অর্থনীতির অশনিসংকেতগুলো আমলে নিতে হবে
আবু আহমেদ
প্রকাশ: ০২ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর একটি কথা আমাদের অনেকটা হতাশ করেছে। কথাটি ছিল, ‘রিজার্ভের সংকট নিয়ে অত চিন্তা করবেন না।’ আমি বলব, তার কথাটি সুচিন্তিত নয়। দেশের রিজার্ভ সম্পর্কে তিনি অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয়েছেন। আমাদের রিজার্ভ ২০ বিলিয়নের নিচে নেমে এলেও আইএমএফ আমাদের ঋণ দেবে। কারণ তারা হচ্ছে ঋণ বিক্রেতা। বাংলাদেশ তাদের জন্য ভালো ক্লায়েন্ট। পাকিস্তান দেউলিয়াত্বের দ্বারপ্রান্তে থাকার পরও আইএমএফ তাদের ঋণ দিচ্ছে। বাংলাদেশের রিজার্ভ ১৫ বিলিয়নের নিচে এলেও তারা আমাদের ঋণ দেবে। কিন্তু সমস্যাটা হবে আমাদের। সুতরাং রিজার্ভের সমস্যা নেই কথাটি ঠিক নয়। রিজার্ভের সমস্যাটা তখনই প্রকট আকার ধারণ করবে, যখন আমাদের রিজার্ভ ১৫ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি আসবে। এখন হয়তো সেভাবে কেউ অনুধাবন করছে না। তবে রিজার্ভ ১৫ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি নেমে এলে দেশের চলমান মূল্যস্ফীতি আরও উপরের দিকে যাবে। ফলে দরিদ্র শ্রেণি-পেশার লোকদের ভোগের মাত্রা অনেকটাই কমে যাবে। বলতে গেলে দেশের অর্ধেক লোককে দুবেলার জায়গায় একবেলা খেয়ে থাকতে হবে। তারা দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যাবে। কারণ অর্থনৈতিক সংকটের ফলে জিনিসপত্রের দাম বাড়লে মূল্যস্ফীতির হুংকারও বাড়তেই থাকবে। অপরদিকে এসব লোকের তো আর আয়-রোজগার বাড়বে না। সুতরাং সংকটের আবর্তে পড়ে তারাই সবচেয়ে কষ্ট ভোগ করবে। এদিকে সুদের হার বাড়িয়ে দিয়েছে ব্যাংক। বিনিয়োগ কমে যাচ্ছে। বিদেশি কোনো বিনিয়োগ আসছে না বাংলাদেশে। গত এক বছরে কোনো বিদেশি বিনিয়োগ হয়নি বললেই চলে। শেয়ারবাজারে কিছু বিনিয়োগকারী এসেছিল; কিন্তু এখানে সুবিধা করতে না পেরে তারও চলে গেছে।
শেয়ারবাজারেও একটা স্থবিরতা বিরাজ করছে। এখন থেকে ১৫ মাস আগে গত বছরের জুলাইয়ে নির্দিষ্ট একটি ফ্লোর প্রাইস ঘোষণা দিয়ে শেয়ারবাজার নীরব ভ‚মিকা পালন করে যাচ্ছে। আর এ কারণে এটা এখন অনেকটা পঙ্গু হয়ে গেছে। মার্কেটে শেয়ার খুব একটা বেচাকেনা হচ্ছে না। শেয়ারবাজারের এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা যতটা সম্ভব হয়েছে বিক্রি করে নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছে। আর বাকিটা বিক্রি করতে পারছে না ওই ফ্লোর প্রাইসের কারণে। কেননা ফ্লোর প্রাইসে পড়ে থাকা শেয়ারের তো কোনো চাহিদা নেই। চাহিদা না থাকার কারণে বিক্রিও হচ্ছে না। যার ফলে এখানে অল্প কয়েকটা শেয়ার নিয়ে জুয়া খেলা হয়। প্রকৃত বিনিয়োগকারীরা শেয়ারবাজার থেকে আউট। কিছু ডে ট্রেডার বা যারা দৈনন্দিন ট্রেড করে, এরা কিছু অ্যাক্টিভ আছে, তবে এরাও সংখ্যায় খুব কম। যে শেয়ারবাজারে দৈনিক টার্নওভার হওয়া উচিত ছিল ২০০০-২৫০০ কোটি টাকা, সেখানে এখন দৈনিক টার্নওভার ৪০০ কোটি। শেয়ারবাজারে কিছু ভুল সিদ্ধান্তের কারণে আজকের এ পরিস্থিতি আমাদের হজম করতে হচ্ছে। যাই হোক, জাতীয় নির্বাচনের আগে শেয়ারবাজার নিয়ে সরকার হয়তো কিছু করবেও না।
তবে বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকাকে সচল করতে হলে একটা ভালো জাতীয় নির্বাচন প্রয়োজন। ভালো নির্বাচন বলতে আমি সবার অংশগ্রহণমূলক অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন বোঝাতে চাচ্ছি। প্রধান দলগুলোকে নিয়ে অর্থাৎ বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জাসদ, ইসলামি ঐক্যজোট ইত্যাদি সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে একটি নির্বাচন অনেক সমস্যার পথ দেখাবে। এদের অংশগ্রহণ ছাড়া জাতীয় নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না। বিদেশেও হবে না, দেশেও হবে না। একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হলে বিদেশিরাও বিনিয়োগ করবে, স্থানীয় লোকেরাও কাজেকর্মে ঝাঁপিয়ে পড়বে। দেশে বিনিয়োগ বেড়ে যাবে। তখন সুদের হার একটু কম বা বেশি, সেটা ম্যাটার করবে না। শেয়ারবাজারের ফ্লোর প্রাইসকেও খুব সহজে উঠিয়ে দেওয়া যাবে। ফ্লোর প্রাইস উঠে গেলে শেয়ারবাজারও চাঙ্গা হওয়া শুরু করবে। দেশের অর্থনীতিতে একটা চাঙ্গা ভাব ফিরে আসবে। আর যদি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন না হয়, তাহলে দেশে একটা রাজনৈতিক সংকট দেখা দেবে এবং সামাজিকভাবে একটা অস্থিরতা বিরাজ করবে। এতে করে বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হবে এবং দেশের অর্থনীতি খুবই দুরবস্থার দিকে যাওয়ার সমূহ আশঙ্কা রয়েছে।
একটি দেশের অর্থনীতির মাপকাঠি বলতে আমরা কী বুঝি? অর্থনীতির মাপকাঠি বলতে আমরা বুঝি একটা দেশের ফরেন এক্সচেঞ্জ রিজার্ভ, বিনিয়োগ, জিডিপির গ্রোথ রেট, প্রাইস লেভেল মুভমেন্ট এবং এক্সচেঞ্জ রেট। এ কয়েকটা বিষয় দিয়ে অর্থনীতি বিচার করা হয়। দেশের অর্থনীতির এ কয়েকটা বিষয় গত এক বছর থেকে আমাদের বিরুদ্ধে যাচ্ছে। যেমন, এক্সচেঞ্জ রেটের ক্ষেত্রে টাকার মূল্য বেশি হারিয়েছে। ইনফ্লেশান যেটা সাড়ে ৫ শতাংশ ছিল, সেটা এখন ১০ শতাংশে পৌঁছে গেছে। জিডিপি গ্রোথ রেট, যেটা সাড়ে ৭-এ ছিল সেটা ৫-এর মধ্যে নেমে এসেছে। বিনিয়োগ যেটা ছিল ২৯-৩০ শতাংশ, সেটা এখন ২২ শতাংশের দিকে নেমে এসেছে। বিদেশি বিনিয়োগ সরাসরি নেই বললেই চলে। সবকিছুই দেশের অর্থনীতিকে একটা নেগেটিভ সংকেত দিচ্ছে। বলতে গেলে যেসব বিষয় অর্থনীতির স্বাস্থ্যকে চাঙ্গা রাখে, তার সবগুলোই নেগেটিভ সংকেত বহন করছে। গত তিন বছরের মধ্যে এ বছর সবচেয়ে কম এলসি খোলা হয়েছে। ফলে দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আনা যাচ্ছে না বা আনা হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। যার ফলে এর একটা নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে দেশে। কাঁচামালের অভাবে অনেক কারখানা ও শিল্পপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হওয়ার উপক্রম হচ্ছে।
দেশে মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি, যেগুলো শেয়ারবাজারেও আছে, যেমন ব্রিটিশ-আমেরিকান টোব্যাকো কোম্পানি, গ্রামীণফোন, বার্জার পেইন্টস-এরা ডলার সংকটের কারণে তাদের ইন্টেরিম ডিভিডেন্ট দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। অর্থাৎ ডলার সংকটের কারণে এসব বিদেশি কোম্পানির বিদেশি শেয়ারহোল্ডারদের ডিভিডেন্ট পাঠাতে পারছে না। বিষয়টি শেয়ারবাজারের জন্য খুবই ক্ষতিকারক। কেননা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে যা আয় করা হয়েছে, সেটা ডলার সংকটের কারণে পাঠানো যাচ্ছে না। শেভরন অবশ্য দিচ্ছে, তবে সেটা সরকারের সঙ্গে চুক্তিতে এবং সরকার সেটা দিতে বাধ্য। কারণ দেরি হলে সেটা জরিমানাসহ দিতে হবে। গত কয়েক বছরে ৮০ হাজার কোটি টাকারও বেশি শুধু ক্যাপাসিটি চার্জ দিয়েছে সরকার। মানে বসিয়ে বসিয়ে তাদের টাকা দিতে হয়েছে সরকারের চুক্তির কারণে। সর্বোপরি এ বিষয়গুলোর কারণে দেশের পুরো অর্থনীতির জন্য একটা খারাপ সিগন্যাল যাচ্ছে। আসলে মাপের থেকে আমাদের কোট বড় করে কেটে ফেলেছি। আর কোট সেলাই করে ফেলেছি কাপড়ের কথা চিন্তা না করেই। কাপড়ের চিন্তা করে কোট সেলাই করলে আজকের এই দুর্দশা হতো না।
বর্তমানে সরকার বিভিন্ন সোর্স থেকে লোন নিতে চাচ্ছে। প্রাইভেট সোর্স থেকে সরকার সহজে লোন পাবে না। কারণ মোদিস, পিস, স্ট্যান্ডরস অ্যান্ড পুওর’স এ তিনটি আন্তর্জাতিক রেটিং কোম্পানি বাংলাদেশকে ডাউন রেট করে দিয়েছে। মানে ইন্টারন্যশনাল রেটিং কমিয়ে দিয়েছে। সুতরাং ক্যাশ পেমেন্ট ছাড়া কোনো এলসি খোলা যাবে না। বিদেশি কোনো রাষ্ট্র সহজে ঋণ দিতে চাইবে না। তবে সরকার হয়তো উচ্চ সুদে কিছু ঋণ আনতেও পারে। ওয়ার্ল্ড ব্যাংক থেকে নিতে পারে। সমস্যা হচ্ছে, বিশ্বব্যাংক থেকে ঋণ নিলে বা এডিবি থেকে, সে টাকা তো ঋণ পরিশোধে চলে যাবে। যেটা পাকিস্তানের ক্ষেত্রে হয়েছে। এক লোন করে আরেক লোন শোধ করে ওরা। কারণ লোন তো শোধ করতে হবে ডলারে। টাকা ছাপিয়ে তো আর লোন শোধ করা যাবে না। বিভিন্ন সোর্স থেকে ঋণ করে আরেক ঋণ পরিশোধ করা, এটা কোনো ভালো সাজেশন নয় এবং ভালো পথও নয়। দেশের একমাত্র ভালো পথ হচ্ছে রাষ্ট্রের খরচ কমানো। তবে সরকার ব্যয় সংকোচন নীতিতে নেই বললেই চলে। কারণ সরকার তো আগের মতোই জৌলুসের সঙ্গে খরচ করেই যাচ্ছে।
এখানে আরেকটা কথা যোগ করা উচিত, অর্থনীতি ডাউনে থাকলে ট্যাক্স কালেকশন কমে যাবে। ইচ্ছা থাকলেও ট্যাক্স কালেকশন বাড়াতে পারবে না সরকার। কারণ ভ্যাট বা ভ্যালু অ্যাডেড ট্যাক্স তো ট্রানজেকশনের সঙ্গে যুক্ত, বিনিয়োগের সঙ্গে যুক্ত। এমনকি করপোরেট ইনকাম ট্যাক্স এবং অন্যান্য ট্যাক্সও এর সঙ্গে যুক্ত। জিডিপি গ্রোথ রেট যদি সাড়ে ৭ শতাংশ হয়, তাহলে এক ধরনের ট্যাক্স কালেকশন হবে। সেটা যদি সাড়ে ৫ শতাংশ হয়, তাহলে ট্যাক্স কালেকশন অনেকটা কমে আসবে। সুতরাং সরকারের ঘাটতি বাজেট আরও বাড়তে পারে। এর থেকে পরিত্রাণের একমাত্র উপায় হচ্ছে সরকারকে কম খরচ করে দেশ পরিচালনা করা। নতুন প্রকল্প না নেওয়া। সরকারের উচিত ছিল আরও তিন বছর আগে থেকেই খরচ নিয়ন্ত্রণ করা। কিন্তু সরকার তা করেনি। স্কুলসহ অন্যান্য সেক্টরে সরকার যে খরচ বাড়াচ্ছে, সেখানে সরকারের আয় হবে না। যার ফলে শেষ পর্যন্ত সরকারকে টাকা ছাপাতে হতে পারে, যেটা দেশের অর্থনীতির জন্য মঙ্গলজনক হবে না। দেশের সিনিয়র অর্থনীতিবিদ প্রফেসর ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ বাংলাদেশ ব্যাংককে বলে আসছেন টাকা ছাপানো বন্ধ করতে। বাংলাদেশ ব্যাংক যদি ওই নীতিতে থাকতে পারে তো ভালো কথা। না হলে বিপদ বাড়বে বৈ কমবে না। (অনুলিখন : জাকির হোসেন সরকার)
আবু আহমেদ : অধ্যাপক ও অর্থনীতিবিদ