Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

শুদ্ধ বাংলার চর্চা হোক সারা বছর

Icon

এম এ হালিম

প্রকাশ: ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

শুদ্ধ বাংলার চর্চা হোক সারা বছর

ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি শেষ হতে চলেছে। ১৯৫২ সালে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে বাংলা স্বীকৃতি পেলেও তা অর্জনের জন্য আন্দোলন শুরু হয়েছিল ১৯৪৮ সালে, এমনকি তারও আগে। কিন্তু প্রশ্ন জাগে, আমরা কি শুধুই এ স্বীকৃতিতেই সন্তুষ্ট থাকব, নাকি চাই অনেক আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে অর্জিত এ ভাষার সর্বস্তরে যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে। ২১ ফেব্রুয়ারি এখন শুধুই জাতীয় নয়, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। এটিও আমাদের এক যুগান্তকারী অর্জন। তবুও মনে হয় বাংলা ভাষাকে নিয়ে আমাদের সব উদ্যোগ আর প্রচারণা শুধুই ফেব্রুয়ারিকেন্দ্রিক। মাসব্যাপী বইমেলা, প্রতিদিন আলোচনা অনুষ্ঠান, টিভিতে টকশো, বিবৃতি আর ২১ ফেব্রুয়ারি শহিদ মিনারকেন্দ্রিক কত অনুষ্ঠানমালা। কিন্তু বিব্রতকর হলেও সত্য, এ দিনের সূচনা অনুষ্ঠানই একধরনের ইংরেজি সংস্কৃতি অনুসরণে; কারণ, ২০ ফেব্রুয়ারি মধ্যরাতের পরপরই শুরু হয় শহিদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ আর ‘প্রভাতফেরি’। তারিখ হিসাবে আগের দিন মধ্যরাতের পর অর্থাৎ রাত ১২টা ১ মিনিট থেকে নতুন দিন শুরু হলেও আমরা দিনের কার্যক্রম শুরু করি সূর্যোদয়ের পর। এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী মন্তব্য করেছেন, ইংরেজি রীতিতে মধ্যরাতের পর ‘প্রভাতফেরি’ করা হচ্ছে।

বাংলা লেখার ক্ষেত্রেই আমরা কতটা সচেতন? যে মাসকে ঘিরে আমরা সবচেয়ে বেশি অনুষ্ঠান করি, অনেকে সে মাসেরই বানান লিখতে ভুল করেন-‘ফেব্রুয়ারি’ না লিখে লেখেন ‘ফেব্রুয়ারী’। আবার শহিদ মিনারে (আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক) পুষ্পস্তবকে বড় করে লেখেন ‘শ্রদ্ধাঞ্জলী’, যদিও শুদ্ধ বানান হবে ‘শ্রদ্ধাঞ্জলি’। এরকম অনেক ভুল বানানই অহরহ চোখে পড়ে। এটি শুধুই যে অজ্ঞতাবশত তা নয়, আমার মনে হয়, অনেক ক্ষেত্রেই তা অবজ্ঞাবশত। আমার অফিসে শুদ্ধ বাংলা লেখার ব্যাপারে আমি খুবই সচেতন থাকতাম এবং সহকর্মীদের সচেতন হতে উপদেশ দিতাম। অনেকে বলত, ‘স্যার, বাংলা তো বুঝতে পারলেই হয়।’ আমি বলতাম, ইংরেজি বানান ভুল করলে তা মার্জনীয়; কারণ, সেটি আমাদের মাতৃভাষা নয়; কিন্তু বাংলা বানান ভুল কেন হবে, যা তোমার-আমার মাতৃভাষা? আমার নিত্যদিনের পীড়াপীড়িতে লক্ষ করতাম, সহকর্মী অনেকেই বেশ সচেতন থাকত, আমার কাছে বাংলা ড্রাফট নিয়ে আসত।

শহর আর পাড়ামহল্লার অনেক অফিস, প্রতিষ্ঠান ও দোকানে ইংরেজি সাইনবোর্ড দেখা যায়। আবার অনেক প্রতিষ্ঠান ও দোকানে বাংলা সাইনবোর্ড থাকলেও তা ভুল বানানে লেখা। এসবই ঘটছে বাংলা ভাষার প্রতি অবজ্ঞার কারণে। প্রসঙ্গক্রমে, বিদেশে দেখেছি সব ক্ষেত্রেই তাদের নিজস্ব ভাষায় সাইনবোর্ড। ইউরোপে ভ্রমণ করতে গিয়ে অনেক সময়ই এজন্য অসুবিধায় পড়তে হয়েছে ঠিকানা খুঁজতে গিয়ে।

সংবাদপত্রগুলো বানান সচেতন এবং বলা যায় শতভাগ নির্ভুল বানানেই সংবাদ ও লেখা প্রকাশ করে তারা। কিন্তু লক্ষ করেছি, সংবাদপত্রে প্রকাশিত বিজ্ঞাপনে অনেক বানান ভুল থাকে। যুুক্তি হিসাবে বলা হবে, বিজ্ঞাপন সাধারণত বিজ্ঞাপন এজেন্ট ডিজাইন করে পত্রিকা অফিসে ছাপানোর জন্য পাঠায়; সুতরাং, তার দায় সংবাদপত্র কর্তৃপক্ষের নয়। আমি বলব, নির্ভুল বানানে পত্রিকা প্রকাশ করা যদি দায়িত্ব হয়, তাহলে বিজ্ঞাপনও নির্ভুল বানানে ছাপানো উচিত; কেননা বিজ্ঞাপন তো প্রকাশিত সংবাদপত্রেরই অংশ হয়ে যায়।

আজকাল টিভি পর্দার স্ক্রলিংয়ে সংবাদ ও বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়। সেখানেও প্রায়ই দেখি ভুল বানানের ছড়াছড়ি। টিভি কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি ভাবার ও বানানের বিষয়ে দায়িত্বশীল হতে অনুরোধ করব। বাংলা একাডেমি ২০১২ সালে প্রমিত বাংলা বানানরীতি প্রকাশ করলেও আইনি বাধ্যবাধকতা না থাকায় অনেকেই তা অনুসরণ করেন না। আগেই বলেছি, এটি যতটা না অজ্ঞতা, তার চেয়ে বেশি অবজ্ঞা।

আসা যাক বাংলা উচ্চারণ প্রসঙ্গে। আজকাল অনেককে ভুল ও নিজস্ব ভঙ্গিমায় বাংলা উচ্চারণ করতে দেখি। ইংরেজি মাধ্যমে পড়া অনেক ছেলেমেয়ের অভিভাবক ‘গর্ব করে’ বলেন, তার ছেলে/মেয়ে ভালো করে বাংলা বলতে পারে না। আমি এতে গর্বের কিছু দেখি না, বরং মূল্যায়ন করি মাতৃভাষার প্রতি অবজ্ঞা হিসাবে। আজকাল তো অনেক বেসরকারি বেতারের উপস্থাপকরা ইংরেজি-মিশ্রিত বাংলা উচ্চারণ করেন, যাকে অনেকে ঠাট্টা করে বলেন ‘বাংলিশ’। এটি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না, তাই বেতার কর্তৃপক্ষকে যত্নবান হতে অনুরোধ করব।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বুধবার আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের এক অনুষ্ঠানে আক্ষেপ করে বলেছেন, ‘ইংরেজি বাচনভঙ্গিতে বাংলা বললে ভাষার মাধুর্য হারিয়ে যায়।’ বেতার-টেলিভিশনে ‘বিকৃত উচ্চারণ’ ও ‘ভাষা ব্যঙ্গ’ করে কোনো অনুষ্ঠান না করতে ২০১৬ সালে হাইকোর্টের নির্দেশ রয়েছে। এক্ষেত্রেও আইনি বাধ্যবাধকতা না থাকায় এ নির্দেশ সঠিকভাবে প্রতিপালন হচ্ছে না। কিন্তু শত আত্মত্যাগের বিনিময়ে যে মাতৃভাষা আমরা পেয়েছি, তা সর্বস্তরে প্রচলনের দায়িত্ব তো আমাদের সবার, তার জন্য নতুন করে আইনের অপেক্ষা করতে হবে কেন? পাকিস্তানে রেডক্রস মিশনে থাকাকালীন (২০০১-২০০২) পাকিস্তানের সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলে তাদের মনোভাব জেনেছি। তারাও বলত, ‘তোমাদের ওপর উর্দু ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার কোনো যুক্তি ছিল না।’ যাদের কাছ থেকে আমরা আমাদের মাতৃভাষার অধিকার ছিনিয়ে এনেছি, তাদের মনোভাবই যদি এই হয়, তাহলে আমরা কেন তা অর্জনের ৭২ বছর পরও সেই ভাষাকে অবিরত অবজ্ঞা করব আর ফেব্রুয়ারি এলেই শুধু তা নিয়ে প্রচারণায় ব্যস্ত হব? শুদ্ধ বাংলার চর্চা তো হতে হবে সারা বছর, আমাদের কথায় আর লেখনীতে।

এম এ হালিম : সাবেক পরিচালক, বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি

halim_64@hotmail.com

 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম