অপারেশন নাট ক্র্যাক শেষে ঢাকায় প্রবেশ
ডা. এম এ হাসান
প্রকাশ: ১৬ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
২৬ নভেম্বর সন্ধ্যা, ১৯৭১। ৫৭ মাউন্টেন ডিভিশনের হেড কোয়ার্টার থেকে জেনারেল গনজালভেস ও ব্রি. মিশ্রের উপস্থিতিতে আখাউড়া যুদ্ধের নির্দেশনামা সংগ্রহ করে ২৯ নভেম্বর বিকালে একটা মহড়া দিয়ে ৩০ নভেম্বর সন্ধ্যায় মাইন ডিটেক্টর ছাড়াই ৬ মাইল মাইনফিল্ড অতিক্রম করে রাত ১২টার আগে দ্রুত ফক্সহোল তৈরি করে লক্ষ্যস্থলে পৌঁছি। অভিজ্ঞ সুবেদার সুলতানকে রাখি হাতের ডানে পাকিস্তানি বাঙ্কারের দিকটায়। ভারতীয় জেনারেল গনজালভেস, জেনারেল গিল, ব্রিগেডিয়ার মিশ্র আমাদের এ অভিযানে সাক্ষী হয়ে আছেন। জেনারেল গিল ২০১৩ সালে আমার একটি ইংরেজি গ্রন্থে আমাদের সামরিক অভিযানের বিষয়টি সম্পাদনা করেন।
স্মৃতিতে আজ ৩০ নভেম্বর। কুয়াশাচ্ছন্ন জ্যোৎস্না ভরা এক শীতের রাত। অস্পষ্ট চাঁদের আলোয় আমাদের দেখা যাচ্ছিল। তাই প্রতিমুহূর্তে মনে হচ্ছিল, এই বুঝি শত্রুর লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হই। চষা খেতের আইলের মধ্যে মাইন খুঁজে এগোনোর সময় ছিল না। আক্রমণের সময় বা এইচ-আওয়ার ছিল ১ ডিসেম্বর ভোর ১টা। এর বেশ আগে আমি আমার গন্তব্যে পৌঁছে যেতে সক্ষম হলাম। অবস্থান গ্রহণ করলাম শত্রুব্যুহের চার-পাঁচশ মিটারের মধ্যে-দ্রুত হাতে খুঁড়ে নেওয়া হলো ফক্সহোল।
রাত ১টা বাজতেই আমি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশমতো পাকিস্তানি সেনাদের বাঙ্কার ও রক্ষণব্যুহগুলো গোলার আঘাতে চুরমার করার জন্য অয়্যারলেসে সংকেত পাঠালাম ভারতীয় গোলন্দাজ বাহিনী ৫৭ ও আমাদের মুজিব ব্যাটারিকে। ‘ধামাকা অন’ সংকেতটি উচ্চারণের পরপরই শুরু হলো প্রচণ্ড গোলাবর্ষণ। এর সঙ্গেই শুরু হলো পূর্বাঞ্চলে পরিচালিত বিজয় নির্ধারক শক্তিশালী যুদ্ধ ‘অপারেশন নাট ক্র্যাক’। বিরামহীন ভারী গোলাবর্ষণের শব্দে আজমপুর রেলস্টেশন ও আশপাশের জনপদগুলো কেঁপে উঠছিল। ওই সময় কিছু গোলা আখাউড়া রেলস্টেশনকেও আঘাত করেছিল।
৩০ নভেম্বর রাত ১২টার আগে ব্যাটালিয়নের অন্য দলগুলো পেছনে এবং দুপাশে সুরক্ষা দিলেও আজমপুর রেললাইনের কোলঘেঁষে অবস্থান নেন ১০ বিহার রেজিমেন্টের সদস্যরা। এ রেজিমেন্টের পেছনে চতুর্থ গার্ড ও ১৮ রাজপুত রাইফেলস এ অঞ্চলে অবস্থান নেয় ‘অপারেশন নাট ক্র্যাক’ শুরুর সময়টায়। আখাউড়া ব্রিজটি ছিল চতুর্থ গার্ডের লক্ষ্যস্থল। ৭৩ মাউন্টেন ব্রিগেডের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন ব্রিগেডিয়ার তুলি। তার লক্ষ্য ছিল গঙ্গাসাগর আক্রমণ করে কসবায় অবস্থানরত পাকিস্তানির ৩৩ বালুচকে রুখে দেওয়া।
আমার প্রতি নির্দেশ ছিল-আবার ‘ধামাকা অন’ শব্দটি উচ্চারণের পরই গোলাবর্ষণ বন্ধ হবে। আমি অনেকটা ইচ্ছা করেই প্রায় তিন ঘণ্টা পর আবার সংকেত পাঠালাম ‘ধামাকা ওভার’। ততক্ষণে শত্রু বাহিনীর অনেক বাঙ্কারই চুরমার হয়ে গেছে। যা হোক, গোলাবর্ষণ বন্ধ হওয়ার পরপরই হালকা মেশিনগান, গ্রেনেড ও রকেট লঞ্চার নিয়ে আমরা পাকিস্তানি বাহিনীর রক্ষণব্যুহের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম। শুরু হলো রকেট লঞ্চার দিয়ে কংক্রিট বাঙ্কার ধ্বংস এবং বাঙ্কারে বাঙ্কারে ‘ক্লোজ কমব্যাট’। ওই যুদ্ধের ভয়াবহতা ও তীব্রতা জেনারেল ভন রোমেলের অ্যাটাক গ্রন্থ তথা বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহ নিকট যুদ্ধের কথাগুলো স্মরণ করিয়ে দিল।
এর মধ্যে দ্বিতীয় বেঙ্গলের বি কোম্পানির অধিনায়ক লে. বদিউজ্জামান ও সুবেদার আশরাফসহ আরও কজন সেনা শহিদ হলে ৪ ডিসেম্বর বেলোনিয়া থেকে ফেরত পরম সাহসী যোদ্ধা শহিদ লে. সেলিম ওই কোম্পানির হাল ধরেন। ৫ তারিখে পাকিস্তানিদের পতন হলে ব্রিগেডিয়ার তুলির ট্যাংক বাহিনী, ৪র্থ গার্ড, রাজপুত রাইফেলসের সম্মিলিত আক্রমণ পাকিস্তানি চারটি ট্যাংক অকেজো করে দেয় এবং যুদ্ধ জয়ে বিশেষ ভূমিকা রাখে।
এরপর ঢাকামুখী ছোটা। সরাইল ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া হয়ে ৯ তারিখে আশুগঞ্জের কাছে একটি ভয়াবহ যুদ্ধের সম্মুখীন হলাম। আমাদের ডানে ১০ বিহার রেজিমেন্ট জীবন বাজি রেখে পাকিস্তানিদের সঙ্গে লড়ছে, আর এই ফাঁকে আমরা ডিঙি নিয়ে মেঘনা অতিক্রম করে ভৈরবে পৌঁছলাম। ভৈরবে আবার দলছুট পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে সংঘর্ষ। সেখানে আমাদের বাহিনীর একটি অংশ পাকিস্তানিদের মোকাবিলা করে তাদের যখন ব্যস্ত ও পদানত করছে, তখন আমরা খণ্ড খণ্ড প্রতিরোধ ভেঙে মুড়াপাড়ায় পৌঁছলাম। ডেমরা পৌঁছলাম ১৩ ডিসেম্বর। ১৪ ডিসেম্বর দ্বিতীয় বেঙ্গলের আলফা কোম্পানির এক প্লাটুন সেনা নিয়ে আমি নিজে আক্রমণ চালাই বাড্ডা ও গুলশানে অবস্থানরত পাকিস্তানি সেনাদের ওপর। ঘটনাক্রমে দ্বিতীয় বেঙ্গলের একজন কোম্পানি অফিসার হিসাবে সর্বাগ্রে পৌঁছে গিয়েছিলাম ঢাকার ২নং গুলশান চত্বরে ১৪ ডিসেম্বর রাতে। তবে এটি ছিল একটি বিচ্ছিন্ন আক্রমণ। তবু এতে বিজয়ের আনন্দ ছিল, গর্ব ছিল।
১৬ ডিসেম্বর সকাল থেকে প্রায় আটশ সেনা এবং তাদের অফিসাররা সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে ডেমরায়, শীতলক্ষ্যা নদীর ওপারে। কিছুক্ষণ পর ঢাকায় পাকিস্তানি সেনারা আত্মসমপর্ণ করছে, তাই ভারতীয় বাহিনীকে পথ করে দিতে হচ্ছে, আগেভাগে ভেতরে ঢোকার জন্য। অথচ তিন দিন ধরে ডেমরায় অবস্থান নিয়ে আছি আমরা। মাথায় সাদা ফেট্টিবাঁধা যে ছেলেগুলো পেছনের মুরাপাড়ায় ঘুরঘুর করছিল, তাদের মতো আমরা মুক্তবিহঙ্গ ছিলাম না। তারপর সে ছেলেগুলোকেও নদীকূলে থেমে থাকতে হচ্ছিল।
শেষ পর্যন্ত নির্দেশ পাওয়া গেল ব্যাটালিয়ন হিসাবে ভেতরে ঢোকার। পদব্রজে, জোড়া কদমে ভেতরে ঢুকছি। আমাদের পাশ দিয়ে খালি হাতে, মলিন বেশে দলছুট পাকিস্তানিরাও ঢাকার দিকে যাচ্ছে। আমরা উভয়েই ক্লান্ত, শ্রান্ত ও মলীন। তবে সব কিছুর মধ্যে আমাদের মাথাগুলো উঁচু এবং চোখগুলো হাসছে। মাথায় ফেট্টিবাঁধা ছেলেগুলো ততক্ষণে পাকিস্তানিদের ফেলে যাওয়া অস্ত্রগুলো তুলে নিয়েছে, কেউ কেউ তা কাঁধে ঝুলিয়েছে-কেউ এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়ছে আকাশের দিকে তাক করে। সেই প্রথম নিজেকে বিজয়ী মনে হলেও যুদ্ধের সর্বনাশা নানা দিকের কথা ভাবছিলাম। মনে হলো কুরুক্ষেত্রের কথা। এসব ভাবনার মাঝে যখন ঢাকায় পৌঁছলাম তখন সন্ধ্যা। প্রচণ্ড গোলাগুলি হচ্ছে। কে কাকে গুলি করছে, কোথায় করছে-কিছু বোঝা যাচ্ছে না। এ অবস্থায় রাতে বিশ্রামের জায়গাটা খুঁজছিলাম। সৈন্যদের জন্য স্টেডিয়ামের নিচে সারি সারি দোকানের সামনে তেরপল বিছিয়ে দেওয়া হলো। আমি আর ক্যাপ্টেন মতি দোতালায় কাপড়ের দোকানে ঢুকে পড়লাম। গুটিকয় থান কাপড় মাটিতে ফেলে দিয়ে গা এলিয়ে দিলাম।
সেলিম তখন তড়িঘড়ি করে নিজ সেনাদের দেখভালের জন্য নিচে নেমে গেল। মতি ভাই তখন চুরুট ফুঁকছেন আর হেড়ে গলায় গাইছেন। পরদিন সবাই মিলে রেসকোর্স ময়দানে হাজির হলাম। উড়িয়ে দিলাম বিজয়ের পতাকা। জিমখানা ক্লাবটা থাকার জন্য বরাদ্দ হলো। তবে সেখানে স্থানসংকুলান না হওয়ায় আমি আর মতি ভাই আমাদের কোম্পানি নিয়ে পুরোনো হাইকোর্টে আস্তানা গাড়লাম।
সৈন্যরা নিচে আর আমরা দুজন উপরে। বেশ ক’টা দিন ওখানে থাকতে হলো। আমার দায়িত্ব হলো পুরান ঢাকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা। হঠাৎ করে ব্যাঘ্র বনে যাওয়া শহুরে মুক্তিযোদ্ধা, ষোড়শ বাহিনী আর দলীয় লোকের উৎপাত। লুটে নিচ্ছে সাধারণের সম্পদ। এতে আমাদের নির্মল অন্তর মলিন হয়ে ওঠে। এসবের মাঝে রক্তে আঁকা বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করি স্বজনহারা সহস্র মানুষের মাঝে। আর যারা পাকিস্তানের সঙ্গে গোপন সমঝোতার কারণে অক্ষত থেকে গিয়েছিল, যাদের গায়ে এতটুকু আঁচড় লাগেনি, তারা উচ্চকণ্ঠে বিজয়ের গান গেয়েছে নিজেদের পেছনটা আড়াল করার জন্য।
এর কিছু দিন পর মিরপুর মুক্ত করতে গিয়ে ৪১ সেনাসদস্যসহ ভাই লে. সেলিম শহিদ হলেন। শহিদদের মরদেহ উদ্ধার না করে ১৯ বছর তাদের পবিত্র দেহ নোংরা নর্দমায় ফেলে রেখে ব্রি. শফিউল্লাহ ও মেজর মঈন নিজেদের বুকে বীর উত্তমের স্মারক ঝোলালেন। জীবনের চেয়ে আর কী বেশি দিতে পারত ওইসব শহিদ। তাদের সঙ্গে শহিদ পরিবারের আরও তিন সদস্য। এর কিছু দিন পর প্রেসিডেন্ট সেলিমের ভাঙা বাক্সে পেলাম তার ডায়েরি, যেখানে লেখা-
৩০.১১.৭১
মা,
‘পহেলা নভেম্বর নোয়াখালীতে যাবার হুকুম হলো। ফেনীর বেলোনিয়া ও পরশুরাম মুক্ত করার জন্য। ৬ই নভেম্বর রাতে চুপচুপ করে শত্রু এলাকার অনন্তপুরে ঢুকলাম। পরদিন সকালে ওরা দেখল ওদেরকে আমরা ঘিরে ফেলেছি। ৮ই নভেম্বর রাতে ঐ জায়গা সম্পূর্ণ মুক্ত হলো। শত্রুরা ভয়ে আরো কিছু ঘাঁটি ফেলে পালিয়ে গেল।
পরদিন চিতোলিয়া আমরা বিনাযুদ্ধে দখলমুক্ত করলাম। আস্তে আস্তে আরো এগিয়ে গেলাম। ২৭শে নভেম্বর যখন আমরা ঐ এলাকা থেকে ফিরে এলাম তখন আমরা ফেনী মহাকুমা শহর থেকে দেড় মাইল দূরে ছিলাম, পাঠাননগর ছিল আমাদের অগ্রবর্তী ঘাঁটি। শীঘ্রই মাগো আবার তোমার সাথে দেখা করতে পারব ভেবে মনটা আনন্দে ভরে গেল।
জান মা, এই যুদ্ধে আমরা ৬০ জন শত্রু ধরেছি। আমাদের কোম্পানীর তিনজন শহীদ ও একজনের পা মাইনে উড়ে গেছে। দোয়া করো মা।-সেলিম’
শহিদ ও প্রকৃত বীরগণ যারা চলে গেছেন সব চাওয়ার ঊর্ধ্বে, তারা নতুন করে কী চাইতে পারেন দেশবাসীর কাছে। তার ডায়েরির শেষ কথা ছিল-উদয়ের পথে শুনি কার বাণী/ভয় নাই ওরে ভয় নাই/নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান/ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই।
ডা. এম এ হাসান : চেয়ারপারসন, ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি, বাংলাদেশ