তাদের ত্যাগের মহিমায় ঋদ্ধ স্বদেশ
ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী
প্রকাশ: ১৪ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
দেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসের এক কালো অধ্যায় রচিত হওয়ার ক্ষণ ১৪ ডিসেম্বর। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের প্রাক্কালে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হারানোর দিন। দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে বিজয়ের স্বাদ গ্রহণের আগমুহূর্তে পরাজয়ের গ্লানিমাখা বর্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও স্বাধীনতাবিরোধীরা তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকার-আলবদর-আলশামস ও শান্তি কমিটির সদস্যরা পরিকল্পিতভাবে দেশবরেণ্য বুদ্ধিজীবীদের নির্মমভাবে হত্যা করে। চরম প্রতিহিংসাপরায়ণতার বশবর্তী হয়ে পাকিস্তানি সেনারা দালালদের সাহায্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসসহ বিভিন্ন স্থান থেকে অসংখ্য শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, চিকিৎসক, আইনজীবী, প্রকৌশলী, কবি-সাহিত্যিক, সংস্কৃতিকর্মীসহ নানা পেশার প্রথিতযশা ব্যক্তিদের অপহরণ করে নিয়ে যায়। লাল-সবুজ পতাকার স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার উষালগ্নে জাতিকে পরিপূর্ণ মেধাশূন্য করতে এ নৃশংস হত্যাযজ্ঞ চালায়। বীরের জাতি বাঙালি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে যাতে পঙ্গু ও দিকনির্দেশনাহীন হয়ে পৃথিবীতে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে না পারে সে লক্ষ্যেই এ নীলনকশা বাস্তবায়নে নরপশুর দল দেশব্যাপী এ নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডে মেতে উঠেছিল।
পরবর্তীকালে ঢাকার রায়েরবাজার ও মিরপুর বধ্যভূমিসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে গণকবরে শহিদ বুদ্ধিজীবীদের ক্ষতবিক্ষত-বিকৃত মরদেহ পাওয়া যায়। অনেকের দেহে ছিল বহু গুলি ও আঘাতের চিহ্ন, অনেকের চোখ-হাত-পা বাঁধা এবং বেয়নেট খুঁচিয়ে পৈশাচিক হত্যার নিদর্শন। হত্যার আগে নির্যাতনের এমন বীভৎস ঘটনা বিশ্বে বিরল। তিন দিন খোলা আকাশের নিচে পড়ে থাকা অনেক লাশ শনাক্ত করা যায়নি। অনেকের লাশের কোনো সন্ধান মেলেনি। হয়তো শকুন কিংবা কুকুর খেয়ে ফেলেছে। নয়তো এমন কোনো গর্তে বা স্থানে ফেলে দেওয়া হয়েছে, যা আর কেউ কখনো খুঁজে পায়নি। এমন নৃশংসতার নজির ইতিহাসের পাতায় খুঁজে পাওয়া কঠিন। ঘাতকদের হাতে সেদিন শহিদ হওয়া সূর্যসন্তানদের মধ্যে রয়েছেন-অধ্যাপক মুনির চৌধুরী, ডা. আলিম চৌধুরী, অধ্যাপক মুনিরুজ্জামান, ড. ফজলে রাব্বী, সিরাজুদ্দীন হোসেন, শহীদুল্লা কায়সার, অধ্যাপক গোবিন্দ চন্দ্র, জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা, অধ্যাপক সন্তোষ ভট্টাচার্য, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, অধ্যাপক গিয়াস উদ্দিন, অধ্যাপক আনোয়ার পাশা, অধ্যাপক রাশীদুল হাসান, ড. আবুল খায়ের, ড. মুর্তজা, সাংবাদিক খন্দকার আবু তাহের, নিজামউদ্দিন আহমেদ, এসএ মান্নান, আ ন ম গোলাম মোস্তফা, সৈয়দ নাজমুল হক, সেলিনা পারভিনসহ আরও অনেকে। আন্তর্জাতিক সংবাদ সাময়িকী নিউজ উইকের সাংবাদিক নিকোলাস টমালিন রচিত নিবন্ধ সূত্রমতে, শহিদ বুদ্ধিজীবীর মোট সংখ্যা ১ হাজার ৭০। ১৯৯৪ সালে বাংলা একাডেমি কর্তৃক প্রকাশিত ‘শহিদ বুদ্ধিজীবী কোষগ্রন্থ’ সূত্রে ২৩২ জন বুদ্ধিজীবী হত্যার তথ্য জানা গেলেও তালিকায় অসম্পূর্ণতার কথাও স্বীকার করা হয়েছে।
গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন সূত্রের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণে এটি স্পষ্ট যে, মুক্তিযুদ্ধকালীন এ কৃতী বুদ্ধিজীবীদের নামের তালিকা তুলে দেওয়া হয়েছিল তৎকালীন জামায়াতে ইসলামীর সমর্থনপুষ্ট কুখ্যাত সশস্ত্র সংগঠন আলবদর ও আলশামস বাহিনীর হাতে। নেপথ্যে মদদ দিয়েছিল পূর্ব পাকিস্তানের দায়িত্বে থাকা পাকিস্তানি জেনারেল রাও ফরমান আলী। বিজয়ের মাস ডিসেম্বরের ১০ থেকে ১৪ তারিখ পর্যন্ত তালিকা অনুযায়ী বুদ্ধিজীবী হত্যার ঘৃণ্যতম অপকর্মটি সম্পাদনে লিপ্ত হয় এ ঘাতকচক্র। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে খ্যাতিমান লেখক ও চলচ্চিত্রকার জহির রায়হানকে প্রধান করে গঠিত ‘বুদ্ধিজীবী তদন্ত কমিটি’র প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘রাও ফরমান আলী এদেশের ২০ হাজার বুদ্ধিজীবীকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিল। তার লক্ষ্য ছিল শীর্ষ বুদ্ধিজীবীদের গভর্নর হাউজে নিমন্ত্রণ করে নিয়ে গিয়ে হত্যা করা।’ অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের বিষয়, তিনি তার আপন ভাই শহিদ বুদ্ধিজীবী শহীদুল্লা কায়সারকে মিরপুরে খুঁজতে গিয়ে নিজেও ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি নিখোঁজ হন।
ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায়, হিটলারের নাৎসি বাহিনীর রাজনৈতিক দর্শন ছিল কোনো জাতিকে অনুগত ও পদানত রাখতে হলে তাদের স্বাধীনচেতা-মুক্তমনা-আদর্শনিষ্ঠ বুদ্ধিজীবীদের আগে হত্যা করা। হিটলারের জার্মানিতে অসংখ্য বুদ্ধিজীবীকে হত্যা, জেলে প্রেরণসহ অনেকের বই পুড়িয়ে দেওয়া হয়। বিশ্বখ্যাত সাহিত্যিক ও দার্শনিক রোম্যাঁ রোলাঁ হিটলারের কারাগারে বসেই লিখেছিলেন ‘আমি ক্ষান্ত হব না’। ইতালিতে ফ্যাসিস্ট মুসোলিনির রাজত্বের সময় অসংখ্য শিল্পী, সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করা হয়। বিখ্যাত ঔপন্যাসিক আলবার্তো মোরাভিয়া দেশ থেকে পালিয়ে গিয়ে দশ বছর পাহাড়ে-জঙ্গলে ঘুরে বেড়িয়েছেন। স্মরণযোগ্য, পাকিস্তানে আইয়ুব খানের শাসনামলে তার পৃষ্ঠপোষকতায় গঠিত রাইটার্স গিল্ডের সভায় আলবার্তো মোরাভিয়াকে আমন্ত্রণ জানালে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করে লিখেছিলেন, ‘আমি দ্বিতীয় মুসোলিনির দেশে আসতে চাই না।’
সচেতন মহলসহ দেশের জনগণ সম্যক অবগত আছেন, বাঙালি জাতির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সন্তান স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে দীর্ঘ স্বাধীনতাসংগ্রামের সমন্বিত ফসল আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বহু ত্যাগ-তিতিক্ষা এবং রক্তের বিনিময়ে সংঘটিত এ মহান মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে ছিল বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামের ইতিহাস। রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক জাগরণের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত হয় বাঙালি জাতি। ’৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অভূতপূর্ব বিজয়-পূর্ব পাকিস্তানে ১৬২ আসনের মধ্যে ১৬০ আসনে জয়লাভ; যার ফলে বঙ্গবন্ধুর জন্য পাকিস্তানের শাসনক্ষমতার কর্ণধার তথা প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সব পথ উন্মুক্ত হয়। কিন্তু সামরিক জান্তা ইয়াহিয়া খান ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের এ বিজয়কে নস্যাৎ করার পরিকল্পনা করে। এ পরিপ্রেক্ষিতে ’৭১-এর ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু ঘোষণা দেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ সামরিক জান্তা ইয়াহিয়া খান বিভিন্ন আলোচনার নামে সময়ক্ষেপণের মাধ্যমে ভুট্টোর সঙ্গে ষড়যন্ত্রে আবদ্ধ হয়ে ২৫ মার্চ কালরাত্রিতে ইপিআর, পুলিশ, ছাত্র-শিক্ষকসহ সর্বস্তরের নিরস্ত্র জনগণের ওপর ইতিহাসের নির্মম গণহত্যা পরিচালনা করে। মধ্যরাতে তারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করার আগেই বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।
দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের পথ অতিক্রান্তে ৯ মাসের সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অর্জিত হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা। বুদ্ধিজীবীদের হত্যার দুই দিন পর ১৬ ডিসেম্বর জেনারেল নিয়াজির নেতৃত্বাধীন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাংলার দামাল ছেলেদের কাছে আত্মসমর্পণ করলে স্বাধীন দেশ হিসাবে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বুদ্ধিজীবীরা মেধা, অভিজ্ঞতা ও শ্রমের সমন্বয়ে তাদের সাধ্য অনুযায়ী মুক্তিযোদ্ধাদের নানাভাবে সাহায্য করেছিলেন। স্বাধীনতাসংগ্রামের প্রতিটি পর্যায়ে দেশের সর্বস্তরের বুদ্ধিজীবীর অপরিসীম অবদান রয়েছে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের পাশাপাশি বাঙালিদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় জাগ্রত করে রণাঙ্গনে ঝাঁপিয়ে পড়ার ক্ষেত্রে বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকাও ছিল অতুলনীয়। বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে তারাও নিজস্ব অবস্থান থেকে সশস্ত্র সংগ্রামের প্রস্তুতি শুরু করেন। মুজিবনগর সরকার গঠন, বাংলাদেশের প্রথম সরকারের নানাবিধ প্রতিষ্ঠান স্থাপন, বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যক্তিদের দায়িত্ব প্রদান এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন আদায়ে বুদ্ধিজীবীদের সাহসী কর্মকাণ্ড চিরস্মরণীয়।
বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ১৪ ডিসেম্বর দিনটিকে বুদ্ধিজীবী দিবস হিসাবে ঘোষণা করেন। শহিদ বুদ্ধিজীবীদের স্মরণে প্রথম মিরপুরে স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়। ১৯৯১ সালে ঢাকার রায়েরবাজারে শহিদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ নামে আরেকটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ শুরু হয়, যা ১৯৯৯ সালের ১৪ ডিসেম্বর উদ্বোধন করেন তৎকালীন ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
আজকের এই দিনে বঙ্গবন্ধু, বঙ্গমাতাসহ ১৫ আগস্ট বর্বর হত্যাযজ্ঞে সব শহিদ, জাতীয় চার নেতা, বুদ্ধিজীবীসহ ৩০ লাখ শহিদান, নির্যাতিত ২ লাখ জননী-জায়া-কন্যাসহ মুক্তিযুদ্ধে সবার অবদানকে পরম শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি।
ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী : শিক্ষাবিদ; সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়