Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে গ্রন্থাগারগুলোর বর্তমান চিত্র

Icon

ড. মো. রফিকুল ইসলাম

প্রকাশ: ৩০ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে গ্রন্থাগারগুলোর বর্তমান চিত্র

আমাদের জীবনে লাইব্রেরি বা গ্রন্থাগার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে গ্রন্থাগার একটা গণপরিসর তৈরি করেছে; যা সাধারণ মানুষের সাংস্কৃতিক চেতনার ভিত গড়েছে। একসময় কারিগরি দক্ষতা বাড়াতে নিয়মিত প্রযুক্তিবিদ্যাবিষয়ক জার্নাল ছাড়াও গবেষণামূলক বই পড়ার সুযোগ ছিল গ্রন্থাগারে। এর ফলে চৈতন্য গ্রন্থাগারের সঙ্গে পাঠকদের বাল্যস্মৃতি নিবিড়ভাবে জড়িত ছিল। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ ভিন্ন। আগের মতো পাঠকের পদচারণা নেই গ্রন্থাগারে। এর কারণ গ্রন্থাগারে পাঠকের চাহিদানুযায়ী তথ্য-উপাত্ত সংরক্ষিত নেই। তাই পাঠকের স্বার্থে গ্রন্থাগারে তথ্য-উপাত্ত সংরক্ষণ করা জরুরি। বিশেষ করে উচ্চশিক্ষার গুণগতমান অর্জনের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত জ্ঞানচর্চার একটি সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। এটি করতে পারলে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা ও গবেষণার মানোন্নয়ন নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। তবে মানসম্মত উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার উন্নয়নে সর্বোত্তম অনুশীলনের স্থান হলো গ্রন্থাগার। তাই দেশ ও জাতি গঠনে গ্রন্থাগারের ভূমিকা অপরিসীম।

উনিশ শতকের চল্লিশের দশক থেকেই ঢাকায় একটি মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভব ঘটে। এদের নেতৃত্বে একটি শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর সৃষ্টি হয় এবং তাদের মধ্য থেকেই আধুনিক সংবাদপত্র ও সাহিত্য-সংস্কৃতিচর্চার উদ্ভব ঘটে। তাছাড়া একই সময়ে ঢাকায় গড়ে ওঠে ব্রাহ্ম আন্দোলন। ঢাকায় ব্রাহ্ম আন্দোলনের নেতারা ছিলেন মুক্তবুদ্ধিচর্চার ধারক ও বাহক। তাদের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয় নানা স্কুল-কলেজ। কালের বিবর্তনে জনগণের সচেতনতার ফলে ধীরে ধীরে ঢাকায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠতে শুরু করে। স্বাধীনতার চার দশক পরও বাংলাদেশে কোথাও গ্রন্থাগার সংস্কৃতি গড়ে ওঠেনি। আমাদের দেশে যত্রতত্র যেভাবে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে হাসপাতাল গড়ে উঠেছে, সে হারে যদি গ্রন্থাগার গড়ে তোলা যেত, তাহলে সমাজে আলোকিত মানুষের সংখ্যা বহুলাংশে বেড়ে যেত আর সামাজিক অসংগতি, অস্থিরতা ও অসামাজিকতার প্রভাব সহজেই কমে যেত। উল্লেখ্য, ১৯৭৩ সালে মাত্র ছয়টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে উচ্চশিক্ষার যাত্রা শুরু হয়েছিল। বাংলাদেশে অধিকাংশ উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান সরকার কর্তৃক পরিচালিত হয়ে আসছে। উচ্চশিক্ষায় ভর্তি-ইচ্ছুক শিক্ষার্থীদের চাহিদা পূরণে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অপ্রতুল হওয়ার কারণে পরবর্তীকালে দেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশে মোট সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৫৫টি এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে ১১৩টি। এর মধ্যে দুটি আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। উল্লেখ্য, সাতটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে এক লাখের বেশি পাঠ্যপুস্তক রয়েছে, বেসরকারি তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্তকের সংখ্যাও লক্ষাধিক। আর বাকি সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পাঠ্যপুস্তকের সংখ্যা এক লাখের নিচে রয়েছে (ইউজিসির ওয়েবসাইট)। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় পাঠ্যপুস্তকের সংখ্যা তুলনামূলক অনেক কম। বর্তমানে উচ্চশিক্ষার পরিধি ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে; কিন্তু বাড়েনি উচ্চশিক্ষার সূতিকাগার গ্রন্থাগারের সুবিধা। এর প্রধান কারণ একশ্রেণির সুবিধাভোগী ব্যক্তির গ্রন্থাগার উন্নতিতে অনীহা। বাংলাদেশের উন্নতি হয়েছে সত্যিই; কিন্তু আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন হয়নি। ড. কুদরত-ই-খুদার প্রণীত বাংলাদেশের শিক্ষানীতিতে একাডেমিক প্রতিষ্ঠানের গ্রন্থাগারকে হৃৎপিণ্ডের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। তবে দুঃখের বিষয়, দেশের উন্নয়ন ভাবনার জ্ঞানতথ্যের সেই উৎস অর্থাৎ গ্রন্থাগারই আজ সবচেয়ে বেশি অবহেলিত। বাংলাদেশের উন্নয়নের জোয়ারের পাশাপাশি জাতির জ্ঞানবিকাশের উন্নয়নে এত অবহেলা কাম্য নয়। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে বাংলাদেশ অনেকদিকে এগিয়েছে, এ কথা সত্যি। তবে দেশের আদর্শিক শিক্ষার পরিশীলন, মূল্যবোধের চর্চা এবং চেতনার স্ফুরণ ঘটাতে গ্রন্থাগারের প্রতি এ অমনোযোগ সুষম উন্নয়ন ধারাকে টেকসই হতে বাধার সৃষ্টি করবে বৈকি। বর্তমান সরকার সামাজিক উন্নয়নের জন্য হাজার হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়ে বিভিন্ন স্বল্প বা দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প চালু করছে। অথচ মেধাবী প্রজন্মের জন্য জ্ঞাননির্ভর সমাজ তথা রাষ্ট্রের মানবীয় বিকাশে দেশের গ্রন্থাগারগুলোর জন্য বিশেষ বরাদ্দ নেই। কী কারণে এ দৈন্যদশার শিকার হলো গ্রন্থাগারগুলো, তা খতিয়ে দেখা উচিত। বিশেষভাবে লক্ষণীয়, বর্তমানে মাত্র সাতটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পূর্ণকালীন গ্রন্থাগারিক দায়িত্বে আছেন। অন্যদিকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৬টিতে পূর্ণকালীন গ্রন্থাগারিক আছেন। বাকি সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় গ্রন্থাগারিক পদে কোনো জনবল নেই। মাঝেমধ্যে কিছু কিছু সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রন্থাগারিক পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রচার করে থাকে। আবার কখনো কখনো শোনা যায় যোগ্য প্রার্থী না পাওয়ার কারণে নিয়োগ পরীক্ষা স্থগিত করা হয় অথবা পুনঃনিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। তবে দু-একটা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যতিক্রম লক্ষ করা যায়। তাহলে কি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে গ্রন্থাগার পরিচালনা করার মতো যোগ্য ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন উচ্চতর (তথ্যবিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা/গ্রন্থাগারবিজ্ঞান বিষয়ে অনার্স ও মাস্টার) ডিগ্রিপ্রাপ্ত জনবলের সত্যিই অভাব? নাকি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের গ্রন্থাগারিক পদে জনবল নিয়োগ দেওয়ার প্রতি সদিচ্ছার অভাব? নাকি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শিক্ষকদের অতিরিক্ত দায়িত্ব দিয়ে গ্রন্থাগার পরিচালনার ব্রত নিয়েছে? এর কোনো সদুত্তর নেই; যা গ্রন্থাগার উন্নয়নের জন্য বড় বাধা। প্রকৃতপক্ষে যিনি গ্রন্থাগারিক হবেন, তাকে কিন্তু গ্রন্থাগারবিজ্ঞানে উচ্চতর ডিগ্রিপ্রাপ্ত ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন হতে হবে। একজন শিক্ষকের প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনা করার মতো জ্ঞান থাকতে পারে; কিন্তু বাস্তবে তার গ্রন্থাগার সম্পর্কে সার্বিক বিষয়ে সুস্পষ্ট ধারণা না-ও থাকতে পারে। বিশেষ করে গ্রন্থাগারের উন্নয়ন করা এবং পাঠকের সার্বিক সেবা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে গ্রন্থাগারিকের ভূমিকা অপরিসীম। এর প্রধান কারণ হলো, তার পেশার স্বার্থেই গ্রন্থাগারকে সার্বিক উন্নয়নে সর্বদা তিনি সচেষ্টা থাকেন। দেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারগুলোয় তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার এখনো সন্তোষজনক নয়। বিশেষত তথ্য সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও তথ্য সেবা প্রদানে কোনো কোনো সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারে কম্পিউটার ও ইন্টারনেট ব্যবহৃত হলেও তা তথ্য ব্যবহারকারীর অনুপাতে পর্যাপ্ত নয়। আবার সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় আধুনিক গ্রন্থাগার স্থাপনের প্রচেষ্টা গুরুত্ব পায়নি।

গ্রন্থাগার উন্নয়নে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় বাজেট নিয়ে কোনো ধরনের বাধা কিংবা সমস্যা থাকে না। তাহলে গ্রন্থাগার উন্নয়নে কর্তৃপক্ষের এত অনীহা কেন? সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারগুলো যতটুকু উন্নত করার প্রয়োজন ছিল, তা কিন্তু বাস্তবে হয়নি। আবার আমরা যদি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গ্রন্থাগারের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করি তাহলে প্রকৃত অবহেলার চিত্র উঠে আসবে। অবশ্য কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার খুবই উন্নত হয়েছে, তা বলতেই হবে।

বাংলাদেশে মাত্র তিনটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে তথ্যবিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা বিভাগ চালু রয়েছে। এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তথ্যবিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা বিভাগে ৭৫টি আসন ছিল। এর মধ্যে ১০টি আসন কমানো হয়েছে। অন্যদিকে মাত্র একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে এ বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি কোর্স চালু রয়েছে। সময়ের পরিক্রমায় গ্রন্থাগার ব্যবহারের অনেকদিকই বর্তমানে পরিবর্তিত হয়েছে। একসময় ছোটখাটো অনেক তথ্য জানার জন্য ব্যবহারকারীরা গ্রন্থাগারে আসত, এখন সে অনুপাতে আসে না। কারণ, এখন ই-রিসোর্স গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এক্ষেত্রে গ্রন্থাগার পেশাজীবীদের অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে ঠিকই তবে তাদের কাজের পরিধি কিন্তু কমেনি বরং বেড়েছে। বিশেষ করে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে বর্তমান সরকারের অগ্রাধিকার ও উদারতা থাকায় গবেষণাকর্মে উৎসাহ প্রদানসহ বিভিন্ন গবেষণা প্রকল্পে অর্থায়ন বৃদ্ধি করা হয়েছে। গ্রন্থাগার ও গ্রন্থাগারসেবা উন্নত না হলে শিক্ষাব্যবস্থার যেমন উন্নতি হবে না, তেমনই শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতি না হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের লেখাপড়ার মানও উন্নত হবে না। এক্ষেত্রে গবেষণার মান উন্নত করতে হলে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা ও গবেষণার পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। অর্থাৎ গ্রন্থাগার সেবার মান ও প্রচুর রিসোর্স সংরক্ষণ করতে হবে। সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক-গবেষক-শিক্ষার্থীদের চাহিদানুযায়ী পাঠ্যপুস্তকের সংখ্যা বৃদ্ধি করা জরুরি। শিক্ষার্থীরা সব সময় মানসম্মত সরকারি কিংবা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে চায়। বর্তমানে অভিভাবকরা খুবই সচেতন। তাই সরকারি বা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতি সম্পর্কে অবগত হয়ে তাদের সন্তানদের ভর্তি করেন। এ বিষয়টি বিশেষ করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের চিন্তা করা উচিত। ব্যবহারকারীদের উন্নত সেবা প্রদানে প্রতিটি সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থগারগুলোয় গ্রন্থাগারিক পদে জনবল নিয়োগ দেওয়া জরুরি। বিশেষত তথ্যবিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা বিষয়ে পিএইচডি ডিগ্রিপ্রাপ্ত জনবলকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এ পদে নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারগুলোয় উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা যেতে পারে। এছাড়া বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রন্থাগারিক পদে কর্মরত পেশাজীবীদের অভিজ্ঞতাকে মূল্যায়ন করে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগদানে যেন কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতা না ঘটে, সে বিষয়ে ইউজিসির তদারকি করা উচিত। বিশেষ করে উন্নত বিশ্বের মতো গ্রন্থাগারিকদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করা দেশের স্বার্থে ও আমজনতার প্রয়োজনেই উচিত।

ড. মো. রফিকুল ইসলাম : গ্রন্থাগার বিভাগের প্রধান, সাউদার্ন ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ, চট্টগ্রাম

 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম