শতফুল ফুটতে দাও
পরিবর্তনকামী নেতৃত্বকে হতে হবে ভবিষ্যদ্দ্রষ্টা
ড. মাহবুব উল্লাহ্
প্রকাশ: ২৩ নভেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে।’ কেন একলা চলা? বর্তমান বিশ্ব নানা জঞ্জালে পরিপূর্ণ হয়ে আছে। এ জঞ্জাল সরানো এ মুহূর্তের মানুষদের কর্তব্য। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে জঞ্জাল সরাতে বেশির ভাগ মানুষই এগিয়ে আসে না। মুক্তিযুদ্ধের একপর্যায়ে খন্দকার মোশতাক আহমেদরা পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশন গঠনের আওয়াজ তুলেছিলেন। তারা বলছিলেন, যদি মুজিবকে ফিরে পেতে চাও, তাহলে স্বাধীনতার দাবি পরিত্যাগ করতে হবে। আর স্বাধীনতা চাইলে মুজিবকে হারাতে হবে। এমনই এক পরিস্থিতিতে মওলানা ভাসানী বলেছিলেন, যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলরে। কঠিন বাস্তবতা হলো, একলা চলে বিশাল কিছু, মহৎ কিছু অর্জন করা যায় না। একজন ব্যক্তির পক্ষে কি করা সম্ভব?
একজন মার্কিন দার্শনিক যখন একটি লেখা লিখছিলেন, তখন তিনি তার এক ভক্তের কাছ থেকে একটি চিঠি পান। ওই ভক্ত জানতে চেয়েছিলেন একজন ব্যক্তি কীভাবে ওই দার্শনিকের দর্শন ব্যাপক আকারে প্রচার করে মার্কিন সমাজজীবনের সর্বক্ষেত্রে পরিবর্তন আনতে সক্ষম হবেন। কীভাবে ব্যক্তির চেষ্টায় যুক্তরাষ্ট্রকে একটি আদর্শ রাষ্ট্রে পরিবর্তন করা সম্ভব? প্রশ্নটি যদি এভাবে করা হয়, তাহলে এর জবাব হলো-ব্যক্তিবিশেষের পক্ষে এ কাজটি করা সম্ভব নয়।
মনে করুন, একটি দেশে মহামারির মধ্যে একজন মাত্র চিকিৎসক আছেন। এ অবস্থায় চিকিৎসক বলবেন না কীভাবে একজন ডাক্তারের পক্ষে লাখ লাখ মানুষের মধ্যে চিকিৎসাসেবা দিয়ে দেশটিতে সুস্বাস্থ্য ফিরিয়ে আনা সম্ভব? চিকিৎসক জানবেন একা হোক অথবা একটি সংগঠিত চিকিৎসা অভিধানের অংশ হোক, চিকিৎসকের দায়িত্ব হবে যত সংখ্যক মানুষের চিকিৎসা করা সম্ভব তাদের সবার কাছে পৌঁছাতে হবে। চেষ্টা করতে হবে সর্বাত্মকভাবে। অন্য কোনো বিকল্প নেই।
শরীর ও মনের সম্পর্ক নিয়ে দর্শনে একটি আলোচনা আছে। এ আলোচনাটি হলো মন ও শরীরের বিচ্ছেদ। এর ফলে মানুষ বুদ্ধিবৃত্তিক সমস্যাকে যেভাবে দেখে, শারীরিক সমস্যাকে সেভাবে দেখে না। ফলে কেউ কি মহামারি থেকে রাতারাতি মুক্ত হওয়ার কথা ভাববে, অথবা এক হাতে বহুতল ভবন নির্মাণের কথা ভাববে? কোনো মানুষ কি তার জরাজীর্ণ বাসগৃহটি মেরামতের কথা ভাববে না যখন একটি গোটা শহরকে পুনর্নির্মাণ করতে হয়? মানুষ চেতনার জগতে, ভাবনার জগতে জ্ঞানকে অপ্রাসঙ্গিক মনে করে। তারা আশা করে মুহূর্তের মধ্যে আশ্চর্য কিছু করা সম্ভব, অথবা তারা লক্ষ্যটিকে অসম্ভব বিবেচনা করে বরফের মতো জমে গিয়ে নিস্পৃহ হয়ে পড়ে।
আপনি যদি গভীরভাবে চিন্তা করেন একটি ভালো পৃথিবীর জন্য লড়াই করব, তাহলে আমাদের শনাক্ত করতে হবে সমস্যার বৈশিষ্ট্যটি কী। এ লড়াই মূলত একটি বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াই, রাজনৈতিক নয়। রাজনীতি সবশেষে আসবে। বাস্তব প্রয়োগের ক্ষেত্রে আসবে। যেসব মৌলিক ধ্যানধারণা একটি জাতির সংস্কৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করে, সেক্ষেত্রে আসবে। কারও পক্ষেই পরিণতির বিরুদ্ধে লড়াই অথবা এর পরিবর্তন করা সম্ভব নয় এর মূল কারণকে পরিবর্তন না করে। কারও পক্ষেই কোনো পরিবর্তন বাস্তবায়ন সম্ভব নয় যদি কী বাস্তবায়ন করতে হবে সে সম্পর্কে স্বচ্ছ উপলব্ধি না থাকে।
বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াইয়ে সবাইকে নিজ পক্ষে আনার প্রয়োজন নেই। ইতিহাস নির্মিত হয়েছে সংখ্যালঘিষ্ঠদের দ্বারা। আরও সঠিকভাবে বলতে হলে বলতে হবে, ইতিহাস নির্মিত হয় বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। এসব আন্দোলন খুব বিরাটসংখ্যক মানুষের কাজ নয়। এই যে স্বল্পসংখ্যক মানুষ, তাদের মধ্যে কারা আছেন? আছেন এমন সব লোক, যারা বুদ্ধিবৃত্তিক ইস্যুগুলো নিয়ে সক্রিয়ভাবে সংযুক্ত হতে চান। এক্ষেত্রে পরিমাণ নয়, গুণই আসল কথা। একটি বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলন সক্রিয় কার্যকলাপের দ্বারা শুরু হয় না। কাদের সংগঠিত করতে হবে? দার্শনিক লড়াই মানুষের মনকে জয় করার লড়াই। এটি অন্ধ অনুসারী সৃষ্টির কাজ নয়। ধ্যানধারণা তারাই প্রচার করবেন, যারা এগুলো বোঝেন এবং জানেন। একটি সংগঠিত আন্দোলন শুরু হওয়ার আগে শিক্ষামূলক প্রচার-প্রচারণা দরকার। এর জন্য প্রয়োজন প্রশিক্ষিত অথবা আত্মপ্রশিক্ষিত শিক্ষকগোষ্ঠী। আত্মপ্রশিক্ষিত বলতে বোঝানো হয় একজন দার্শনিক অন্যকে জ্ঞানের বিষয়বস্তুগুলো সরবরাহ করতে পারেন, কিন্তু অন্যদের এগুলো আত্মস্থ করতে হয় নিজ নিজ মন দিয়ে। এ ধরনের প্রশিক্ষণ প্রয়োজন হয় আদর্শগত মহামারি সময়ের চিকিৎসকদের জন্য। একটি দেশের যখন অজ্ঞানতা, কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস ঘোর অন্ধকারের সৃষ্টি করে, তখন একে মহামারির সঙ্গে তুলনা করা যায় এবং এ অন্ধকার দিনে আত্মপ্রশিক্ষিত মানুষগুলোর পক্ষেই কিছু হেরফের ঘটানো সম্ভব।
মার্কিন সমাজে জীবনের সর্বক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন আনার কথা যদি কেউ ভাবে, তাহলে সেই পরিবর্তন একাকী খণ্ড অথবা খুচরাভাবে করা সম্ভব নয়। একটি ক্রুসেডার বাহিনী দিয়ে সেটা করা সম্ভব নয়। মানুষের জীবনের সর্বক্ষেত্রে যে নিয়ামকগুলো কাজ করে, তার মূলে রয়েছে দর্শন। মানুষকে সঠিক দর্শনের শিক্ষা দিন। এর ফলে তাদের মনে যে পরিবর্তন আসে, সেই পরিবর্তনের ফলে তাদের মন বাকি কাজগুলো করবে। মানবিক বিষয়াবলিতে দর্শন পাইকারি ব্যবসার ভূমিকা পালন করে।
কোনো ধরনের দর্শন ছাড়া মানুষের অস্তিত্ব বজায় রাখা সম্ভব নয়। জীবন সম্পর্কে মানুষের সর্বব্যাপী ধারণা থাকতে হয়। অধিকাংশ মানুষ বুদ্ধিবৃত্তিক উদ্ভাবক নন। কিন্তু তারা ধ্যানধারণাগুলো শুনতে চান। তারা যুক্তি দিয়ে বিচারবিশ্লেষণ করতে পারে এবং শেষ পর্যন্ত সঠিক পথটি বেছে নিতে পারে। অবশ্য একজন মানুষের সামনে সঠিক ধারণাটি তুলে ধরতে হবে। সমাজে অনেক মানুষ আছে, যারা বিভিন্ন মতাদর্শ সম্পর্কে উদাসীন। এ মানুষগুলো তাদের তাৎক্ষণিক স্বার্থের বাইরে অন্যকিছু শুনতে চায় না। এসব মানুষ তাদের অবচেতন মনে তাদের যুগের সংস্কৃতি যে ধারণার জন্ম দেয়, সেগুলোই গ্রহণ করে। এরা হলো সামাজিক নুড়ি পাথর, হতে পারে তারা দিনমজুর অথবা কোম্পানির প্রেসিডেন্ট। তারা নিজের পছন্দের কথাই ভাবে, পৃথিবীর ভাগ্য ও পরিণতি নিয়ে ভাবতে চায় না।
আজকের দিনে বেশির ভাগ মানুষ সাংস্কৃতিক ও আদর্শিক শূন্যতা সম্পর্কে সচেতন। তারা উদ্বিগ্ন কিন্তু বিভ্রান্ত। তারা প্রশ্নের জবাব খুঁজে বেড়াচ্ছেন। কেউ কি তাদের আলোকপ্রাপ্ত করতে পারেন? কেউ কি তাদের প্রশ্নগুলোর জাবাব দিতে পারেন? কারও কি জানা আছে কীভাবে তাদের ভুলগুলো শোধরানো সম্ভব? আজকের পৃথিবীতে যুক্তিসংহারের অভিযান চলছে। কে বলতে পারে সে এই যুক্তিসংহারের তেজস্ক্রিয়তা থেকে মুক্ত? যুক্তিহীনতার তেজস্ক্রিয়তাকে রুখতে কারও কাছে কি অ্যান্টি মিসাইল আছে? একটি রাজনৈতিক লড়াই হলো একটি সংঘর্ষ, যেখানে মাস্কেটের ব্যবহার হয়, একটি দার্শনিক লড়াই হলো পারমাণবিক যুদ্ধের মতো।
বাংলাদেশে এ মুহূর্তে যে রাজনৈতিক অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, এর জন্য মূলত দায়ী যুক্তিহীনতার সংস্কৃতি। অত্যন্ত অর্বাচীনভাবে জাতীয় সমস্যাগুলোকে বিচারবিশ্লেষণ করার ফলে আজকের এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। রাজনীতিতে এমন কোনো রাষ্ট্রনায়কের দেখা নেই, যিনি আপাতভাবে অজনপ্রিয় অবস্থানকে আলিঙ্গন করে জাতির ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারেন। যে সামাজিক শ্রেণি রাজনীতিতে প্রাধান্য বিস্তার করে আছে, তাদের সম্পর্কে মার্কসের ভাষায় বলা যায়, “এদের নিজেদের ওপর আস্থা নেই, ঊর্ধ্বতনের প্রতি অসন্তুষ্ট, অধস্তনের সম্মুখে কম্পমান, উভয় পক্ষের প্রতি স্বার্থপর ও সে স্বার্থপরতা সম্বন্ধে সচেতন, রক্ষণশীলদের কাছে বিপ্লবী এবং বিপ্লবীদের কাছে রক্ষণশীল, নিজেদের আদর্শ সম্বন্ধে অবিশ্বাসী, আদর্শের বদলে বাগাড়াম্বরপ্রিয়, বিশ্বঝঞ্ঝায় আতঙ্কিত, বিশ্বঝঞ্ঝাকেই নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করতে তৎপর, কোনো ব্যাপারেই উদ্বেগ নেই এবং প্রতি ব্যাপারেই ‘কুম্ভিলকবৃত্তি’, মৌলিকতার অভাবে মামুলি-আবার মামুলিপনার ক্ষেত্রে মৌলিক, নিজেদের ওপর আস্থাহীন, জনগণের প্রতি আস্থাহীন, নিজেদের আকাঙ্ক্ষা সম্পর্কে দরকষাকষিতে মত্ত, উদ্বেগহীন এবং বিশ্ব ঐতিহাসিক ভূমিকাহীন, একটি বলিষ্ঠ জাতির প্রথম যৌবনের উত্তেজনাকে পরিচালিত ও স্থায়ী স্থবির স্বার্থে তাকে বিচ্যুত করার দায়িত্ব দণ্ডিত এক জঘন্য বৃদ্ধ চক্ষুহীন, কর্ণহীন, দন্তহীন, সর্ব ইন্দ্রিয়হীন।”
ড. মাহবুব উল্লাহ : শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ