন করে থাকে। এ দিনে নারীরা তাদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, সম্মান ও মর্যাদা রক্ষা ও অধিকার আদায়ের কথা ব্যক্ত করেন এবং নাগরিকসমাজকে সচেতন করে তুলতে বিভিন্ন সচেতনতামূলক কর্মসূচি গ্রহণ করেন।
বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি নারী। পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ হিসাবে দেশের জনসংখ্যা এখন ১৬ কোটি ৯৮ লাখ ২৮ হাজার। এর মধ্যে পুরুষ ৮ কোটি ৪১ লাখ ৩৪ হাজার এবং নারী ৮ কোটি ৫৬ লাখ ৮৬ হাজার ৭৮৪ জন। তুলনামূলক বিশ্লেষণে পুরুষের চেয়ে নারীর সংখ্যা বেশি। আমাদের দেশের সামাজিক অবস্থা এমন পর্যায়ে যে, ডিজিটাল যুগে এসেও কন্যাশিশু জন্ম নিলে অনেক শিক্ষিত বাবা-মাও খুশি মনে গ্রহণ করতে পারেন না, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে কন্যাশিশুকে বোঝা মনে করা হয়। কারণ কন্যাশিশুকে লেখাপড়া শিখিয়ে পরের বাড়িতে পাঠাতে হবে। প্রবীণ বয়সে বাবা মায়ের দেখভাল করতে পারবে না। কন্যার বিয়ে দেওয়ার জন্য যৌতুক দিতে হবে বলে টাকা জমাতে হবে। তাছাড়া নারীরা আয়-রোজগার করলেও কর্মক্ষেত্রে পুরুষের তুলনায় অনেক কম আয় করেন। এছাড়া নারীরা সহিংসতার শিকার হন। সেজন্য সবখানে তাদের সবসময় আগলিয়ে রাখতে হয়। এসব বিষয় মানসিকভাবে প্রতিক্রিয়া তৈরি করে। জাতীয় মানবাধিকার কমিশন, ইউএনডিপি এবং সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশনের (সিআরআই) যৌথ জরিপে জানা যায়, দেশে ৮৭ শতাংশ নারী ও তরুণী তাদের জীবনে গণপরিবহণ ও পাবলিক প্লেসে যৌন হয়রানিসহ কোনো না কোনো ধরনের হয়রানির শিকার হয়। এদের মধ্যে ৬৬ শতাংশ তাদের জীবনে একাধিকবার হয়রানির শিকার হয়েছেন। প্রায় নিয়মিত হয়রানির শিকার হন ৭ শতাংশ। এছাড়া ৫৭ শতাংশ নারী মনে করেন তাদের জন্য গণপরিবহণ সবচেয়ে অনিরাপদ। জরিপে জানা যায়, হয়রানির শিকার হওয়া এ নারীদের মধ্যে মাত্র ৩৬ শতাংশ প্রতিবাদ করেন। ৭ শতাংশ তাদের পরিবারকে জানান, ৫ শতাংশ আশপাশের লোকদের কাছে সাহায্য চান এবং মাত্র ১ শতাংশ নারী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জানান। ১ শতাংশ নারী ৯৯৯-এ ফোন করেন। ১ শতাংশ নারী বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করেন এবং সহযোগিতা চান। মজার ব্যাপার হচ্ছে, ৪৩ শতাংশ নারী হয়রানির পরে কিছুই করেন না। জরিপের মতামত অনুসারে, ৪৪ শতাংশ নারী পাবলিক প্লেসে হয়রানির সময় কোনো সাহায্য বা সহযোগিতা পাননি। ২৭ শতাংশ জানিয়েছেন, তারা কিছু মানুষের সাহায্য পেয়েছেন, তবে ৬৫ শতাংশ নারী মনে করেন মানুষের প্রতিবাদ করা উচিত। ৪৮ শতাংশ নারী মনে করেন, নারীর প্রতি সম্মানের অভাবে এসব হয়রানির ঘটনা ঘটে।
প্রশ্ন হলো, একটি দেশের মোট জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশি যেখানে নারী, সেখানে নারীরা যদি দেশের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ না করে ঘরে বসে শুধু গৃহস্থালি বা সন্তান লালন-পালনের কাজ করেন, তাহলে দেশের সার্বিক উন্নয়ন কিভাবে সম্ভব হবে? বর্তমানে অবশ্য এ ধারণা অনেকটা পালটেছে। নারীরা আজ তাদের অভিজ্ঞতায়, দক্ষতায়, মেধা-মননে এগিয়ে যাচ্ছেন। চার দেওয়ালের বন্দিজীবন থেকে বেরিয়ে তারা নিজ নিজ ক্ষেত্রে তাদের যোগ্যতার স্বাক্ষর রাখছেন। নারীসমাজ আজ উন্নয়নের অন্যতম চালিকাশক্তি হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছে। কৃষি, শিল্প, সেবা, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ এমন কোনো খাত নেই যেখানে নারীরা এগিয়ে আসছেন না বা সেখানে তাদের দক্ষতার স্বাক্ষর রাখছেন না। দেশে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের যতগুলো খাত রয়েছে, তার প্রায় সব কটিতেই, বিশেষ করে কৃষি, শিল্পসহ পোশাক শিল্প খাতে নারীর অবদান সবচেয়ে বেশি। নারীরা এখন ঘরের বাইরে বেরিয়ে এসেছেন। দেশে এমন কোনো খাত নেই যেখানে নারীরা অংশগ্রহণ করছেন না। নারীরা আজ পর্বতশৃঙ্গ জয় করছেন। সামরিক-বেসামরিক সংস্থা থেকে শুরু করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সর্বক্ষেত্রেই তারা এগিয়ে আসছেন। আমাদের দেশে নারীরা স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে এগিয়ে গেছেন এবং যাচ্ছেন। পরিবার ও সমাজ এবং দেশের উন্নয়নে নারীরা সমানভাবে অবদান রেখে চলেছেন। সেই সঙ্গে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের ২০২০ সালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, মোট দেশজ উৎপাদনে নারীর অবদান প্রায় ২০ শতাংশ। দেশের রপ্তানি আয়ের ৮০ শতাংশের বেশি আসে পোশাক শিল্প খাত থেকে। এ খাতে ৫৪ শতাংশই নারী। প্রবাসী নারী শ্রমিকরাও দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখছেন। দেশের উন্নয়নে নারীরাও সমভাবে অংশীদার। বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের যতগুলো খাত আছে, তার প্রায় সবগুলোতে নারীদের অবদান রয়েছে।
তার পরও বলতে হয়, নারীরা প্রতিদিন বিভিন্নভাবে নির্যাতিত হচ্ছেন, ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন। নারীরা পরগাছা হিসাবে এখনো সমাজে পরিচিতি পাচ্ছেন। সম্পত্তিতে নারীর অধিকার তেমন নেই বললেই চলে। ফলে ব্যাংক ঋণ গ্রহণের ক্ষেত্রেও নারীরা পিছিয়ে আছেন। নারীরা রাস্তাঘাট, গণপরিবহণ, কর্মক্ষেত্র, সিনেমা হল, রেস্টুরেন্ট, এমনকি নিজের ঘরেও তারা নিরাপদে নেই। তাহলে কোথায় তারা নিরাপদ? দেশে মোট জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি নারী, দেশে খোদ প্রধানমন্ত্রী টানা চার মেয়াদে প্রধানমন্ত্রিত্ব করছেন, সংসদের স্পিকারও নারী, মন্ত্রী, সংসদ-সদস্য, সচিব, পুলিশ প্রশাসনসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ উচ্চপদে নারীরা অধিষ্ঠিত রয়েছেন। দেশের তৃণমূল পর্যায়ে অর্থাৎ স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও নারীরা এগিয়ে এসেছেন। সরাসরি নির্বাচনে অংশ নিয়ে নির্বাচিত হয়ে সংসদে প্রতিনিধিত্ব করছেন। তার পরও দেশে নারীরা কোথাও নিরাপদে নেই কেন? পরিবার, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে সমাজের সর্বক্ষেত্রে নারীরা ধর্ষণ, নির্যাতনের শিকার। নারীরা এখনো সমাজে বিভিন্নভাবে নির্যাতিত ও নিষ্পেষিত হচ্ছেন। নারী ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে কিছু ক্ষেত্রে দেশ এগিয়ে গেলেও এর গতিপ্রকৃতি অত্যন্ত মন্থর। নারীদের এখনো পিছিয়ে থাকার কারণ হিসাবে বলা যায় পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে নারীর প্রতি প্রথাগত দৃষ্টিভঙ্গি এখনো বিদ্যমান থাকার কারণে মৌলিক পরিবর্তন তেমন একটা হচ্ছে না এবং রাষ্ট্রীয়ভাবেও তেমন কোনো কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে না। নারীর অধিকার রক্ষার্থে যেটুকু আইন ও নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে, বাস্তবে যথাযথভাবে তার কোনো প্রয়োগ দেখতে পাই না। নারীর ক্ষমতায়নের কথা বলা হলেও প্রকৃত অর্থে নারীসমাজ এ ক্ষমতায়ন থেকে বেশ দূরেই অবস্থান করছে বলে আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়।
তার পরও বলতে হয়, নারীরা অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে এখন এগিয়ে আছেন। ২০২০ সালে প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘের ৭৫তম সাধারণ অধিবেশনে অঙ্গীকার করেছেন, ২০৪১ সালের মধ্যে কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ ৫০-৫০ শতাংশ হারে উন্নীত করবেন। বাংলাদেশের দ্বিতীয় প্রেক্ষিত পরিকল্পনা ২০২১ থেকে ২০৪১-এর প্রধান লক্ষ্য হলো ২০৪১ সালের মধ্যেই বাংলাদেশ হবে একটি উন্নত দেশ, যেখানে মাথাপিছু আয় হবে ১২৫০০ ডলারের অধিক। সরকারের এ অঙ্গীকারকে বাস্তবায়ন করতে হলে দেশের এই অর্ধেকেরও বেশি সংখ্যক নারীকে উৎপাদন ও উন্নয়নের মূল ধারায় আরও বেশি সম্পৃক্ত করতে হবে। আর তা করতে না পারলে উপরোক্ত লক্ষ্য অর্জন বা নারীর প্রকৃত ক্ষমতায়ন কখনোই সম্ভব হবে না। আমরা আশা করি, সরকার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে উপলব্ধি করে সে লক্ষ্যে কাজ করবে।
মনজু আরা বেগম : লেখক; অবসরপ্রাপ্ত মহাব্যবস্থাপক, বিসিক
monjuara2006@yahoo.com