‘ক্রলিং পেগ’ পদ্ধতিতে ডলার সংকট কাটবে কি?
এম এ খালেক
প্রকাশ: ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
দেশের অর্থনীতিতে বেশকিছু জটিল সমস্যা জেঁকে বসেছে। এ সমস্যাগুলো একদিনে বা হঠাৎ করেই সৃষ্টি হয়নি। অনেক দিন ধরে তিলে তিলে সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু যথাযথ কর্তৃপক্ষ সময়মতো উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় সমস্যাগুলো এখন কার্যত নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। অর্থনীতির বিকাশের জন্য এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসাবে দেখা দিয়েছে উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে এনে সাধারণ মানুষের জন্য একটি সহনীয় পরিবেশ তৈরি করা।
দ্বিতীয়ত, বৈদেশিক মুদ্রা, বিশেষ করে মার্কিন ডলারের জোগান বাড়ানোর ব্যবস্থা করা। বর্তমানে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ যে অবস্থায় আছে, তা যে কোনো সময় বিপদের কারণ হতে পারে। তাই এ মুহূর্তে ডলারের জোগান বাড়ানোর মাধ্যমে রিজার্ভের স্ফীতি উচ্চতর পর্যায়ে নিয়ে যাওয়াটা একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিয়েছে।
বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি প্রধান বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে, কী করে ডলারের বিনিময় মূল্যের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা কমিয়ে আনা যায়। চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের জন্য যে মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হয়েছে, সেখানেও বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখা এবং রিজার্ভ বাড়ানোর ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে বাজারে ডলারের একাধিক বিনিময় হার চালু আছে, যা মোটেও কাম্য ছিল না।
বাংলাদেশ ব্যাংক অনেকদিন ধরেই কৃত্রিমভাবে ডলারের বিনিময় হার নিয়ন্ত্রণ করে আসছিল। মুক্তবাজার অর্থনীতিতে সরকার বা অন্য কোনো কর্তৃপক্ষ বাজারের ওপর সরাসরি বা পরোক্ষভাবে কোনো নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে পারে না। শুধু অস্বাভাবিক কোনো পরিস্থিতির সৃষ্টি হলেই সরকার বাজারের ওপর হস্তক্ষেপ করতে পারে। কিন্তু শুরু থেকেই বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের বিনিময় হার পরোক্ষভাবে হলেও নিয়ন্ত্রণ করে আসছিল।
অর্থনীতিবিদ ও বাজারসংশ্লিষ্টরা বারবার বলে আসছেন ডলারের বিনিময় হারকে বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার জন্য। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক এখনো সে পথে আসেনি। বাংলাদেশ ব্যাংক নানাভাবে স্থানীয় মুদ্রা টাকাকে অতিমূল্যায়িত করে রেখেছে। টাকার বিনিময় হার অতিমূল্যায়িত করে রাখার ফলে স্থানীয় মুদ্রার প্রকৃত বিনিময় হার অনুধাবন করা কঠিন ছিল। ডলারের বিপরীতে স্থানীয় মুদ্রা টাকার অতিমূল্যায়ন বা অবমূল্যায়ন কোনোটিই কাম্য নয়। বরং ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় হার কত হবে, তা বাজারেরই নির্ধারণ করা উচিত।
সর্বশেষ মুদ্রানীতিতে ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় হার নির্ধারণের ক্ষেত্রে ‘ক্রলিং পেগ’ নামে এক নতুন পদ্ধতি প্রয়োগের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ‘ক্রলিং পেগ’ পদ্ধতি বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে সম্পূর্ণ নতুন একটি ধারণা, যদিও কোনো কোনো দেশে এ পদ্ধতি চালু আছে এবং তারা বেশ সফলতার সঙ্গে এ পদ্ধতি প্রয়োগ করতে সমর্থ হয়েছে বলে দাবি করা হয়।
অনেকেই মনে করছেন, ‘ক্রলিং পেগ’ পদ্ধতির মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংক আসলে মুদ্রার বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার পথে এক ধাপ এগিয়ে যেতে চাচ্ছে। ‘ক্রলিং পেগ’ পদ্ধতি হচ্ছে এ রকম : এ ব্যবস্থায় ডলারের বিপরীতে স্থানীয় মুদ্রা টাকার বিনিময় হার নির্ধারণের ক্ষেত্রে একটি করিডর সৃষ্টি করা হবে। সেই করিডরের ভেতরে থেকে ব্যাংক ও মানি চেঞ্জার কোম্পানিগুলোকে ডলারের বিনিময় হার নির্ধারণ করতে হবে। যেমন, বাংলাদেশ ব্যাংক নির্ধারণ করে দিল প্রতি ডলারের বিনিময় হার হবে ১১২ থেকে ১১৫ টাকা।
ব্যাংকগুলো তাদের সুবিধামতো ১১২ থেকে ১১৫ টাকায় প্রতি ডলারের বিনিময় হার নির্ধারণ করতে পারবে। ব্যাংকগুলো ডলারের বিনিময় হার নির্ধারণের ক্ষেত্রে এর বাইরে যেতে পারবে না। প্রশিক্ষিত ‘উদবিড়ালে’র গলায় রশি বেঁধে নদীতে মাছ ধরার জন্য ছেড়ে দেওয়া হলে সে অবস্থায় উদবিড়ালের পক্ষে মালিকের হাত থেকে ছুটে যাওয়ার কোনো সুযোগ থাকে না যেমন, ‘ক্রলিং পেগ’ ব্যবস্থা ঠিক তেমনই। বাংলাদেশ ব্যাংক শিডিউল ব্যাংকের জন্য ডলারের বিনিময় হার প্রত্যক্ষভাবে নির্ধারণ করে দেবে না। এর মানে এ নয় যে, ব্যাংকগুলো চাইলেই তাদের ইচ্ছামতো ডলারের বিনিময় হার নির্ধারণ করতে পারবে।
কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক যত চেষ্টাই করুক না কেন, বিদ্যমান অবস্থায় ডলারের বিনিময় হার বাজারভিত্তিক না করলে কোনোভাবেই বাজারে ডলারের মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে স্থিতিশীলতা সৃষ্টি করতে পারবে না। বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করতে চাচ্ছে না মূলত কয়েকটি কারণে। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কারণ হচ্ছে আমদানি পণ্যের মূল্য ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা।
বাংলাদেশ ব্যাংক যদি এ মুহূর্তে ডলারের বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করে, তাহলে ডলারের বিপরীতে টাকা যে অতিমূল্যায়িত হয়ে আছে তা কমে আসবে। বৈধ চ্যানেলে বর্তমানে প্রতি ডলার যে মূল্যে বিক্রি হচ্ছে, ডলারের মূল্য বা বিনিময় হার তার চেয়ে অন্তত ১২ থেকে ১৪ টাকা বৃদ্ধি পাবে। ডলারের বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করা হলেও আমদানি ব্যয় অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাবে-এ ধারণা সর্বাংশে সত্য নয়। কারণ, বর্তমানে আমদানিকারকদের অনেকেই ব্যাংকিং চ্যানেল থেকে চাহিদামতো ডলার কিনতে না পেরে কার্ব মার্কেট থেকে উচ্চমূল্যে ডলার সংগ্রহ করে তাদের চাহিদা পূরণ করছেন।
কাজেই ডলারের বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করা হলেই যে বাজারে পণ্যমূল্য অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাবে, তা নাও হতে পারে। যদি ডলারের উচ্চ বিনিময় হারের কারণেই স্থানীয় বাজারে পণ্যমূল্য বৃদ্ধি পায়, তাহলে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত পণ্যের মূল্য কেন বাড়ছে? স্থানীয় বাজারে বিভিন্ন পণ্যের মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বাড়ার পেছনে আমদানি ব্যয় বৃদ্ধিই একমাত্র কারণ নয়। এজন্য বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের ব্যর্থতাই বেশি দায়ী।
বাংলাদেশের মানুষ প্রতিবছর যে পরিমাণ পণ্য ভোগ করে, এর মাত্র ২৫ শতাংশ আমদানি করতে হয়। অবশিষ্ট ৭৫ শতাংশ পণ্য স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত এবং বাজারজাত করা হয়। তাহলে এসব পণ্যের মূল্য যখনতখন বাড়ে কেন?
টাকার বিপরীতে ডলারের বিনিময় হার কমানোর জন্য সবার আগে প্রয়োজন বাজারে ডলারের জোগান বাড়ানোর ব্যবস্থা করা। প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশ ব্যাংক বা সরকার কি চাইলেই বাজারে ডলারের জোগান বাড়াতে পারবে? বাজারে ডলারের জোগান বাড়নোর জন্য স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।
এবার আলোচনা করা যেতে পারে কোন কোন খাত থেকে ডলারের জোগান বাড়ানো যেতে পারে। প্রথমেই আসা যাক রপ্তানি আয় প্রসঙ্গে। দেশের বৈদেশিক মুদ্রার একক বৃহত্তম খাত হচ্ছে পণ্য রপ্তানি। গত অর্থবছরে বাংলাদেশ প্রথমবার ৫০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি আয় করেছে এ খাত থেকে। এর মধ্যে তৈরি পোশাকসামগ্রী রপ্তানি করে অর্জিত হয়েছে ৪২ বিলিয়ন ডলারের মতো।
এ খাতটি আমদানিনির্ভর বিধায় জাতীয় অর্থনীতিতে এর মূল্য সংযোজনের হার তুলনামূলকভাবে কম। এ খাত থেকে যে অর্থ আয় হয়, তার ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশই কাঁচামাল, ক্যাপিটাল মেশিনারিজ এবং মধ্যবর্তী পণ্য আমদানিতে পুনরায় বিদেশে চলে যায়। এছাড়া তৈরি পোশাক শিল্পে যেসব বিদেশি বিশেষজ্ঞ কাজ করেন, তারা প্রতিবছর ৬ বিলিয়ন থেকে ৭ বিলিয়ন ডলার নিয়ে যাচ্ছেন বেতন-ভাতা বাবদ। একশ্রেণির উদ্যোক্তার মনে বদ্ধমূল ধারণা সৃষ্টি হয়েছে যে, স্থানীয় বিশেষজ্ঞ দিয়ে বিদেশিদের মতো কাজ করানো যাবে না।
অথচ বাংলাদেশের প্রকৌশলী এবং অন্যান্য বিশেষজ্ঞ কর্মীরা বিদেশে গিয়ে সুনামের সঙ্গে কাজ করছেন। আমাদের দেশের উদ্যোক্তাদের মধ্যে দক্ষ লোকবল তৈরির চেয়ে দক্ষ জনশক্তি আমদানির প্রতি বেশি ঝোঁক লক্ষ করা যায়। গত বছর তৈরি পোশাক খাতে ৪২ বিলিয়ন ডলার আয় হলেও এর মধ্যে খুব বেশি হলে ২৫/২৬ বিলিয়ন ডলার জাতীয় অর্থনীতিতে মূল্য সংযোজন করেছে। স্থানীয়ভাবে প্রশিক্ষিত জনবল তৈরি করা গেলে এবং সম্ভাব্য ক্ষেত্রে কাঁচামাল স্থানীয়ভাবে উৎপাদন করা হলে এ খাতে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রার প্রায় পুরোটাই জাতীয় অর্থনীতিতে মূল্য সংযোজন করতে পারত।
দীর্ঘ মেয়াদে এ সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংক অপ্রয়োজনীয় ও বিলাসজাত পণ্য আমদানি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে। যেহেতু বর্তমানে দেশের অর্থনীতিতে বৈদেশিক মুদ্রার সংকট চলছে, তাই বাংলাদেশ ব্যাংক বিলাসজাত ১২২টি পণ্যের একটি তালিকা প্রণয়ন করে এসব পণ্য আমদানিকে নিরুৎসাহিত করে। এর উদ্দেশ্য ছিল লেনদেনের ভারসাম্যকে অনুকূল অবস্থায় নিয়ে আসা। দেখা গেল, আমদানি ব্যয় অনেকটাই কমে এসেছে।
এসব ব্যবস্থা গ্রহণ করা সত্ত্বেও উচ্চ মূল্যস্ফীতি কিন্তু তেমন একটা নিয়ন্ত্রণে আসেনি। ঢালাওভাবে পণ্য আমদানি কমানোর ফল উলটোও হতে পারে। বাংলাদেশ এখনো শিল্পের কাঁচামাল, ক্যাপিটাল মেশিনারিজ আমদানির ওপর নির্ভরশীল। এসব পণ্যের আমদানি কমে গেলে উৎপাদন কমবে। এতে কর্মসংস্থানের সুযোগ কমে যাবে। জুলাই-নভেম্বর সময়ে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ঋণপত্র খোলার হার কমেছে ভোগ্যপণ্যে ২৭ দশমিক ৪৭ শতাংশ, মূলধনি যন্ত্রপাতিতে ১৬ দশমিক ৯৮ শতাংশ, কাঁচামালে ১১ দশমিক ৬২ শতাংশ, জ্বালানিতে ১৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ।
আমাদের রপ্তানি বাণিজ্যকে পরিকল্পিতভাবে ঢেলে সাজানো দরকার। যাতে এ খাতের সম্ভাবনাকে পরিপূর্ণভাবে কাজে লাগানো যায়। দেশে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সবচেয়ে সম্ভাবনাময় খাত হচ্ছে জনশক্তি রপ্তানি। এ খাতে যে অর্থ আয় হয় তার প্রায় শতভাগই জাতীয় অর্থনীতিতে মূল্য সংযোজন করে। এছাড়া প্রায় দেড় কোটি মানুষের বিদেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করেছে এ খাত। কিন্তু এ খাতটি সম্পূর্ণ অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠছে। গত বছর ১৩ লাখ বাংলাদেশি বিদেশে গিয়েছে কর্মসংস্থানের জন্য। কিন্তু বাংলাদেশ জনশক্তি রপ্তানি খাতে আয় করেছে ২৩ বিলিয়ন ডলার।
তাহলে বাংলাদেশিরা কি পর্যাপ্ত পরিমাণে অর্থ দেশে প্রেরণ করেনি? তারা অবশ্যই দেশে অর্থ পাঠিয়েছে। কিন্তু তা বৈধ চ্যানেলের পরিবর্তে হুন্ডির মাধ্যমে পাঠিয়েছে। ব্যাংকিং চ্যানেলের তুলনায় হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ দেশে প্রেরণ করা হলে প্রতি ডলারে গড়ে ১২/১৪ টাকা বেশি পাওয়া যায়। মুখের কথায় এ সমস্যার সমাধান হবে না। এজন্য ডলারের বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার পাশাপাশি প্রবাসী আয়ের ওপর দেওয়া নগদ আর্থিক প্রণোদনা বহাল রাখা যেতে পারে। তাহলে প্রবাসী বাংলাদেশিরা বৈধ চ্যানেলে অর্থ দেশে প্রেরণে আগ্রহী হয়ে উঠতে পারে।
এম এ খালেক : অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল ম্যানেজার, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক, অর্থনীতিবিষয়ক লেখক