ইসরাইল মধ্যপ্রাচ্যের দুষ্টক্ষত
তৌফিকুল ইসলাম চৌধুরী
প্রকাশ: ০৪ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
আন্তর্জাতিক রাজনীতির ঘাত-প্রতিঘাতের সিঁড়ি বেয়ে মধ্যপ্রাচ্য আজ এক চরম সংকটে নিপতিত। সেখানকার হাওয়া আজ ভীষণ উত্তপ্ত। মানবাধিকার সেখানে আজ চরমভাবে পদদলিত। মধ্যপ্রাচ্যের ফিলিস্তিনে আজ চলছে ইসরাইল ও ফিলিস্তিন যুদ্ধ। এশিয়ায় বর্ণবাদী ও শ্রেষ্ঠত্ববাদীদের সর্বশেষ উপনিবেশ সামরিক শক্তিতে বলীয়ান ইসরাইল রাষ্ট্রের সঙ্গে ফিলিস্তিনি হামাসের এ অসম যুদ্ধে গাজা আজ ম্যাসাকার। ইসরাইল খুব ঠান্ডা মাথায় অমানবিক জুলুম-নির্যাতন ও ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছে এ ফিলিস্তিনে। তাদের হামলা থেকে রেহাই পাচ্ছে না দেশটির নারী-শিশু-এমনকি হাসপাতালের রোগীরা পর্যন্ত। ইসরাইল হাসপাতাল, স্কুল, মসজিদ, জনবসতি-কিছুই বাদ রাখছে না হামলা ও ধ্বংসযজ্ঞ থেকে। আল আকসা মসজিদ গুঁড়িয়ে দিয়ে তারা সেখানে ইহুদি উপাসনালয় স্থাপনের জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। পরিকল্পনা করেছে, গাজায় তাদের চলতি সামরিক অভিযান শেষ হলে অনির্দিষ্টকালের জন্য গাজায় সামরিক নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখবে। অর্থাৎ তারাই হবে ওই অঞ্চলের মালিক। বাগে আনতে পারলে তারা গাজাকে তিন ভাগে ভাগ করে নেবে। নতুন ইহুদি বসতি গড়বে। তারা গাজার ২৩ লাখ মানুষকে সিনাই উপদ্বীপে পাঠাতে চায়। এসবই তাদের পরিকল্পনা। এসব চাপে ও ধ্বংসলীলায় ফিস্তিনিরা যে আজ কী মারাত্মক ট্রমা বা মানসিক আতঙ্ক ও যন্ত্রণায় আছে, তা ভাবলেই শিউরে উঠতে হয়! ফিলিস্তিনকে নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে আজ এই যে জ্বলন্ত আগুনের লেলিহান শিখা, এজন্য তো দায়ী সাম্রাজ্যবাদের অবৈধ সন্তান মধ্যপ্রাচ্যের দুষ্ট ক্ষত ইসরাইল।
ইসরাইল আসলে সম্পূর্ণ বেআইনি ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত। কারণ এ রাষ্ট্রটি প্যালেস্টাইন ভূখণ্ড জবরদখল করে প্রতিষ্ঠা করা হয়। প্যালেস্টাইনের আদি বাসিন্দা সাত লাখ ফিলিস্তিনিকে সুপরিকল্পিত হিংস্রতার মাধ্যমে উৎখাত ও বাস্তুচ্যুত করে ব্রিটেনের ইহুদি পররাষ্ট্র সচিব বালফুরের ১৯১৭ সালের ২ নভেম্বর ঘোষণার আলোকে ১৯৪৮ সালের ১৫ মে ইহুদিরা প্রতিষ্ঠা করে স্বাধীন ইসরাইল রাষ্ট্র। ইহুদিরা দাবি করে, তারা তিন হাজার বছর আগে এতদঞ্চলে ছিল এবং সে দাবিতেই ফিলিস্তিনিদের উৎখাত করে তারা নিজেদের আবাসভূমি পুনরায় প্রতিষ্ঠা করল। কিন্তু পিএলও প্রকাশিত পুস্তিকা থেকে জানা যায়, বাইবেলে উল্লেখিত ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বহু আগেই প্যালেস্টাইনিরা ফিলিস্তিনে ছিল।
প্যালেস্টাইনে ফিলিস্তিনিদের এ আবাসভূমি যুগপরম্পরায় পরবর্তী সময়েও ধারাবাহিকভাবে বহাল ছিল। এক সময় ১০ হাজার ৪২৯ বর্গমাইলব্যাপী বিস্তৃত ‘ফিলিস্তিন’ নামের এ দেশটি উসমানীয় খেলাফতের অধীনে ন্যস্ত হয়, যারা প্রথম বিশ্বযুদ্ধকালে ব্রিটিশবিরোধী জোটে অবস্থান নেয়, (যদিও ব্রিটিশরা যুদ্ধজয়ে তাদের সহযোগিতা চেয়েছিল)। যুদ্ধজয়ের পর ব্রিটিশ পররাষ্ট্র সচিব বালফুর ১৯১৭ সালের ২ নভেম্বর এ বিজিত ভূখণ্ড নিয়ে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হবে বলে ঘোষণা দেন। এদিকে বিশ্বযুদ্ধের এ সময়ে ড. হেইস বাইজম্যান নামের এক ইহুদি বিজ্ঞানী বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটেনের ব্যবহারের জন্য দুর্লভ বোমা তৈরির উপকরণ কৃত্রিম ফসফরাস তৈরি করে যুদ্ধজয়ে অনুঘটকের ভূমিকা পালন করেন। তার আবিষ্কারে খুশি হয়ে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ড. বাইজম্যানকে পুরস্কৃত করতে চান; কিন্তু বাইজম্যান নগদ কোনো পুরস্কার গ্রহণে অস্বীকৃতি জানিয়ে প্যালেস্টাইনে এক টুকরো স্বাধীন ভূমি চেয়ে বসেন। তার আবদারে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ফিলিস্তিন ভূখণ্ডটি ইহুদিদের হাতে তুলে দিতে রাজি হয়ে মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন। এ লক্ষ্যে ইহুদিদের স্বাধীনতা দেওয়ার অঙ্গীকারে ব্রিটেন সুচতুরভাবে ১৯১৮ সাল থেকে ৩০ বছর ফিলিস্তিন এলাকাটি নিজেদের কবজায় রেখে আরবীয় শূন্য করার ব্যবস্থা গ্রহণ করে। এ কাজে ইহুদি অধ্যুষিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও (বর্তমানেও এখানে ৬০ লাখ ইহুদি বাস করে, যাদের সিংহভাগ মার্কিন প্রশাসনে প্রভাব বিস্তারের ক্ষমতা রাখেন) তাদের দোসরের ভূমিকা পালন করে এবং ১৯৪৮ সালে ইসরাইল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা নিশ্চিত করে।
বালফুর ঘোষণা ও ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর আনুকূল্যে একান্ত উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়েই পৃথিবীর বিভিন্ন এলাকা থেকে ইহুদিরা এসে ফিলিস্তিনে স্থায়ী বসবাস শুরু করে। বাড়াতে থাকে ইহুদির সংখ্যা, বাড়াতে থাকে নতুন নতুন ইহুদি বসতি। যার ফলে ১৯১৮ সালে যেখানে প্যালেস্টাইন এলাকার জনসংখ্যার মাত্র ৮ শতাংশ ছিল ইহুদি, সেখানে ১৯৪৮ সালে তা দাঁড়ায় ৩৩ শতাংশ-এ। অর্থাৎ ১৯১৮ সালে যেখানে প্যালেস্টাইনে ইহুদির সংখ্যা ছিল দেড় লাখের মতো, ১৯৪৮ সালে ব্যাপক আগমনের ফলে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৭ লাখ ৫০ হাজারে এবং বর্তমানে তা এসে দাঁড়িয়েছে ৭১ লাখ ৫ হাজারে, যা ওই দেশের মোট জনসংখ্যার ৭৩.৫ শতাংশ। আরবিসহ বর্তমানে ইসরাইলের মোট জনসংখ্যা প্রায় ৯৭ লাখ। এটি মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশ। এখানে প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৪২৫ জন লোক বাস করে, যার বৃহদাংশ আমদানিকৃত ইহুদি।
এভাবে প্যালেস্টাইনে সাম্রাজ্যবাদের সমর্থনে আরব ও বিশ্ব জনমতকে উপেক্ষা করে, মানবাধিকারকে লাথি মেরে ইসরাইল রাষ্ট্রের গোড়া পত্তন করা হয়। সুতরাং, ফিলিস্তিনে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কোনো বৈধ ভিত্তি নেই। এখানে উল্লেখ করার মতো বিষয় হলো, ইসরাইল প্রতিষ্ঠার পেছনে প্রধান শক্তি হলো ব্রিটেন এবং প্রথম স্বীকৃতি দানকারী দেশ ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। তাই ইসরাইলকে সাম্রাজ্যবাদের অবৈধ সন্তান বলা অসংগত নয়।
ইসরাইল যেহেতু সাম্রাজ্যবাদের অবৈধ সন্তান এবং এর কোনো বৈধ ভিত্তি নেই, সেহেতু এর অবস্থানই মধ্যপ্রাচ্য সমস্যার মূল কারণ। ইসরাইলের অবস্থানের কারণেই সংঘটিত হয়েছে পাঁচটি আরব-ইসরাইল যুদ্ধ। ইসরাইলকে বেষ্টন করে আছে ১৭টি আরব রাষ্ট্র; কিন্তু এদের মধ্যে অনৈক্য ইসরাইলকে চরম সাহসী করে তুলে। আরবরা ইসরাইলি আগ্রাসী নীতির কাছে হারিয়েছে বিপুল পরিমাণ আরব ভূখণ্ড। ৪০ (চল্লিশ) লাখ ফিলিস্তিনি তাদের প্রাণপ্রিয় পিতৃভূমি থেকে বিতাড়িত হয়ে গ্রহণ করেছে মানবেতর উদ্বাস্তুর জীবন। আশ্রয় নিয়েছে জর্ডান, লেবানন, সিরিয়া এবং অন্যান্য আরব দেশগুলোর বিভিন্ন ক্যাম্পে। ইসরাইলের অনমনীয়তায় তাদের পুনর্বাসনের কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা সম্ভব হচ্ছে না। সময়ে সময়ে ফিলিস্তিনিদের ওপর জঘন্য ইসরাইলি বর্বরোচিত হামলা তো আছেই। তারা রাজনৈতিকভাবে ফিলিস্তিনকে বিশ্বের মানচিত্র থেকে মুছে দিতে চায়। এমনতরো হাজারও সমস্যা এখন মধ্যপ্রাচ্যে। যুক্তরাষ্ট্রসহ বৃহৎ শক্তিগুলোও বসে নেই। জার্মানি, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্যসহ শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদীরাও ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে একজোট। যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলকে নানাভাবে পৃষ্ঠপোষকতা ও সহায়তা করছে। গাজা আগ্রাসনের পথ ধরে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলাটাও বেশ জমে উঠেছে। মার্কিন অস্ত্র ব্যবসা বেশ ভালোই হচ্ছে।
আসলে মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইল যতদিন টিকে থাকবে, ততদিন সে চালিয়ে যাবে তার আগ্রাসী নীতি। এরই আভাস পাওয়া যায় ইসরাইলের পার্লামেন্টে স্পিকারের আসনের ওপর ঝুলন্ত বাইবেলীয় ইসরাইলের মানচিত্র দেখে। এতে কেবল সারা ফিলিস্তিন ভূখণ্ড নয়, জর্ডান, সিরিয়া, মিসরও রয়েছে। এছাড়াও ইসরাইলি নীতি বাস্তবায়িত করার ষড়যন্ত্রের এক চাঞ্চল্যকর গোপন তথ্য প্রকাশ করেছেন জনৈক ফিলিস্তিনি নেতা হায়দর কে হোসাইনী। এ ষড়যন্ত্র অনুযায়ী ইহুদিরা মক্কা ও মদিনাসহ সমগ্র আরব দখলের ছক এঁকেছে। তাই ইসরাইলকে টিকিয়ে রেখে ‘শান্তির শ্বেত কপোত’রা যতই প্রচেষ্টা চালান না কেন, তাতে কোনো ফলোদয় হবে বলে মনে হয় না। তাছাড়া প্রশ্ন রয়েছে, লাখো লাখো উদ্বাস্তুর-যারা বিতাড়িত হয়েছেন এবং এখনো হচ্ছেন; ইসরাইল-হামাস যুদ্ধে নিজেদের বাপ-দাদা চৌদ্দ পুরুষের বাস্তুভিটা থেকে। তাদের আবার কোলে টেনে নেবে, ইহুদিদের এমন সুবোধ বলেও মনে হয় না। অন্যদিকে ফিলিস্তিনিরা নিজ ভূখণ্ডসহ স্বাধীন ফিলিস্তিন অর্জন ছাড়া ক্ষান্তও হবে না। ফলে স্থায়ী অশান্তিই থেকে গেল মধ্যপ্রাচ্যে। আমার মনে হয়, ইসরাইল রাষ্ট্রের উৎখাতের মাঝেই নিহিত রয়েছে মধ্যপ্রাচ্য সমস্যার সমাধানের সর্বোৎকৃষ্ট পথ। তবে ইসরাইলকে যে উৎখাত করা যাবে তা-ও নয়। কারণ ইসরাইল এখন অনেক বেশি শক্তিশালী। ইসরাইলের হাতে এমন পারমাণবিক অস্ত্রও আছে, যা নিমিষেই মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলো নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র তো বিপুল পরিমাণ আমেরিকান আর্টিলারি যুদ্ধাস্ত্র, অত্যাধুনিক বোমা, ক্ষেপণাস্ত্র ও অন্যান্য ভারী অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে সরাসরি ইসরাইলকে ইন্ধন জোগাচ্ছে। তাই ইসরাইলকে উচ্ছেদ বা তাদের আগ্রাসন থেকে মানসিকভাবে নিবৃত্ত করতে হলে সামরিক ও আদর্শিকভাবে দুর্বল আরব রাষ্ট্রগুলোকে পারস্পরিক সংশয় ত্যাগ করে প্রথমেই ইস্পাত কঠিন ঐক্য গড়ে তুলতে হবে। আরব দেশগুলো ঐক্যবদ্ধ হতে না পারলে এবং ইসরাইলকে উৎখাত বা মানসিকভাবে দুর্বল করতে না পারলে মধ্যপ্রাচ্য সমস্যার আশু সমাধান কিছুতেই সম্ভব নয়। ইসরাইল মধ্যপ্রাচ্যে বিষফোঁড়া হয়েই থাকবে।
তৌফিকুল ইসলাম চৌধুরী : প্রাবন্ধিক, গবেষক
taufiqichy@gmail.com