সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন হোক উৎসবমুখর
নীলকণ্ঠ আইচ মজুমদার
প্রকাশ: ২০ নভেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ইতোমধ্যে নির্বাচনের তফশিল ঘোষণা করা হয়েছে। আগামী ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে; কিন্তু নির্বাচন নিয়ে প্রশ্নের শেষ হচ্ছে না। নির্বাচনে যদি কোনো বড় দল অংশগ্রহণ না করে, তাহলে সমস্যা আরও বেড়ে যায় নিঃসন্দেহে। কী হচ্ছে? কী হবে? হাজারও প্রশ্ন সাধারণ মানুষের মনে ঘুরপাক খাচ্ছে। বিএনপি কি নির্বাচনে আসবে, নাকি বাধা দেওয়ার চেষ্টা করবে। যতই দিন ঘনিয়ে আসছে, উত্তেজনা যেন ততই বাড়ছে। পাশাপাশি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে বিশেষ করে, যুক্তরাষ্ট্রের মাথাব্যথার শেষ নেই। যদি বিএনপিকে ছাড়াই নির্বাচন হয়, তাহলে পরবর্তীকালে কী হবে? যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপীয় ইউনিয়ন কী করবে পরবর্তীকালে? অনেক প্রশ্নের মধ্যেই নির্বাচন কমিশন এগিয়ে যাচ্ছে নির্বাচনের দিকে। সময় যতই সামনে আসছে, মানুষের মনে ভয়ভীতিও ততই বেড়ে চলছে। গণতান্ত্রিক দেশে নির্বাচন হওয়ার কথা একটি উৎসব; কিন্তু এক পক্ষকে আরেক পক্ষ কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছে না। রাজনীতির প্রধান বিষয়ই হলো মানুষের পাশে থাকা। নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতার মসনদে বসা। জনগণের মন জয় করে ভোট আদায় করা, কিন্তু কোথায় যেন এ তালটা হারিয়ে গেছে। রাজনৈতিক দলগুলো তাদের নিজের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। চলছে এক পক্ষের কথার বাণে অন্য পক্ষকে ঘায়েল করার প্রক্রিয়া। কথার প্রক্রিয়াটা ঠিক ছিল, কিন্তু চলে এসেছে হামলা-মামলা। চলছে দেশের ক্ষতি করার কার্যক্রম। কোনো দল আবার নিজের কর্তৃত্বের ওপর বিশ্বাস হারিয়ে অন্য দেশের কাছে নিজেদের হতাশার কথা ব্যক্ত করে নির্বাচনে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
প্রকৃতপক্ষে দেশের প্রতি ভালোবাসার জায়গাটা ক্ষমতার লোভের কাছে বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। প্রতিটি দলই একবার ক্ষমতায় যাওয়ার পর ভিন্ন ভিন্ন কৌশলে পুনরায় ক্ষমতায় থাকার চেষ্টা করেছে জনগণের মতামতকে উপেক্ষা করে। প্রতিবারই নির্বাচন ঘিরে দলগুলোর মধ্যে তৈরি হয় বৈরিতা। তৈরি করা হয় ক্ষমতায় যাওয়ার বিভিন্ন কৌশল। আর এসব কৌশল নিয়ে মাঠে ঝড় তোলা। ইতোমধ্যে দেশের প্রধান দুই দলই রয়েছে দুই মেরুতে। সাধারণ মানুষের আশার বিষয়গুলোর সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর চাওয়ার ব্যাপক ফারাক। সুশীল সমাজও এখন বিভক্ত বলেই মনে হয়। এখন তৈরি হয়েছে দলীয় সুশীল সমাজ। দুদলেরই পালটাপালটি কর্মসূচি চলছে রাজপথ দখলের। কেউ কাউকে ছাড় দিতে রাজি নয়। দায়িত্বশীলদের মুখের কথা এক। সবাই অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন চায়। বিরোধী শিবির সরকার পক্ষের ওপর আস্থা রাখতে পারছে না, অন্যদিকে সরকারি দল সংবিধানের বাইরে যেতে চাচ্ছে না। যথাসময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানে অবিচল সরকার। পৃথিবীর কিছু প্রভাবশালী দেশ এ দেশের নির্বাচন নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে অনেক বেশি। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, তাদের নিজের দেশের নির্বাচন নিয়েও এত মাথাব্যথা নেই। এসব দেশ এমন চাপ প্রয়োগ করছে যে, নির্বাচন তাদের কথা মতোই হতে হবে। আমাদের দেশের রাজনৈতিক নেতাদের সমঝোতার অভাবেই তৃতীয় পক্ষ এ সুযোগটা নিচ্ছে, এটি অস্বীকার করা যাবে না। বিভিন্ন ধরনের নিষেধাজ্ঞার ভয় দেখাচ্ছে বার বার। এতসব ঝামেলার মধ্যেও নির্বাচন কমিশন তাদের নির্বাচনের প্রস্তুতির ঘাটতি রাখছে না। নির্বাচন কমিশন বার বার নিরপেক্ষতার কথা বললেও সেদিকে বিশ্বাস স্থাপন করতে পারছে না বিরোধী দলগুলো। তাদের দাবি, এ নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়, যদি বর্তমান সরকার ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় নির্বাচন হয়। অন্যদিকে সংবিধানের আলোকে নির্বাচন করতে বদ্ধপরিকর বর্তমান সরকার। আজকে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কথা বলা হয়েছে, তা নিয়ে জল ঘোলা কম হয়নি।
তাই এ বিষয়টি নিয়ে একটু পূর্বে ফিরে যাওয়া প্রয়োজন। বর্তমান মাঠের বিরোধী দল তখনকার সময়ে সরকারি দলে ছিল। আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে গেছেন সংবিধান যেন সংশোধন না করতে হয়; কিন্তু তখনকার বিরোধী দলের চাপে পড়ে তড়িঘড়ি করে সংবিধান পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছিল। অসহযোগ আন্দোলনের মধ্যেই খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে নতুন মন্ত্রিপরিষদ গঠিত হয় এবং ষষ্ঠ সংসদের প্রথম অধিবেশন বসে। কিন্তু সারা দেশে চরম বিশৃঙ্খল অবস্থার সৃষ্টি হয়। এরপর সরকার ২১ মার্চ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিল সংসদে উত্থাপন করে। ২৬ মার্চ সরকার নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিল জাতীয় সংসদে পাশ করেন। পরবর্তীকালে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে ৩০ মার্চ রাষ্ট্রপতি ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ ভেঙে দেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার মূল বিষয় হলো দুটি নির্বাচিত সরকারের মধ্যবর্তী সময়কালে সাময়িকভাবে অনির্বাচিত ব্যক্তিরা দেশের শাসনভার গ্রহণ করবেন; যার কাজ হবে দৈনন্দিন কার্যাবলি সম্পাদন করা। এ সরকার কোনো নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারবে না এবং শান্তিপূর্ণ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সরকার নির্বাচন কমিশনকে সার্বিকভাবে সাহায্য করবে; কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকার এর বাইরে গিয়েও কাজ-কর্ম করেছে বিগত সময়ে। এমনকি নিজেদের লোককে সরকারে বসানোর জন্য বিভিন্নভাবে কূটচাল প্রয়োগ করেছে ক্ষমতাসীনরা। যার ফলে পরবর্তীকালে এ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিভিন্নভাবে বিতর্কিত হয়েছে। তাই এ ব্যবস্থাটি বর্তমান সরকারি দলের কাছে আস্থা হারায়। বিরোধী দলে থাকলেই কেবল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অভাব টের পাওয়া যায়। ২০১১ সালের ১০ মে বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের রায় দেন। এছাড়া বাংলাদেশের সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে এ সরকারব্যবস্থাকে বাতিল করা হয়। প্রতিবারই নির্বাচনের সময় একটি অস্থিতিশীল পরিবেশের সৃষ্টি হয় এবং শুরু হয় বিদেশিদের দৌড়ঝাঁপ। এবারও এর ব্যতিক্রম নয়। চলছে হরতাল-অবরোধের মতো সহিংস ঘটনা। সম্পদের ক্ষতির পাশাপাশি হচ্ছে প্রাণহানি। অর্থনীতির চাকা চলছে উলটো পথে। এদিকে কারও তাকানোর সময় নেই; যে কোনো মূল্যে ক্ষমতা প্রয়োজন। মানুষের চাওয়াকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে সবাই নিজের পথেই হাঁটছে। সাধারণ মানুষের চাওয়া একটি অবাধ, শান্তিপূর্ণ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন, যেখানে সাধারণ মানুষ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবে। দীর্ঘদিন ধরে আওয়ামী লীগ সরকারে থাকায় মাঠের বড় বিরোধী দল এখন অস্থির হয়ে পড়ছে। বিগত দুটি নির্বাচন নিয়ে বিরোধী দল সবচেয়ে বেশি অভিযোগ উত্থাপন করেছেন। তাই তারা বর্তমান সরকারের অধীনে আর নির্বাচন করতে ইচ্ছুক নয়। অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা আর ফিরিয়ে আনতে নারাজ বর্তমান সরকার। তাই এখান থেকে একে অপরের প্রতি আস্থা বাড়িয়ে সংবিধানের আলোকে সুষ্ঠু, অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পথ খোঁজা উচিত। সবার প্রত্যাশামাফিক আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন হোক উৎসবমুখর।
নীলকণ্ঠ আইচ মজুমদার : শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক
nilmajumdar81@fmail.com