গৌরবদীপ্ত ইতিহাসের অনালোচিত অধ্যায়
বিমল সরকার
প্রকাশ: ১৬ নভেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
কোনো কিছুর সংস্কার করা সহজ কোনো কাজ নয়। সংস্কার করতে হলে মেধা ও প্রজ্ঞার দরকার। আরও দরকার হয় দূরদৃষ্টির। সংস্কার যে কোনো ক্ষেত্রে এবং যে কোনো সময়ই হতে পারে। তবে খেয়াল রাখতে হবে তা জনকল্যাণকর কিনা। আর এর ভবিষ্যৎই বা কী।
এ উপমহাদেশে আধুনিক শিক্ষার গোড়াপত্তন হয় ইংরেজদের হাত ধরে। উনিশ শতকের প্রথমার্ধে শুরু হলেও ইংরেজি শিক্ষা কাঠামোগত রূপ লাভ করে একই শতকের দ্বিতীয়ার্ধে। ১৮৫৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়। মাধ্যমিক স্তরে এ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনেই অনুষ্ঠিত হয় প্রথম এন্ট্রান্স পরীক্ষা। এন্ট্রান্স কিংবা মেট্রিকুলেশন নাম যাই হোক, ব্রিটিশ শাসন, এমনকি পাকিস্তান আমলেও এখানে মাধ্যমিক স্তরে কোনো বিভাগ-বিভাজন ছিল না। ১৯৬২ সালে মেট্রিক-এর স্থলে এসএসসি এবং নবম শ্রেণি থেকে বিজ্ঞান, মানবিক ও বাণিজ্য এমনসব বিভাগ-বিভাজন চালু করা হয়।
প্রথমে এন্ট্রান্স, পরে মেট্রিকুলেশন। এ উপমহাদেশে মাধ্যমিক স্তরে মেট্রিক পরীক্ষা বলবৎ থাকে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত। পরে একে এসএসসি বা মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট-এ রূপ দিয়ে তা ১৯৬৩ সাল থেকেই কার্যকর করা হয়। প্রায় একই সময় ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের মতোই কুমিল্লা, রাজশাহী ও যশোরে পৃথক শিক্ষা বোর্ড স্থাপন করা হয়।
এ সময় শিক্ষাব্যবস্থায় বেশকিছু পরিবর্তন আনা হয়। আকস্মিক এ পরিবর্তনের ফলে ছাত্র ও গণঅসন্তোষ প্রকট আকার ধারণ করে। দেখা দেয় নানা ধরনের সমস্যা ও বিপত্তি-বিড়ম্বনা। এমন পরিস্থিতিতে বছর না যেতেই ব্যাপক আন্দোলনের মুখে সরকার পরিবর্তনগুলোর বেশ কিছু বাতিল করতে বাধ্য হয়।
পাকিস্তানের স্বঘোষিত প্রেসিডেন্ট ও সামরিক শাসক হিসাবে আইয়ুব খানের ক্ষমতা দখল, তড়িঘড়ি করে শিক্ষা কমিশন (শরীফ কমিশন) গঠন, কমিশনের রিপোর্টে উল্লিখিত গণবিরোধী সব সুপারিশমালা বাতিলের দাবিতে দেশব্যাপী গড়ে ওঠা দুর্বার সব আন্দোলনের কাছে নতি স্বীকার-এসবই আজ ইতিহাসের অংশ। কিন্তু সেই গৌরবদীপ্ত সময়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের অনেকটা আজও অনালোচিতই রয়ে গেছে।
কী কী পরিবর্তন আনা হয়েছিল শিক্ষাব্যবস্থায় সে সময়? পাকিস্তান আমলে শুরু থেকেই দশম শ্রেণির পাঠ বা বছর শেষে এক হাজার নম্বরের মেট্রিক পরীক্ষা অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু ১৯৬২ সালে নবম শ্রেণিতে ৪০০ (এসএসসি প্রথম পর্ব) আর ১৯৬৩ সালে দশম শ্রেণিতে ৬০০ (এসএসসি দ্বিতীয় পর্ব) দুই বছরে মোট ১০০০ নম্বরের পরীক্ষা নেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। এছাড়া ‘সমাজবিদ্যা’ (Social Studies) নামে ১০০ নম্বরের নতুন একটি বিষয় (আবশ্যিক) চালু করা হয়। নতুন ব্যবস্থায় নবম শ্রেণিতে শিক্ষার্থীরা ১. বাংলা প্রথমপত্র ২. ইংরেজি প্রথমপত্র ৩. সাধারণ গণিত ও ৪. সমাজবিদ্যা এ চারটি বিষয় বা পত্রে মোট ৪০০ নম্বরের পরীক্ষা দেয়। পরের বছর (১৯৬৩) দশম শ্রেণিতে তারা ১. বাংলা দ্বিতীয়পত্র ২. ইংরেজি দ্বিতীয়পত্র এবং বিভাগওয়ারি (বিজ্ঞান, মানবিক, বাণিজ্য প্রভৃতি) চারটি ঐচ্ছিক বিষয়ে মোট ৬০০ নম্বরের পরীক্ষা দেয়।
সবচেয়ে অদ্ভুত ও শিক্ষার্থীদের জন্য চরম বিড়ম্বনার কারণ হয়ে দাঁড়ায়, বছর শেষ হয়ে এলেও সরকারের পক্ষে নতুন পাঠ্যবই প্রণয়ন ও প্রকাশ করতে না পারার বিষয়টি। শিক্ষা ক্ষেত্রে এমন লেজেগোবরে পরিস্থিতি অতীতে আর কখনো ঘটেছে বলে জানা যায় না। নবম শ্রেণির পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের শিরোনামে উল্লেখ করা হয় বাংলা ‘প্রথমপত্র’, কিন্তু তাতে দেওয়া আছে সব ‘দ্বিতীয় পত্র’ বা ব্যাকরণ অংশের প্রশ্ন। এমনটি হওয়ার মূল কারণ হিসাবে জানা যায়, বাংলা প্রথমপত্রের বই ছাপানোর ব্যর্থতা। অনেকটা ‘গাড়ির আগে ঘোড়াজুড়ে দেওয়ার’ অবস্থা! হামুদুর রহমান শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে দুর্বার ছাত্র আন্দোলন এবং কর্তৃপক্ষের নানা টালবাহানায় প্রতিষ্ঠানগুলোয় ফাঁকে ফাঁকে অল্প কিছু ক্লাস অনুষ্ঠিত হলেও এর ওপর পরীক্ষায় ১০০ নম্বরের প্রশ্নপত্র তৈরি করাটা ছিল বাস্তবিক অর্থে এক দুরূহ কাজ। তাই নবম শ্রেণিতে বাংলা প্রথমপত্রের প্রশ্নপত্রে কেবল দ্বিতীয়পত্রের বিষয়াদি উল্লেখ করেই কর্তৃপক্ষ থেমে থাকেনি, উপরন্তু ব্যাকরণের প্রশ্নকে এমন অদ্ভুতভাবে বিন্যাস করা হয়, যা অতীতে আর কখনো লক্ষ করা যায়নি। যেমন ব্যাকরণ অংশে প্রশ্ন করা হয় ৬০ নম্বরের আর বাকি সবকিছুর জন্য (রচনা, চিঠি এবং আবেদনপত্র, সারাংশ ও ভাবসম্প্রসারণ) ৪০ নম্বর। এ যেন উলটোপথে হাঁটা (বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষায় বাংলা দ্বিতীয়পত্রে অন্যসব কিছুর তুলনায় ব্যাকরণ অংশে সাধারণত নম্বর কম থাকে)। এমনটা ছিল শুধু বাংলা বিষয়ের ক্ষেত্রে। ওই পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের মজা করে এখনো বলতে শোনা যায়, ‘আহা, প্রশ্নপত্রের শিরোনাম প্রথমপত্র, কিন্তু ভেতরের সব প্রশ্নই দ্বিতীয় পত্রের!’ শুধু কি তাই? পরীক্ষায় উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের বোর্ড থেকে যে সনদপত্র প্রদান করা হয়, তাতেও বাংলা বিষয়ে গোঁজামিল রক্ষা করে নবম শ্রেণির প্রথম পর্বে প্রথমপত্র এবং দশম শ্রেণির দ্বিতীয় পর্বে দ্বিতীয়পত্রের কথা উল্লেখ করা হয় (বাস্তবে ছিল সম্পূর্ণ উলটো; নবম শ্রেণিতে দ্বিতীয় আর দশম শ্রেণিতে প্রথম পত্র!)।
ইংরেজি বিষয়েও আনা হয় বড় আকারের পরিবর্তন। ইংরেজি প্রথম পত্রের ১০০ নম্বরের জন্য তিনটি নতুন বই চালু করা হয় : ১. সেভেন অ্যাডভেঞ্চার্স ২. সেভেন ইনভেন্টার্স ও ৩. গালিভার্স ট্রাভেলস। পরীক্ষাটি নবম শ্রেণিতে ১৯৬২ সালেই অনুষ্ঠিত হয়। পরের বছর ১৯৬৩ সালে দশম শ্রেণিতে অনুষ্ঠিত হয় ইংরেজি দ্বিতীয়পত্র।
অবশ্য এসএসসি পরীক্ষা দুই বছরে ভাগ করে নবম ও দশম শ্রেণিতে নেওয়ার ব্যবস্থা এবং আবশ্যিক নতুন বিষয় হিসাবে সমাজবিদ্যা ১৯৬৩ সালের পর বাতিল হয়ে যায়। পাকিস্তান আমলে এইচএসসি বা উচ্চমাধ্যমিকে থাকলেও আমাদের ভূখণ্ডে ১৯৬৩ সালের আগে ও পরে আর কখনো দুই বছরে এসএসসি পরীক্ষা অনুষ্ঠানের কোনো নজির নেই। দুই বছরে এসএসসি চূড়ান্ত পরীক্ষা (৪০০+৬০০); বিস্ময়করই বটে!
ছাত্র-জনতাকে দমনে তখন রক্তপাতও হয়েছিল। বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলনের গৌরবদীপ্ত সেই সব ঘটনা নতুন প্রজন্মের সামনে তুলে ধরা দরকার।
বিমল সরকার : অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক, কলাম লেখক