Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

চির অম্লান সেই দিন

Icon

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী

প্রকাশ: ০৭ মার্চ ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

চির অম্লান সেই দিন

দেশ-বিদেশের বিপুলসংখ্যক কবি-সাহিত্যিক-লেখক তাদের কবিতা, সাহিত্য, গান ও অন্যান্য রচনায় বিভিন্ন উপমায় বঙ্গবন্ধুকে মহাকালের মহানায়ক হিসাবে অভিহিত করেছেন। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পটভূমি, দেশের সার্বিক পরিস্থিতি, আর্থ-সামাজিক বৈষম্যের নির্মম বেড়াজাল, সর্বোপরি দেশবাসীর করণীয় সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর অমিয়-তেজোদীপ্ত বাণী-নির্দেশনাগুলো হৃদয়ের গভীরে প্রোথিত করা না গেলে মহান মুক্তিযুদ্ধের সঠিক পাঠোদ্ধার, যথাযথ অনুধাবন ও উপলব্ধি করা কষ্টকর।

২০১৩ সালে জ্যাকব এফ. ফিল্ডের প্রকাশিত গ্রন্থ ‘We Shall Fight on the Beaches: The Speeches that Inspired History’ বিশ্বের শ্রেষ্ঠ একচল্লিশটি ভাষণের এক অনবদ্য সংকলন। বইটির নামকরণে সম্পাদক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলের ভাষণের এক উল্লেখযোগ্য বাক্য ব্যবহার করেছেন। যখন জার্মানির হিটলার ১৯৩৯ সালের সেপ্টেম্বরে পোল্যান্ড এবং ১৯৪০ সালের এপ্রিলে নরওয়ে দখলে নেন, তখন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চ্যাম্বারলিকে হিটলারের এ দখলদারত্বের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর ব্যর্থতার জন্য পদত্যাগে বাধ্য করে চার্চিলকে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে নিয়োগ দেওয়া হয়। অল্প বিরতিতে ফ্রান্সসহ হিটলারের অন্য দেশ দখলের জন্য নাৎসি বাহিনীর বিরুদ্ধে পার্লামেন্টে চার্চিল বলেছিলেন, ‘We shall fight on the seas and oceans, we shall fight with growing confidence and growing strength in the year...,we shall fight on the beaches,...we shall fight in the fields and in the streets and..., we shall never surrender.’ অনুরূপ চেতনায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ রেসকোর্সে বজ্র কঠিন উচ্চারণে বলেছিলেন, ‘আর তোমরা গুলি করবার চেষ্টা করো না। সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না। আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দাবাতে পারবা না।’ উল্লেখিত গ্রন্থে খ্রিষ্টপূর্ব ৪৩১ থেকে ১৯৮৭ সালে রোনাল্ড রিগানের ভাষণসহ মোট ৪১টি বিশ্বশ্রেষ্ঠ ভাষণের অন্যতম ছিল বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণটি। বিশ্বখ্যাত ও সফল রাষ্ট্রনায়কদের যেসব ভাষণ বিশ্ববাসীকে করেছে নির্ভীক ও অনুপ্রাণিত, সেসব ভাষণের অধিকাংশই ছিল সম্ভবত লিখিত। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ ছিল এর ব্যতিক্রম। লিখিত তো নয়ই, কোনো ধরনের ফুটনোট বা স্ক্রিপ্ট দেখে বঙ্গবন্ধু এ ভাষণ প্রদান করেননি।

১৯৭০ সালের ৭ ও ১৭ ডিসেম্বর যথাক্রমে পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ ও পাঁচটি প্রদেশে প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন হয়। আওয়ামী লীগ উভয় পরিষদেই একক ও নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। দুঃখজনকভাবে জুলফিকার আলী ভুট্টোর ঘোষণা ছিল-‘গত তেইশ বছর পূর্ব পাকিস্তান দেশ শাসনে ন্যায্য হিস্যা পায়নি, তাই বলে আগামী তেইশ বছর পাকিস্তানের ওপর প্রভুত্ব করবে তা হতে পারে না।’ পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক-বেসামরিক এবং ভুট্টোর দলের কূটকৌশলের ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ পাকিস্তানের সামরিক প্রেসিডেন্ট জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করেও ১ মার্চ অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করেন। এর প্রতিবাদে ক্ষুব্ধ বাঙালি বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে ১ মার্চ থেকে সারা দেশে ব্যাপক অসহযোগ আন্দোলনে স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ করে এবং উত্তাল মিছিল-স্লোগানে রাজপথ প্রকম্পিত করে তুলে। ৩ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধু তার ঘোষণায় বলেন, ‘২৩ বছর ধরে রক্ত দিয়ে আসছি। প্রয়োজনে আবার বুকের রক্ত দেব। মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে বীর শহিদদের রক্তের সঙ্গে বেঈমানি করব না।’ ধারাবাহিক আন্দোলনের অনিবার্য পরিণতি হিসাবে বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ তার ভাষণে বাংলাদেশের মুক্তি ও স্বাধীনতার ঘোষণা দেন।

২৮ জানুয়ারি ১৯৭১ ভুট্টোর সঙ্গে শুরু হওয়া তিন দিনব্যাপী আলোচনা সম্পূর্ণ ইচ্ছাকৃত ও অযৌক্তিকভাবে ব্যর্থ করে দিয়ে ১৩ ফেব্রুয়ারি ইয়াহিয়া খানের জাতীয় পরিষদের বৈঠক স্থগিতের ঘোষণা মূলত পাকিস্তান সামরিক জান্তার অপশাসন অব্যাহত রাখার ষড়যন্ত্রের প্রকাশ মাত্র। বঙ্গবন্ধু সঠিক সময়ে ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রের বিষয়টি অনুভব করেছিলেন এবং সেই অনুসারে প্রায়োগিক পরিকল্পনা গ্রহণে দূরদর্শিতার স্বাক্ষর রেখেছেন। ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ ঘোষণার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু প্রকৃত অর্থেই বাঙালি জাতিসত্তার উন্মেষ ঘটিয়ে দীর্ঘ অহিংস স্বাধীনতা সংগ্রামের চূড়ান্ত পর্যায়ে অর্জিত স্বাধীনতাকে অর্থবহ আনুষ্ঠানিকতা প্রদান করেন। ৭ মার্চের কালোত্তীর্ণ এ ভাষণ বিশ্ব ইতিহাসে চিরঅম্লান হয়ে থাকবে-দৃঢ়চিত্তে এটি বলা যায়।

মাটি ও মানুষের প্রতি নিখাদ ভালোবাসায় প্রণীত বঙ্গবন্ধুর মানস বাঙালির দুঃখ-দুর্দশা যথার্থ হৃদয়ঙ্গম করতে পারতেন। প্রসঙ্গত, অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে দেশের জনগণ যাতে বঞ্চনার শিকার না হন এবং খাদ্য-অর্থকষ্টে পর্যুদস্ত হয়ে না পড়েন, সে সম্পর্কে সবাইকে সতর্ক করে বঙ্গবন্ধু ভাষণে বলেছিলেন, ‘এর পরে যদি বেতন দেওয়া না হয়, আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোককে হত্যা করা হয়, তোমাদের উপর আমার অনুরোধ রইল : প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে তা নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছু, আমি যদি হুকুম দেবার না-ও পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে। সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না। আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দাবাতে পারবে না। সরকারি কর্মচারীদের বলি : আমি যা বলি তা মানতে হবে। যে পর্যন্ত আমার এদেশের মুক্তি না হবে-খাজনা, ট্যাক্স বন্ধ করে দেওয়া হলো। কেউ দেবে না। শোনেন-মনে রাখবেন, শত্রুবাহিনী ঢুকেছে, নিজেদের মধ্যে আত্মকলহ সৃষ্টি করবে, লুটতরাজ করবে। এই বাংলায় হিন্দু-মুসলমান, বাঙালি-নন-বেঙলি যারা আছে তারা আমাদের ভাই। তাদের রক্ষার দায়িত্ব আপনাদের উপরে, আমাদের উপরে, আমাদের যেন বদনাম না হয়।’

বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতিকে সুনির্দিষ্ট পন্থায় এগিয়ে নিয়েছিলেন বলেই অনুপস্থিতি সত্ত্বেও তারই নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ মহান মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা ও স্বাধীনতা অর্জনে সফল হয়। রণকৌশল ও রণনীতি কী হবে এবং কীভাবে বাঙালি জাতি সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা পালন করবে, সে বিষয়েও বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনা ছিল-‘প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহল্লায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোলো এবং তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেব-এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব, ইনশাল্লাহ।’

বঙ্গবন্ধুর শ্রেষ্ঠত্ব তিনি শুধু বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের একজন স্বপ্নদ্রষ্টাই ছিলেন না, অনন্যসাধারণ এক ঐক্যের বন্ধনে বাঙালি জাতিকে একতাবদ্ধ করে হাজার বছরের বাঙালি জাতির স্বপ্নকে বাস্তবে রূপদান করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তার আগে ও পরে বহু খ্যাতিমান রাজনীতিবিদ এসেছেন, কিন্তু এমন করে কেউ বাঙালিকে জাগাতে পারেননি। তাই বঙ্গবন্ধুকে প্রতিষ্ঠার জন্য শক্তি প্রয়োগের যেমন প্রয়োজন পড়ে না, তেমনি তাকে ইতিহাস থেকে নির্বাসিত করাও অসম্ভব। ভারতের মহাত্মা গান্ধী, যুক্তরাষ্ট্রের জর্জ ওয়াশিংটন, চীনের মাও সেতুং, ভিয়েতনামের হো চি মিন, কিউবার ফিদেল কাস্ত্রো, কঙ্গোর প্যাট্রিস লুমুম্বা, ঘানার কোয়ামে নক্রুমা, দক্ষিণ আফ্রিকার নেলসন ম্যান্ডেলা, সোভিয়েত ইউনিয়নের লেনিন, যুগোস্লাভিয়ার মার্শাল টিটোর মতো বাংলাদেশের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও তার অবদানের জন্য বিশ্ব ইতিহাসের এক অনিবার্য স্থানে অধিষ্ঠিত হয়ে আছেন।

বঙ্গবন্ধুকে প্রতিষ্ঠার জন্য শক্তি প্রয়োগের যেমন প্রয়োজন পড়ে না, তেমনি তাকে ইতিহাস থেকে নির্বাসিত করাও অসম্ভব। ১৯৭৫-এর ২৮ আগস্ট লন্ডনের ‘দি লিসনার’ পত্রিকায় বিবিসির সংবাদদাতা ব্রায়ান ব্যারনের ভবিষ্যদ্বাণী-‘‘বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের হৃদয়ে উচ্চতর আসনেই অবস্থান করবেন। তার বুলেট-বিক্ষত বাসগৃহটি গুরুত্বপূর্ণ ‘স্মারক-চিহ্ন’ এবং কবরস্থানটি ‘পুণ্যতীর্থে’ পরিণত হবে।’’ আজ এটি বিশ্বব্যাপী এক সত্যবাণীতে পরিণত হয়েছে। অধ্যাপক আবুল ফজলের ভাষায়, ‘শত চেষ্টা করেও তাঁর নাম ইতিহাস থেকে মুছে ফেলা যাবে না। ইতিহাস দেয় না তেমন কিছু করতে। ইতিহাস নিজের অঙ্গ করে না ছেদন। শেখ মুজিব ইতিহাসের তেমন এক অচ্ছেদ্য অঙ্গ। বাংলাদেশের শুধু নয়, বিশ্ব-ইতিহাসের।’

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী : শিক্ষাবিদ; সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম