Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

শতফুল ফুটতে দাও

এ বর্বরতার শেষ কোথায়?

Icon

ড. মাহবুব উল্লাহ্

প্রকাশ: ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

এ বর্বরতার শেষ কোথায়?

বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছি এমন পরিচয় দিতে লজ্জাবোধ করি। যতই দিন যাচ্ছে, ততই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছে। পাকিস্তান আমলে কনভেনশন মুসলিম লীগ সমর্থিত ছাত্রসংগঠন জাতীয় ছাত্র ফেডারেশন (এনএসএফ) বিশ্ববিদ্যালয়ে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল। এনএসএফের গুন্ডা বাহিনী অন্যান্য ছাত্রসংগঠনের সমর্থক ও কর্মীদের ওপর মারধরের জঘন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল। আমি আমার আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘আমার জীবন আমার সংগ্রামে’ এনএসএফের গুন্ডামি ও ত্রাস সৃষ্টি সম্পর্কে কিছু বর্ণনা করেছি। এনএসএফদের টার্গেট ছিল বামপন্থি ছাত্রসংগঠন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী ও সমর্থকরা। তারা প্রতিপক্ষ ছাত্রসংগঠনের সমর্থক ও কর্মীদের মারধর করেছে, তাদের বইপত্র, বিছানা-বালিশ আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে। ভয়-ডর সৃষ্টি করেছে। কিন্তু তারা ধর্ষণের মতো গর্হিত অপরাধ করেনি। তারা ভিন্ন ছাত্রসংগঠনের কর্মীদের অপমান করার উদ্দেশ্যে থুতু ফেলে তা চেটে তোলার জন্য কখনো কখনো তাদের বাধ্য করেছে। এনএসএফের এসব গর্হিত কার্যকলাপ সাধারণ ছাত্রদের সরকারবিরোধী হতে প্রভাবিত করেছে। মাঝে মাঝে মনে হয় ষাটের দশকে যেভাবে ছাত্র ও তরুণরা স্বাধীন বাংলার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল, তার জন্য এনএসএফের অত্যাচার ও নির্যাতন নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ অনুঘটকের ভূমিকা পালন করেছে। এনএসএফের হাতে নির্যাতনের অভিজ্ঞতা শেষ বিচারে ছাত্র ও তরুণদের আইয়ুববিরোধী এবং তারই ফলে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে দ্রোহী করে তুলেছিল।

ভেবেছিলাম বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর পরিস্থিতির আমূল পরিবর্তন ঘটবে। আমাদের সেই প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। পরিস্থিতির আরও বিশাল অবনতি ঘটেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাত খুনের মতো ঘটনা ঘটেছে, ডাকসু নির্বাচনে সরকারসমর্থক নয়, এমন ছাত্রসংগঠনের বিজয় অনিবার্য দেখে ব্যালট বাক্স হাইজ্যাক হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো কোনো শিক্ষক ছাত্রলীগ নামধারীদের হাতে আপমানিত হয়েছেন। সাত খুন ছাড়াও খুন-খারাবির আরও ঘটনা ঘটেছে। গেস্টরুমভিত্তিক অত্যাচারের ধারাবাহিকতায় একজন ছাত্রকে শীতের রাতে খোলা আকাশের নিচে দাঁড় করিয়ে মারধর করা হয়েছে। এ ছাত্রটি মারধর ও শীতের ঠান্ডায় নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছে। এখন সরকারসমর্থিত ছাত্রসংগঠন নিরীহ ছাত্রদের তাদের আয়োজিত মিছিল-মিটিংয়ে যোগ দিতে বাধ্য করে। বুয়েটের ছাত্র আবরার ফাহাদকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। আবরার ফাহাদ কোনো ছাত্রসংগঠনের কর্মী ছিল না। তার অপরাধ দেশকে ভালোবেসে সে অভিন্ন নদীর পানির ওপর বাংলাদেশের ন্যায্য অধিকারের দাবি জানিয়ে ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছিল। এটাই তার ‘অপরাধ’। পরে আবরার ফাহাদের ‘হত্যাকারী’দের বিরুদ্ধে মামলা হয় এবং বিচারের একপর্যায়ে আদালত তাদের শাস্তি প্রদান করেন।

এ ধরনের ঘটনা নিঃসন্দেহে একটি মহা উদ্বেগের ব্যাপার। কিন্তু এর চেয়েও বড় উদ্বেগের ব্যাপার হলো, দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে এমন কিছু ছাত্র রয়েছে, যাদের চিন্তাভাবনা মাতৃভূমিকে হত্যা করার সমতুল্য। আমরা জানি, বুয়েটে যারা ছাত্র হওয়ার সুযোগ পায় তারা অনেক মেধাবী। এ মেধাবীদের একটি অংশ কীভাবে জাতীয় স্বার্থের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারে, তা বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ভাবিয়ে তোলে। তবে সৌভাগ্যের বিষয় বুয়েটের সাধারণ ছাত্ররা ফাহাদ হত্যার তীব্র প্রতিবাদ করেছে। ন্যায় প্রতিষ্ঠার দাবিতে সংগ্রামী মিছিল-সমাবেশ করেছে। সাধারণ ছাত্রদের দাবির মুখে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কিছু পদক্ষেপ গ্রহণে বাধ্য হয়। কাহিনির বর্ণনা করতে গেলে আরও অনেক কিছু উল্লেখ করতে হয়।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এবং শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়সহ বাংলাদেশের আরও কিছু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অবাঞ্ছিত ঘটনা ঘটছে। এর ফলে শিক্ষার পরিবেশ চরমভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কেন পৃথিবীর এক হাজার বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে স্থান পাচ্ছে না, তার একটি বড় কারণ হলো, তথাকথিত রাজনীতির নামে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অস্থিরতা লেগেই আছে। এ রকম পরিস্থিতিতে জ্ঞান উৎপাদন এবং জ্ঞান বিতরণ প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠেছে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলে এক দম্পতিকে ডেকে এনে স্বামীকে আটকে রেখে স্ত্রীকে পালাক্রমে ধর্ষণের ঘটনার প্রতিবাদে ক্ষোভে ফুঁসে উঠেছে সারা দেশের শিক্ষাঙ্গন। বিক্ষোভ মিছিল হয়েছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। প্রতিবাদ জানিয়েছে নাগরিকসহ বিভিন্ন ছাত্রসংগঠন। কোথাও কোথাও আয়োজিত বিক্ষোভে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে বাধা দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। প্রতিবাদ কর্মসূচিতে অবিলম্বে মূল হোতা পলাতক মামুনকে গ্রেফতার করে শাস্তির আওতায় আনার দাবি জানানো হয়।

ওই ঘটনায় জড়িত অভিযোগে ছাত্রলীগ নেতা মোস্তাফিজুর রহমানসহ ছয় শিক্ষার্থীর সনদ স্থগিত করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট। সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ধর্ষণের ঘটনায় অভিযুক্ত আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষার্থী মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমানকে ক্যাম্পাসে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়েছে এবং তার সনদ স্থগিত করা হয়েছে। তাকে সহযোগিতাকারী একই বিভাগের শিক্ষার্থী মোহাম্মদ মুরাদ হোসেনকে সাময়িক বহিষ্কার ও তার সনদ স্থগিত করা হয়েছে। তাকেও ক্যাম্পাসে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়েছে। অভিযুক্তকে পালাতে সহায়তা করার নির্দেশদাতা একই বিভাগের শিক্ষার্থী শাহ পরানের সনদ স্থগিত করা হয়েছে। পালাতে সহায়তা করায় উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের মোহাম্মদ সাব্বির হাসান সাগর, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের এএসএম মোস্তফা মনোয়ার সিদ্দীকী ও হাসানুজ্জামানকে সাময়িক বহিষ্কার এবং তাদের সনদ স্থগিত করা হয়। একইসঙ্গে তাদের তিনজনকে ক্যাম্পাসে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছে প্রশাসন। এছাড়া ধর্ষণ ও এতে সহযোগিতায় অভিযুক্ত বহিরাগত মামুনসহ অভিযুক্ত সবার বিরুদ্ধে দেশের প্রচলিত আইনে মামলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে প্রশাসন। এর পাশাপাশি ক্যাম্পাসে শিক্ষার পরিবেশকে উন্নত করার জন্য কিছু প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ দ্রুতগতিতে দুর্ভাগ্যজনক এ ঘটনায় দোষীদের শাস্তি প্রদান ও আইনের অধীনে পদক্ষেপ গ্রহণ করার জন্য প্রশংসা পেতে পারে। তবে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ ছাত্রছাত্রী এবং কিছু শিক্ষক বিক্ষোভে ফুঁসে না উঠলে এসব পদক্ষেপ নেওয়া হতো কিনা তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। একটি দৈনিকের সম্পাদকীয়তে লেখা হয়েছে, এই ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যে ছয়জনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে, তাদের মধ্যে তিনজনই ছাত্রলীগ নেতাকর্মী। মোস্তাফিজ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের উপ-আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক, শাহ পরান সহসভাপতি, মুরাদ হোসেন সহসম্পাদক ও সাব্বির হাসান কার্যকরী সদস্য। তারা সবাই বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি আক্তারুজ্জামান সোহেলের অনুসারী ও মীর মশাররফ হোসেন হলের বর্তমান ও সাবেক আবাসিক শিক্ষার্থী। তাদের কারও কারও ছাত্রত্ব অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে। এদিকে ধর্ষণের ঘটনায় গ্রেফতার ছাত্রলীগ নেতা মোস্তাফিজুর রহমানসহ চারজনকে ৩ দিন রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দিয়েছেন আদালত। ঢাকার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট (সিজেএম) আদালতের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট রাবেয়া বেগম রোববার এ আদেশ দেন। একই সম্পাদকীয় থেকে আমরা জানতে পারি, অতীতেও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। সেখানে এক ছাত্রলীগ নেতা ধর্ষণে সেঞ্চুরি করার দাবির পরও তাকে আইনের আওতায় আনা হয়নি, বরং প্রভাবশালী ব্যক্তিরা তাকে বিদেশে যাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। সে সময় বিশ্ববিদ্যালয়ে যে শিক্ষার্থীরা ধর্ষণবিরোধী আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন, তারা নানাভাবে নাজেহাল হয়েছিলেন।

একটি সমাজে মানুষ অপরাধ থেকে নিজেদের অপরাধ সংগঠন থেকে দূরে থাকে সামাজিক নিয়ন্ত্রণের ফলে। এ সামাজিক নিয়ন্ত্রণ উৎসারিত হয় সমাজের মূল্যবোধ থেকে। সমাজে এ মূল্যবোধগুলো গড়ে ওঠে দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। এসব মূল্যবোধ বলে দেয় কী করা যাবে এবং কী করা যাবে না। সমাজে অনেকটা স্বয়ংক্রিয়ভাবে সামাজিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়। এর ফলেই আইন মান্যকারী মানুষের সৃষ্টি হয়। সমাজে বেশিরভাগ মানুষ সমাজ নির্ধারিত মূল্যবোধের প্রতি অনুগত থাকে। সামাজিক মূল্যবোধ গড়ে ওঠার জন্য যেসব প্রতিষ্ঠান অবদান রাখে, তার মধ্যে আছে পরিবার, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এছাড়া জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তি এবং সৎ সমাজপতিরাও মূল্যবোধ সৃষ্টি এবং তা প্রতিপালনে বড় ভূমিকা পালন করেন। সামাজিক নিয়ন্ত্রণ না থাকলে শুধু রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে সমাজবিরোধী কর্মকাণ্ড দমন করা সম্ভব হতো না। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সমাজের সর্বোচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। স্বাভাবিকভাবে এ প্রতিষ্ঠানগুলো ন্যায্যতা ও সুনীতিকে মানবিক মূল্যবোধের অবিচ্ছেদ্য বিষয় হিসাবে রক্ষার জন্য উত্তরোত্তর উন্নততর পরিবেশ সৃষ্টিতে জ্ঞানচর্চার পাশাপাশি সক্রিয় থাকবে, এমনটাই কাম্য। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘটিত চরম বর্বর অপরাধের নিন্দা করার ভাষা আমার জানা নেই। দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে নারীর ইজ্জতের আব্রু রক্ষিত না হলে সভ্যতার মাপকাঠিতে আমরা অসভ্য মানুষ হিসাবে চিহ্নিত হওয়ার ঝুঁকিতে থেকে যাব।

ড. মাহবুব উল্লাহ : শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম