নতুন সরকারের সামনে যত চ্যালেঞ্জ
তৌহিদুল হাসান নিটোল
প্রকাশ: ২৬ জানুয়ারি ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
নির্বাচন শেষ হয়েছে। কিন্তু এ নির্বাচনের অসংগতি নিয়ে আলোচনা দেশি-বিদেশি রাজনীতির ময়দানে রয়েই যাবে। নির্বাচন শেষ হলেও বাংলাদেশ নিয়ে, বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে ভূ-রাজনৈতিক তৎপরতা বন্ধ হবে না। কূটনৈতিক তৎপরতাও বন্ধ হবে না। ফলে শেখ হাসিনার নতুন সরকারের সামনে নানা চ্যালেঞ্জ রয়েছে। আজকের লেখায় সব চ্যালেঞ্জ নিয়ে আলোচনা করা যাবে না, প্রধান দু-তিনটি নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে।
বর্তমান সরকারের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ বা সংকট হলো দেশে-বিদেশে এ নির্বাচনের বৈধতার সংকট মোকাবিলা করা। একই সংকট ২০১৪ সালের নির্বাচনের পরও ছিল। সরকার সে মেয়াদ সফলভাবেই শেষ করেছে। এবারের নির্বাচনে আমেরিকাসহ বিদেশি কিছু রাষ্ট্র বা জোটের কূটনৈতিক তৎপরতা ছিল নজিরবিহীন। সরকারবিরোধী পক্ষ দেশে-বিদেশে বাংলাদেশে একদলীয় শাসনব্যবস্থা কায়েম হয়েছে বলে প্রচার চালিয়েছে। বাংলাদেশ বহুদলীয় গণতন্ত্রের চর্চার দেশ। এদেশের সংবিধান মতে বহুদলীয় মত-পথ নিয়েই এ রাজনীতি চলমান থাকার কথা; কিন্তু সেখানে ফাটল রয়েছে। বর্তমান সংসদে প্রকৃত সরকারবিরোধী দল বা জোট নেই। এ সংসদ নিয়ে আইনগতভাবে বৈধতার প্রশ্ন না থাকলেও নৈতিকতার প্রশ্ন আছে। দেশের বেশিরভাগ মানুষ এ নির্বাচনের ভোটে অংশ নেয়নি। নির্বাচন কমিশন বলেছে, এবারের নির্বাচনে ভোট পড়েছে ৪১.৮ শতাংশ। আমরা একটু অতীতের দিকে তাকাই। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন থাকায় সেগুলো বাদ দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত ২০০৮ সালের নির্বাচনে ভোট পড়েছিল ৮৭ শতাংশ। এর আগে ২০০১ সালে ৭৫.৫৯ শতাংশ, ১৯৯৬ সালে ৭৫.৬০ শতাংশ এবং ১৯৯১ সালে ৭৪ শতাংশ। ফলে স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে, এবারের নির্বাচনে বর্জনকারী অংশটি ভোট দিতে আসেনি। নতুন সরকারের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো নির্বাচন বর্জনকারী অংশ এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে আস্থা ফিরিয়ে এনে সরকার পরিচালনা করা। তাদের সরকারের উন্নয়ন প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত করা। পাশাপাশি বিদেশি রাষ্ট্র, যারা এ সরকারের ব্যাপারে সমালোচনামুখর, তাদের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করা। আমরা চাই বা না চাই, দেশ রাজনৈতিকভাবে স্থিতিশীল না হলে বিদেশি রাষ্ট্রের কূটনৈতিক তৎপরতা চলতেই থাকবে।
শেখ হাসিনা বাংলাদেশের আমূল পরিবর্তন করেছেন। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রশংসা দেশে-বিদেশে সবাই করছে। তবে বেশকিছু মানবাধিকার সংস্থা বলছে, শেখ হাসিনা উন্নয়ন করেছেন ঠিকই, কিন্তু দেশ থেকে গণতন্ত্র নির্বাসনে পাঠিয়েছেন। গণতন্ত্রহীনতার এ ভাষ্য রাজনৈতিকভাবে মীমাংসা করা ছাড়া অন্য কোনো উপায় আছে কিনা আমার জানা নেই। একদলীয় শাসনব্যবস্থার তকমা থেকে বেরিয়ে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাওয়া বর্তমান সরকারের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
এরপরের চ্যালেঞ্জ অর্থনৈতিক। বাংলাদেশের অর্থনীতির সবচেয়ে ভালো সময় ছিল করোনাপূর্ব ২০১৬, ২০১৭, ২০১৮ ও ২০১৯-এ বছরগুলো। সে বছরগুলোতে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছিল গড়ে ৭ শতাংশের উপরে। ব্যবসা-বাণিজ্য ভালো চলছিল, দ্রব্যমূল্য ছিল সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে। এরপরই করোনার বছরে ২০২০ সালে জিডিপি কমে আসে ৫ শতাংশের কাছাকাছি। ২০১৯ সালের পর বাংলাদেশের জিডিপি আর ৭ শতাংশের ঘরে যেতে পারেনি। জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া বর্তমান সরকারের একটি অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ। সঙ্গে মূল্যস্ফীতি কমিয়ে এনে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে নিয়ে আসা এবং ডলার সংকট কাটিয়ে দেশে আমদানি-রপ্তানির বাজার গতিশীল রাখাও সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জ। যদিও বিষয়টি সহজ হবে না বলেই মনে হচ্ছে। তার কারণ উল্লেখ করছি।
২০২৩ সালে বিশ্ব যেভাবে যুদ্ধ দেখেছে, ২০২৪ সালে সেটি বাড়বে বৈ কমবে না। ইসরাইল-গাজা যুদ্ধের ১০০ দিন পার হয়ে গেলেও যুদ্ধবিরতির কোনো লক্ষণ নেই। এ একই যুদ্ধের কারণে নতুন করে বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য পথ লোহিত সাগর দিয়ে জাহাজ চলাচলে সংকট দেখা দিয়েছে। ফিলিস্তিনে যুদ্ধ বন্ধের দাবি তুলে ইসরাইলগামী জাহাজ বন্ধের নামে মূলত লোহিত সাগর পাড়ি দেওয়া প্রায় সব জাহাজেই হামলার চেষ্টা চালাচ্ছে ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীরা। লোহিত সাগর বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য পথ। বাংলাদেশের বাণিজ্যিক পণ্যের প্রায় ৬০ শতাংশ এ পথ ব্যবহার করে আনা-নেওয়া করা হয়। বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাক এ পথ ব্যবহার করেই ইউরোপে পাঠানো হয়। লোহিত সাগরের পথ পরিষ্কার না হলে বাংলাদেশসহ এশিয়ার পণ্যবাহী জাহাজ ঘুরপথে অর্থাৎ পুরো আফ্রিকা ঘুরে ইউরোপে যেতে বাধ্য হচ্ছে। আফ্রিকা মহাদেশ ঘুরে জাহাজ ইউরোপে যেতে দশ দিন সময় বেশি লাগে এবং খরচ বেড়ে হয় দ্বিগুণ। বেতন-ভাতা বৃদ্ধি নিয়ে আন্দোলন, ডলার সংকট এবং মধ্যপ্রাচ্যের সংকট নিয়ে বাংলাদেশের গার্মেন্ট সেক্টর নিয়ে দুশ্চিন্তা আছে। তার মাঝে মধ্যপ্রাচ্য সংকট শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্ব বাণিজ্যের জন্য এক বড় ধাক্কা। সহসাই মধ্যপ্রাচ্য সংকটের সমাধান হচ্ছে না। ফলে অর্থনীতিতে গতি ফিরিয়ে এনে করোনাপূর্ব অবস্থায় ফিরে যাওয়া বাংলাদেশ সরকারের জন্য সহজ হবে না।
আওয়ামী লীগ সরকারের ইশতেহারের মূল স্লোগান হলো-‘উন্নয়ন দৃশ্যমান, বাড়বে এবার কর্মসংস্থান’। এ অঙ্গীকার বাস্তবায়নেও সরকারকে বেগ পেতে হবে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা প্রায় দুই কোটি। আমরা যদি বিশ্ব পরিস্থিতির দিকে তাকাই তাহলে দেখব, বিশ্বমন্দার কারণে সারা বিশ্বেই কর্মী ছাঁটাই চলছে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। দেখা যাচ্ছে, ২০১৭ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত সময়ে দেশে যে হারে কর্মসংস্থান বাড়ছিল, এখন তা হ্রাস পেয়েছে। এদিকে প্রতিবছর লক্ষাধিক গ্র্যাজুয়েট পাশ করে বেরোচ্ছে, যাদের অধিকাংশই কাঙ্ক্ষিত চাকরিতে প্রবেশ করতে পারছে না। শুধু বাংলাদেশ নয়, ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের প্রক্ষেপণ অনুযায়ী, বিশ্ব অর্থনীতিতে স্থবির অবস্থা বিরাজমান। আর এ স্থবির অর্থনীতিতে বেকারত্বের হার বাড়বে। এরই মধ্যে আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্সের (এআই) আবির্ভাবের ফলে বৈশ্বিক কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র আরও সংকুচিত হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। বাংলাদেশে নীরব বেকারত্ব চলছে, এ বেকারত্ব দূর করে ইশতেহার বাস্তবায়ন করাও সরকারের অন্যতম চ্যালেঞ্জ।
প্রযুক্তি খাতে বাংলাদেশ উন্নতি করছে। ইতোমধ্যে দেশের তরুণরা প্রযুক্তি খাতে আশার আলো দেখাচ্ছে। সরকার নতুন উদ্যোক্তা তৈরিতে বা স্টার্টআপে পৃষ্ঠপোষকতা করে যাচ্ছে। তবে নতুন উদ্যোক্তা তৈরির কাজ আরও ত্বরান্বিত করতে হবে। ডিজিটাল বাংলাদেশের প্রতি এদেশের তরুণ সমাজের বিপুল সমর্থন ছিল। অথচ যে কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে বলে তরুণ সমাজ আশা করেছিল, তা হয়নি। তবে এখনই আশাহত না হয়ে তরুণ উদ্যোক্তা তৈরিতে সরকারকে আরও টাকা বিনিয়োগ করতে হবে। স্টার্টআপের জন্য ব্যাংক ঋণ ব্যবস্থা সহজ করতে হবে। স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে সেমিকন্ডাক্টর, মাইক্রো চিপ, স্মার্টফোন ইত্যাদি উৎপাদনের পথে হাঁটবে বাংলাদেশ। ফলে তরুণদের জন্য দেশে কাঙ্ক্ষিত কর্মসংস্থান তৈরি হতে পারে। এক হিসাবে দেখা গেছে, দেশের মন্ত্রণালয়গুলোতে প্রায় পাঁচ লাখ সরকারি পদ খালি পড়ে আছে। নিয়োগ হচ্ছে না। খালি পদগুলোতে একযোগে শিক্ষিত তরুণদের নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। সরকার জেলায় জেলায় ইকোনমিক জোন তৈরি করেছে। সেখানে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বাড়লে কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়বে।
দেশের রপ্তানিমুখী পণ্যে বৈচিত্র্য আনতে হবে। শুধু গার্মেন্ট পণ্য রপ্তানির ওপর নির্ভরশীলতা কমানোর কথা বহু বছর ধরেই অর্থনীতিবিদরা বলে আসছেন। ক্ষুদ্র কুটির শিল্প বাংলার ঐতিহ্য; অথচ সেই ঐতিহ্য থেকে আমরা অনেক দূরে সরে এসেছি। সঠিক পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এ শিল্প খাতে জাগরণ তৈরি হতে পারে বলে আমার বিশ্বাস। সরকার সেদিকে নজর দিলে দেশে কর্মসংস্থান আরও বাড়বে।
তৌহিদুল হাসান নিটোল : সিনিয়র রিসার্চ ফেলো, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রিসার্চ ইনস্টিটিউট ফর পিস অ্যান্ড লিবার্টি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়