Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

শতফুল ফুটতে দাও

অমর একুশে

Icon

ড. মাহবুব উল্লাহ্

প্রকাশ: ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

অমর একুশে

এ বছরের শহিদ দিবস পালিত হয়েছে গতকাল। এ দিবসটিকে বাংলাদেশের মানুষ শহিদ দিবস হিসাবে চিহ্নিত করেছে ৭০ বছরেরও আগে। কিন্তু এখন দেখছি এ দিবসটিকে নানাজন নানাভাবে চিহ্নিত করছে। দিবসটিকে বলা হচ্ছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। আবার কেউ কেউ এ দিবসটির নামকরণ করছে ভাষা দিবস হিসাবে। তবে দিনটি যে শহিদ দিবস, তা নিয়ে বিভ্রান্তির অবকাশ নেই। সঠিক রাজনৈতিক এজেন্ডা না থাকলে এ নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টির সম্ভাবনা থাকে। ১৯৪৮ সালে ভাষা আন্দোলনের সূচনালগ্ন থেকে দাবি তোলা হয়েছিল, পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হবে ‘বাংলা’। ভাষা আন্দোলনের মূল ধারা থেকে কখনোই বলা হয়নি-কেবল বাংলাই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। মূল দাবি ছিল উর্দুর পাশাপাশি বাংলা হবে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা।

১৯৫২-এর ২১ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে মিছিল করা ছাত্র-জনতার ওপর গুলিবর্ষণ করা হয়। এ গুলিবর্ষণে শহিদ হন বরকত, সালাম, রফিক, জব্বারসহ বেশ কয়েকজন ভাষাশহিদ। সে সময় পুলিশ বিক্ষোভ দমনের জন্য থ্রি নট থ্রি রাইফেল ব্যবহার করত। এ রাইফেলের গুলি কারও দেহ স্পর্শ করলে দেহের গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলো দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেত। সেদিন যারা শহিদ হয়েছিলেন, তাদের কারোর মাথার খুলি উড়ে গিয়েছিল, কারোর বক্ষ বিদীর্ণ হয়ে হৃৎপিণ্ড ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। সেকালে পুলিশ রাবার বুলেট ব্যবহার করত না। তারা থ্রি নট থ্রি রাইফেলে প্রাণঘাতী বুলেট ব্যবহার করত। এ বুলেট অনেক দূর যেত এবং কারও দেহের গুরুত্বপূর্ণ অর্গানকে স্পর্শ করলে মৃত্যু ছিল প্রায় অবধারিত। আজকাল পুলিশ রাবার বুলেট ব্যবহার করে। এ বুলেট সাধারণত মানবদেহকে এফোঁড়-ওফোঁড় বিদীর্ণ করে না। তা সত্ত্বেও দেখা যায়, অনেকে যারা রাবার বুলেটে আহত হয়েছেন, তারা খুব সহজে সুস্থ হয়ে ওঠেন না। রাবার বুলেটে মস্তিষ্ক স্পর্শিত হলে চিকিৎসা জটিলতার সৃষ্টি হয়। এদেশে মানবাধিকারের বিষয়টি এতই তুচ্ছ যে, গুলিবর্ষণের ঘটনার জন্য কোনো তদন্ত হয় না। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে কোনো ধরনের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয় না। আমাদের প্রজন্মের অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তি অকারণে গুলি ছোড়া নিয়ে আগের দিনগুলোর মতো প্রতিবাদে মুখর হয়ে ওঠেন না। পরিস্থিতি আরও জটিল ও বর্বর হয়ে উঠেছে ‘হেলমেট বাহিনী’ নামক একটি গোষ্ঠীর হিংস্রতা ও সন্ত্রাসের তাণ্ডবে। এমন তো হওয়ার কথা ছিল না। ২১ ফেব্রুয়ারির সজ্ঞাত চেতনা থেকে আমরা অনেক দূরে সরে গেছি।

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি যে কালজয়ী চেতনার বিস্ফোরণ ঘটেছিল, পরিস্থিতি দেখে তা আর মনে হয় না। ’৫২-এর ২১ ফেব্রুয়ারি-পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে বাংলার দাবিকে নস্যাৎ করার জন্য প্রতিক্রিয়াশীল মুসলিম লীগের কোনো কোনো নেতা আরবি হরফে বাংলা লেখার দাবি তুলেছিলেন। আবার কেউ কেউ রোমান হরফে বাংলা লেখা প্রচলনের দাবি তুলেছিলেন। এর কোনোটাই সাধারণ মানুষের কাছে এবং বিশেষ করে চিন্তাশীল মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের নামকরা বুদ্ধিজীবীরা বাংলা ভাষাকে কালিমালিপ্ত হতে দেননি তাদের সাহসী উচ্চারণে। সেদিন যদি আরবি হরফ অথবা রোমান হরফে বাংলা লেখার প্রচলন হয়ে যেত, তাহলে বাংলা ভাষার সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের সঙ্গে আমাদের বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি হতো। বাংলা ভাষার জন্য অঙ্গহানিকর যে কোনো প্রস্তাবের বিরুদ্ধে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বুদ্ধিজীবী, ছাত্র, কৃষক, শ্রমিকসহ জনগণের সব অংশ থেকে প্রতিবাদ উঠেছিল। এ কারণে যেসব দুষ্টচিন্তার মানুষ বাংলা ভাষা নিয়ে ছেলেখেলা করতে চেয়েছিলেন, তারা পিছু হটতে বাধ্য হন।

১৯৫৬ সালের ২৩ মার্চ পাকিস্তানের শাসনতন্ত্রের যাত্রা শুরু হয়। একটি সম্মত সংবিধান তথা শাসনতন্ত্র রচনায় দীর্ঘ সময় লেগে যাওয়ার ফলে একটা বিষয় স্পষ্ট হয়ে ওঠে, তা হলো-পাকিস্তানের জনপ্রতিনিধিরা তাদের নিজেদের মধ্যে অভিন্ন চত্বর খুঁজে পাননি। প্রায় সব বিষয়ে দ্বিমতের সৃষ্টি হয়েছিল। এর নিরসন সহজসাধ্য ছিল না। যা হোক, এত বিভ্রান্তি ও হতাশার মধ্যেও শেষ পর্যন্ত একটি সম্মত সংবিধান দলিল পাওয়া গেল। এটা নিঃসন্দেহে আনন্দের বিষয়। এ সংবিধানে রাষ্ট্রীয়ভাবে রাষ্ট্রভাষা উর্দুর পাশাপাশি বাংলাও তার মর্যাদার আসন লাভ করেছিল। সেদিনকার সংবিধানে অনেক গুরুত্বপূর্ণ দাবিদাওয়া স্থান করে নিতে পারেনি। স্বীকৃত হয়নি সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের দাবি। এ দাবির মূল কথা ছিল জনসংখ্যার ভিত্তিতে প্রতিটি প্রদেশ জাতীয় সংসদে প্রতিনিধি নির্বাচন করে পাঠাতে পারবে। কিন্তু এ ন্যায্য দাবি মেনে নেওয়া হলো না। এ সংবিধানের অন্যতম রচয়িতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের জায়গায় সংখ্যাসাম্য মেনে নেওয়ার যৌক্তিকতা উপস্থাপন করেছিলেন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মুখপাত্র হিসাবে বিবেচনা করা হতো। তিনি সংখ্যাসাম্যের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করায় সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের দাবি দুর্বল হয়ে যায়। এছাড়া ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি উত্থাপিত পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি এ সংবিধানে স্থান পায়নি। ওই সময় পাকিস্তান জাতীয় সংসদের স্পিকার ছিলেন মরহুম আবদুল ওহাব খান। পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল ছিলেন মেজর জেনারেল ইস্কান্দার মির্জা। ইস্কান্দার মির্জা সংবিধান অনুমোদিত হওয়ার পর পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। আলোচ্য সংবিধান অনুযায়ী পশ্চিম পাকিস্তানকে একটি সম্মিলিত প্রদেশ হিসাবে ঘোষণা দেওয়া হয়। অথচ পশ্চিম পাকিস্তানে এতদিন চারটি প্রদেশ ছিল-যথাক্রমে সিন্ধু, পাঞ্জাব, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ও বেলুচিস্তান। উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ এখন খাইবার-পাখতুনখোয়া প্রদেশ হিসাবে পরিচিত।

১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জা সামরিক শাসন জারি করেন। সেনাপ্রধান আইয়ুব খানকে প্রধান সামরিক শাসক নিয়োগ দেওয়া হয়। এর ২০ দিন পর ২৭ অক্টোবর ইস্কান্দার মির্জাকে ক্ষমতা থেকে অপসারণ করে লন্ডনে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। আইয়ুব খান দেশের সর্বময় কর্তৃত্ব দখল করেন। সামরিক আইন জারি হওয়ার পর সংবিধান বাতিল হয়ে গেল। সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করা হলো। বহু রাজনৈতিক নেতাকে প্রাদেশিক নিরাপত্তা আইন এবং পাকিস্তান নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করা হলো। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ সামরিক শাসন জারির পর ভিন্নভাবে চিন্তা করতে শুরু করে। ছাত্র-যুবকরা স্বাধীন পূর্ব বাংলার স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। এরই পরিণতিতে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে একদল রাজনীতিবিদ ও রাজনৈতিক কর্মী দিবানিশি এ চেতনার পক্ষে নানাভাবে তাদের অভিমত ব্যক্ত করে। কিন্তু দেখা যায়, এখনকার তরুণ-তরুণীরা অনেকেই স্বাধীন বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কিত ঐতিহাসিক দিন-তারিখগুলো বলতে পারে না। এবারের একুশে বইমেলায় একজন সাংবাদিক এসব দিন-তারিখ নিয়ে মেলায় আগত তরুণ-তরুণীদের নানাবিধ প্রশ্ন করেন। এসব তরুণ-তরুণী জানে না ভাষা আন্দোলন কবে হয়েছিল, জানে না কয়েকজন ভাষা শহিদের নাম, জানে না আমাদের স্বাধীনতা দিবস কোনটি, জানে না ১৯৭১ সালে কী হয়েছিল। এ প্রজন্মের সদস্যরা বইমেলা দেখতে আসে তা যেমন সত্য, তার চেয়েও অধিকতর সত্য হলো তারা নিজ দেশ, ভাষা আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কিছুই বলতে পারে না। এটাই হলো মেধাশূন্য রাজনীতির ফল। কে এই রাজনৈতিক ধারাকে সঠিক খাতে প্রবাহিত করবেন? রাজনীতি ও ইতিহাস নিয়ে এমন দীনতা কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না। ২১ ফেব্রুয়ারি শহিদ দিবস উপলক্ষ্যে পাকিস্তান আমলে, এমনকি বাংলাদেশ-উত্তরকালে সংকলন প্রকাশিত হতো। সংকলন প্রকাশ নিয়ে বিভিন্ন ছাত্র ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের মধ্যে প্রতিযোগিতা হতো। সংকলন প্রকাশের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ অনেক সংগঠনের পক্ষে জোগাড় করা সম্ভব হতো না। সেসব ক্ষেত্রে সংকলন প্রকাশের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মীদের প্রেস মালিকদের দুর্ব্যবহারের শিকার হতে হতো। তা সত্ত্বেও দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মীরা সংকলনের প্যাকেট নিয়ে প্রভাতফেরির মিছিলে হাজির হওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করত। ১৯৬৯-এর শহিদ দিবসে শোকার্ত মানুষের যে অনুভূতি দেখেছি, তা আমার জীবনে এ পর্যন্ত অভূতপূর্ব এক স্মৃতি। ’৫২-এর ২১ ফেব্রুয়ারির পর পরবর্তী বছরগুলোয় অতিপ্রত্যুষে প্রভাতফেরি দিয়ে শহিদ দিবসের সূচনা হতো। ১৯৭০-এর ১ জানুয়ারি থেকে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ওপর নিষেধাজ্ঞা উঠে গেলে ’৭০-এর জানুয়ারির ১ তারিখে অর্থাৎ রাত ১২টা ১ মিনিটে মশাল মিছিলের আয়োজন করে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন মেনন গ্রুপ। এরই ধারাবাহিকতায় পরবর্তীকালে শহিদ দিবসের অনুষ্ঠান রাত ১২টা ১ মিনিটে শুরু হতে থাকে। এ ধারণাটি এসেছিল আমার মস্তিষ্ক থেকে। এখন বুঝতে পারি এভাবে রাতের প্রথম প্রহরে শহিদ দিবসের অনুষ্ঠান শুরু না করে আগের মতো কাকডাকা ভোরে নগ্ন পদে প্রভাতফেরি শুরু করাই শ্রেয়।

১৯৫২-এর পর অনেক রাজনৈতিক আন্দোলন হয়েছে। এসব আন্দোলনে অনেকে শহিদ হয়েছেন। তা সত্ত্বেও এসব ঘটনার দিনগুলো ২১ ফেব্রুয়ারির তুলনায় অনেকটাই ম্লান বোধ হয়। শহিদ দিবস আমাদের হৃদয়ের তন্ত্রীতে যে রকম অনুভূতির সৃষ্টি করে, তা অন্য কোনো দিবসে এমনভাবে অনুভূত হয় না। সেই অনুভূতির বাঁধভাঙা অনুরণন ঘটেছে কবি আল মাহমুদের ‘একুশের কবিতা’য়। এ কবিতাটি পাঠকের দৃষ্টিতে স্থাপন করতে নিম্নে উদ্ধৃত করছি :

‘ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখ

দুপুর বেলার অক্ত

বৃষ্টি নামে, বৃষ্টি কোথায়?

বরকতের রক্ত।

হাজার যুগের সূর্যতাপে

জ্বলবে এমন লাল যে,

সেই লোহিতেই লাল হয়েছে

কৃষ্ণচূড়ার ডাল যে!

প্রভাতফেরীর মিছিল যাবে

ছড়াও ফুলের বন্যা

বিষাদ গীতি গাইছে পথে

তিতুমীরের কন্যা।

চিনতে নাকি সোনার ছেলে

ক্ষুদিরামকে চিনতে?

রুদ্ধশ্বাসে প্রাণ দিলো যে

মুক্ত বাতাস কিনতে?

পাহাড়তলীর মরণ চূড়ায়

ঝাঁপ দিল যে অগ্নি,

ফেব্রুয়ারির শোকের বসন

পরলো তারই ভগ্নী।

প্রভাতফেরী, প্রভাতফেরী

আমায় নেবে সঙ্গে,

বাংলা আমার বচন, আমি

জন্মেছি এই বঙ্গে।’

ড. মাহবুব উল্লাহ : শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম