কারা ওদের বখাটে বানাল?
![Icon](https://cdn.jugantor.com/uploads/settings/icon_2.jpg)
এ কে এম শাহনাওয়াজ
প্রকাশ: ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
![কারা ওদের বখাটে বানাল?](https://cdn.jugantor.com/assets/news_photos/2024/02/06/image-771258-1707178488.jpg)
ফাইল ছবি
রোববার ৪ ডিসেম্বর সকালে বিভাগে যেতেই মাস্টার্সের সিআর ছাত্রটি আমার কক্ষে এলো। ওদের এখন একটি টিউটোরিয়াল পরীক্ষা নেওয়ার কথা। ও বিনয়ের সঙ্গে জানাল, কাল রাতে একটি অঘটন ঘটেছে। উত্তপ্ত অবস্থায় আছে অনেক শিক্ষার্থী। রাতভর ওরা মীর মশাররফ হোসেন হল ঘিরে রেখেছিল। আমাদের ক্লাসের অনেক বন্ধু আবেদন জানিয়েছে ওদের পক্ষে পরীক্ষা দেওয়াটা কঠিন হবে। আমি যেন তারিখ পিছিয়ে দেই। আমি ঘটনাটি জানতে চাইলাম।
বলল, একজন বর্তমান, আরেকজন সাবেক ছাত্র কয়েক বন্ধুর সহায়তায় এক ভদ্রলোককে হলের কক্ষে আটকে রেখে তার স্ত্রীকে ধর্ষণ করেছে। শুনে স্তব্ধ হয়ে গেলাম। সচেতনভাবে নয়-স্বয়ংক্রিয়ভাবে আমার মুখ থেকে বেরিয়ে এলো, ‘এই বখাটেরা ছাত্রলীগের নয় তো!’
ছাত্রটি মাথা চুলকে বলল-জি স্যার। এদেশের সব ক্যাম্পাসবাসীই জানেন, ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র নেতাকর্মীরাই এখন সব অনাচারের নায়ক। ১৯৯০-এর পর থেকে ছাত্ররাজনীতির অগ্যস্তযাত্রা হয়ে গেছে। ক্যাম্পাসগুলোতে এখন দাপুটে থাকে সরকারি দলের ছাত্ররা। এরা ছাত্র কল্যাণমূলক কোনো কাজে যুক্ত থাকে না। সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডেও এদের সম্পৃক্ততা নেই। এরা সাধারণ শিক্ষার্থীর বন্ধু হওয়ার চেয়ে প্রভু হতে পছন্দ করে। তাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ নির্মাণ কাজের ঠিকাদারদের। কর্মচারী থেকে শিক্ষক নিয়োগে বাণিজ্যিক হাত বাড়ানো আর প্রশাসনে তাদের খবরদারির বলয় শক্ত রাখা যেন অধিকার। এরপর তাদের বড় কাজ ক্যাম্পাসের বাইরে স্থানীয়, আঞ্চলিক ও জাতীয় নেতাদের হুকুম পালন করা। বখরাভাগ যথা জায়গায় পৌঁছে দেওয়া।
এভাবে এসব ছাত্রের মধ্য থেকে বখাটে জন্ম নিতে থাকে। এরা বরাবরই অনিয়ন্ত্রিত। এ কারণে ছাত্র নামধারী বখাটেদের দ্বারা কোনো অঘটন ঘটলেই প্রথম সরকারি দলের ছাত্রদের কথাই মাথায় আসে। কারণ প্রতাপশালী ছাড়া অঘটন ঘটানোর সাহস করবে কারা! এ দেশে এখন ছাত্রলীগের সুনাম করেন শুধু আওয়ামী লীগের নেতারা। তারা এসব অপকর্মের খবর রাখেন না, তা বিশ্বাস করা কঠিন। কিন্তু শাসন করেন না। উৎসাহ দেন কিনা জানি না।
বিএনপির আমলে ছাত্রদল, জাতীয় পার্টির আমলে ছাত্রসমাজ ও আওয়ামী লীগ আমলে ছাত্রলীগ একই মঞ্চে পোশাক পালটে পালটে অভিনয় করছে যেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বলে এ কাদা কোনো না কোনোভাবে আমারও গায়ে লাগে। সাধারণ মানুষ তো ভেতরের অতশত বোঝেন না।
তারা বলবেন ছাত্ররা এত বড় জঘন্য অন্যায় করছে, তাহলে আপনারা থামাচ্ছেন না কেন? জনে জনে কী বোঝাতে পারি, রিমোট কন্ট্রোল নিয়ে বসে আছেন মূল দলের নেতারা। তারা মনে করেন নিজেদের নিরাপদ রাখতে ক্যাম্পাসে দলীয় লাঠিয়াল পোষা দরকার। এভাবে একদা মেধার প্রতিযোগিতায় যোগ্য ছাত্ররা ভদ্র-সম্ভ্রান্ত পরিবার থেকে এসে দানবের জাদুরকাঠিতে বখাটে হয়ে পড়ে। পরিণতিতে নিজে ডুবে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শিক্ষক আর পরিবারকে ডোবায়।
ধর্ষক ছেলেটির ছবি ছাপা হয়েছে বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে। থানার সামনে ধর্ষক ও তার সহযোগীদের হাতকড়া পরা ছবিও ছাপা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকাতে এদের বেশিদিন বাকি ছিল না। একজন পাশ করে বেরিয়ে গেছে। প্রশাসনের দুর্বলতায় এরা বহিরাগত হয়েও হলে থাকতে পারে। পরিবারের কত আশা, পেশা জীবনে সফল হয়ে তাদের সন্তান সমাজে প্রতিষ্ঠিত হবে। গৌরবময় কৃতিত্বের জন্য পত্রিকায় ছবি ছাপা হবে। উজ্জ্বল হবে পরিবারের মুখ। তার বদলে ছবি ছাপা হলো ধর্ষক পরিচয়ে।
কিন্তু আমি আমার এ ছাত্রদের কতটুকু দায়ী করব? ওরা তো বখাটে হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করেনি। আর দশটি বন্ধুর মতো অনেক বড় স্বপ্ন নিয়ে পা রেখেছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে। তারপর স্খলন ঘটল কেন? ওর আর দশটি সাধারণ ছাত্রবন্ধুর নাম তো উঠে আসে না অনাচার অঘটনে। খারাপ কিছু ঘটলে ছাত্রলীগের নাম উঠে আসে কেন? আরিচা রোডে বা ক্যাম্পাসে রাত-বিরাতে ছিনতাই হলেও অভিযুক্ত হয় ছাত্রলীগের কর্মী। কেন? হলে হলে সন্ত্রাসী হামলা, রুম দখল, রক্তারক্তি ইত্যাদি সব অঘটন হলেও সংবাদপত্রের শিরোনাম হয় ‘ছাত্রলীগের দুপক্ষের সংঘাত’। কেন?
আমি আমার এ ছাত্রদের বখাটে বানানোর জন্য দায়ী করব আওয়ামী লীগ নেতাদের। তারা তাদের রাজনৈতিক সুবিধার জন্য হাতে ধরে নষ্ট করছেন তরুণদের। এ অঘটনের দুদিন আগের কথা বলছি। ছাত্রলীগের অপেক্ষাকৃত নিরীহ কর্মীর কাছ থেকে জানলাম দুদিন ধরে ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক গ্রুপের মধ্যে উত্তেজনা চলছে। সব বিশ্ববিদ্যালয়েই এমন দুটি গ্রুপ জন্ম নেয় আজকাল। ক্ষমতা ও অর্থের ভাগাভাগি নিয়ে সব জায়গায় এমন দ্বন্দ্ব। তবে এবারের দ্বন্দ্বটি নাকি অন্য রকম।
সব ক্যাম্পাসে এটি এখন ওপেন সিক্রেট যে, ছাত্রলীগের বিশ্ববিদ্যালয় ও হল কমিটিতে পদ পেতে হলে বহু লাখ টাকা লেনদেন করতে হয় কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সঙ্গে। পদের গুরুত্ব অনুযায়ী টাকার অঙ্কের হেরফের হয়। কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ আবার এর থেকে বখরা ভাগ দেয় আরও উপরে। এসব রটনা সত্য কী মিথ্যা, তা ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের নেতারা ভালো বলতে পারবেন। আমি মনে করি, তাদের সবকিছু জাতির সামনে স্পষ্ট করা উচিত। এবার ক্যাম্পাসে উত্তেজনার পেছনের কারণ একটু অন্যরকম। আমার সোর্স একজন ছাত্রলীগ কর্মী। ওর বক্তব্য, সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের এমপিদের বলয়ের একটি নিয়ন্ত্রণ থাকে ছাত্রলীগের ওপর। এমপিদের আয়ের পথ নিষ্কণ্টক করেন ছাত্র নেতাকর্মীরা। আর এমপির লোকেরা খেয়াল রাখেন ছাত্রলীগের দিকে। কিন্তু এবার হঠাৎ পাশা উলটে গেছে সাভারে। ছাত্রলীগের সভাপতির মাধ্যমে বড় অঙ্কের লেনদেনের মাধ্যমে সাবেক এমপির সঙ্গে রফা হয়েছিল। কিন্তু নির্বাচনে জিতে যিনি এমপি হলেন, তার একটি ক্লিন ইমেজ রয়েছে। তার সঙ্গে যেহেতু কারও রফা ছিল না, তিনি এসব সিন্ডিকেট ভেঙে দেন। এখন অভিভাবক হারিয়ে হতাশ ছাত্রলীগের নেতারা। অর্থের বখরা হাতছাড়া হওয়ায় দুই পক্ষই এর-ওর ওপর দোষ চাপাচ্ছে। এমন একটি দ্বান্দ্বিক অবস্থার সময় আবার ধর্ষক হিসাবে অভিযুক্ত হলো ছাত্রলীগের পদাধিকারী নেতা।
এ সবকিছু দেখে সন্দেহ হয় আওয়ামী লীগ নেতারা দল ও দেশকে ভালোবাসেন কিনা। যদি বাসতেন, তাহলে তাদের পরিচর্যায় এবং শক্ত নৈতিক অবস্থানে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসা তরুণরা এভাবে নষ্ট হয়ে যেত না। এমন স্খলন একদিনে হয়নি। ক্যাম্পাসে নিজেদের শক্তির বলয় ধরে রাখার জন্য বিপথগামী করছেন তরুণদের। এক-এগারোর আগে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদলের সভাপতির রাজনীতি ও পেশিশক্তির সূত্রে পাওয়া গাড়ি, বাড়ি ও বিত্তের কাহিনি চাউর হয়। এক-এগারোর সময় তিনি পালিয়ে যান লন্ডনে।
এখন নাকি সেখানে বিএনপির পালানো নেতার সহযোগী হিসাবে কাজ করে যাচ্ছেন। প্রসঙ্গটি আনা হলো এজন্য যে, পটপরিবর্তনের পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ছাত্রলীগ নেতারাও আয়-রোজগার বাড়াতে লাগলেন। কিছু বললে উদাহরণ দিতেন ছাত্রদল নেতার। অর্থাৎ ও পারলে আমরা পারব না কেন?
সিন্দাবাদের বুড়োর গল্প তো আমরা জানি। একবার ঘাড়ে উঠলে নামানো কঠিন। নিজেদের রাজনৈতিক সুবিধার জন্য ছাত্রলীগকে ঘাড়ে উঠিয়েছেন আওয়ামী লীগ নেতারা। অন্যায়ের সীমা ছাড়ালেও শাসন করেননি। বর্তমানে রাজনৈতিক অস্থিরতার সময় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ নেতার অমার্জনীয় অপরাধ বিরোধী রাজনীতিকদের কাছে বিশেষ পুঁজি হতে পারে।
ইতোমধ্যে দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে এ ধর্ষণের ঘটনা। ডিজিটাল যুগ অতিক্রম করতেও সময় লাগবে না। নতুন আওয়ামী লীগ সরকারের চ্যালেঞ্জের অভাব নেই। সুশাসন প্রতিষ্ঠিত না থাকায় কোনো কিছুতেই নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে পারছে না। নানা হুমকি-ধমকি-জিরো টলারেন্স বলে বলেও দ্রব্যমূল্যের লাগাম টানতে পারছে না। সময়টাও খারাপ যাচ্ছে। বিশ্বজুড়েই সংকট চলছে। কিন্তু সংসার চালাতে হিমশিম খাওয়া মানুষ তা শুনবে কেন? নির্বাচন নিয়ে বৈশ্বিক রাজনীতির নানা টানাপোড়েন সামাল দিতে হচ্ছে আওয়ামী লীগ সরকারকে। বিএনপি ও সমমনাদের রাজনৈতিক কর্মসূচি মোকাবিলার চাপ তো রয়েছেই। এর মধ্যে ছাত্রলীগ নেতার ধর্ষণ ইস্যু সরকারের সামনে নতুন আরেকটি চাপ হয়ে দেখা দিচ্ছে।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তাৎক্ষণিক সিন্ডিকেট ডেকে তাদের ক্ষমতা অনুযায়ী শক্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ধর্ষণ ও ধর্ষণ সহযোগী অভিযুক্তরা ধরা পড়েছে। পুলিশ হেফাজতে আছে। এটি শেষ কথা হয়তো হবে না। ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা কোনো অঘটন ঘটানোর পর দল থেকে সাময়িক বা স্থায়ীভাবে বহিষ্কৃত হয়। কিন্তু এটির কোনো প্রভাব নেই ছাত্ররাজনীতির ওপর। এ প্রসঙ্গে ছাত্রদের মধ্যে একটা কথা প্রচলিত আছে। বহিষ্কার নাকি আপাতত আইওয়াশ। ওদের ভাষায় ‘সিস্টেম’ করে নাকি আবার ফিরে আসে।
আমরা চাইব না আমাদের ছাত্ররা আবারও কলঙ্কিত হোক। বহিষ্কৃত হয়ে ছাত্রজীবনকে ক্ষতিগ্রস্ত করুক। হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা বা পুতুল নাচের কুশীলব রাজনীতির নেতারা যদি শপথ নেন নিজ স্বার্থে ছাত্রদের নিয়ে আর এমন ভয়ংকর খেলা খেলবেন না, তবেই অভিশাপমুক্ত হওয়ার পথ তৈরি হতে পারে।
ছাত্রলীগের উজ্জ্বল ইতিহাস কি এখনকার ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা ধারণ করে? আমি সুযোগ পেলে ছাত্রলীগ করা নেতাদের প্রশ্ন করি, আওয়ামী লীগের জন্ম আগে, না ছাত্রলীগের? প্রায়ই ওরা ফেল করে। ওদের অধিকাংশ ছাত্রলীগকে আওয়ামী লীগের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা ছাত্রসংগঠন মনে করে। ছাত্রলীগের মধ্যে কোনো পাঠচক্র চোখে পড়ে না। আমাদের নেতারা ওদের রাজনৈতিক দীক্ষায় প্রাজ্ঞ করার বদলে দখলবাজ বানাতে পছন্দ করেন।
এ অবস্থা থেকে বেরোতে হবে। ছাত্ররাজনীতিতে সুস্থ ধারা ফেরাতে হলে সবার আগে প্রয়োজন জাতীয় দলগুলোর রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে পৌঁছা। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দলীয় প্রশাসক বসিয়ে ক্যাম্পাসে সুন্দর স্বপ্ন বোনা সহজ হবে না। আমরা বিশ্বাস করতে চাই, আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো জাতির বৃহত্তর স্বার্থে ইতিবাচক দিকে ঘুরে দাঁড়াবে।
ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
shahnawaz7b@gmail.com