Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

কবে বাস্তবে রূপ নেবে তিনবিঘা এক্সপ্রেস?

Icon

মনজু আরা বেগম

প্রকাশ: ১৩ নভেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

কবে বাস্তবে রূপ নেবে তিনবিঘা এক্সপ্রেস?

ফাইল ছবি

দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে রেলের গুরুত্ব ও ভূমিকা অপরিসীম। পৃথিবীর জনসংখ্যাবহুল দেশগুলোয় রেলপথ গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। কিন্তু আমাদের দেশের রেলপথ সে স্থানটি দখল করতে পারছে না। বরং এটি বর্তমানে লোকসানি খাত হিসাবেই সর্বত্র বিবেচিত হচ্ছে। বাংলাদেশ রেলওয়ে একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠান। ১৮৬২ সালের ১৫ নভেম্বর ব্রিটিশ আমলে এর জন্ম। স্বাধীনতার ৫২ বছরে দেশে অনেক খাতের উন্নয়ন ঘটলেও এ খাতটির কোনো উন্নয়ন হচ্ছে না। উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণে রেলপথ এগিয়ে থাকলেও প্রকল্প বাস্তবায়নে অনেক পিছিয়ে। পৃথিবীর সব দেশেই রেলপথ যাত্রাকে সবচেয়ে নিরাপদ ও সাশ্রয়ী মনে করা হয়। এ কারণে দেশের জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ রেলেই ভ্রমণ করে। জানা যায়, বছরে প্রায় ১০ কোটিরও বেশি মানুষ রেলে ভ্রমণ করেন। রেলে যাত্রীসেবার মান বাড়াতে সরকার কর্তৃক ট্রেনের সংখ্যা বৃদ্ধি, রেল সংযোগ বৃদ্ধি, বগি-কোচ বৃদ্ধি, বিদ্যমান ট্রেনগুলোর দরজা-জানালা, ট্রেনের কামরা, আসন, কেবিন ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের সংস্কারমূলক কাজ সম্পাদনের জন্য মোটা অঙ্কের অর্থ বরাদ্দ রাখা হয়। শুধু তাই নয়, জানা যায় ট্রেনের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বাবদই বছরে ৭ কোটি টাকার বিল করা হয়। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য, এত বিরাট অঙ্কের অর্থ ব্যয় করেও এসবের কোনো সেবা যাত্রীরা পান না। অধিকাংশ স্টেশন বা ট্রেনে বসার কোনো সুব্যবস্থা নেই। বাথরুমে পানি আছে তো লাইট নেই, লাইট আছে তো পানি নেই। বৃষ্টির সময়ে ভাঙা জানালা দিয়ে পানি ঢুকে, তখন যাত্রীদের দুর্ভোগের সীমা থাকে না। প্রয়োজনের সময় ট্রেনের অ্যাটেনডেন্টকে খুঁজেও পাওয়া যায় না। বর্তমানে ৪৯৩টি স্টেশন এবং ৩৬৭টি যাত্রীবাহী ট্রেন সচল রয়েছে। এসব ট্রেনের অধিকাংশরই অবস্থা কম-বেশি সমান।

তুলনামূলকভাবে দেশের উত্তরাঞ্চলের ট্রেন ও স্টেশনের অবস্থা অত্যন্ত করুণ। আরামদায়ক জার্নির কথা ভেবে ট্রেনে মাঝেমধ্যে ভ্রমণ করতে গিয়ে চরম বিড়ম্বনায় পড়তে হয়েছে। ট্রেনের সময়সূচি অনুযায়ী ট্রেন ছাড়ে না। নয়টার ট্রেন কয়টায় যাবে তার কোনো ঠিক নেই। এসি কোচগুলোর অবস্থাও তথৈবচ। অথচ দেশের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়নে রেলের গুরুত্ব অপরিসীম। যোগাযোগব্যবস্থার মধ্যে রেল খাত সবচেয়ে সম্ভাবনাময় হলেও এটি একটি অবহেলিত খাত হিসাবেই এদেশে রূপ নিয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে অধিকাংশ রেল ও রেলস্টেশনগুলো জরাজীর্ণ অবস্থায় পড়ে থাকলেও এগুলো যথাযথ সংস্কারের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না। লোকবলের অভাবে বেশকিছু স্টেশন ইতোমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। জানা যায়, এক টাকা আয় করতে রেলের ব্যয় হয় ৬ টাকা। ২০২০-২১ অর্থবছরে রেল আয় করেছে ১ হাজার ১৩ কোটি টাকা; কিন্তু এ সময়ে ব্যয় করতে হয়েছে ৬ হাজার ২৫ কোটি টাকা। ২০১৯-২০ অর্থবছরেও রেল ১ হাজার ১৩৭ কোটি টাকা আয় করতে ব্যয় করেছে ৫ হাজার ৮৮২ কোটি টাকা (যুগান্তর, ২৩.০১.২২)। এভাবে প্রতিবছরই বিপুল অঙ্কের অর্থ লোকসান দিয়ে রেল চলছে। সেবার মানেও কোনো উন্নতি নেই।

উত্তরবঙ্গের লালমনিরহাট জেলা পাঁচটি উপজেলা নিয়ে গঠিত। এখানে একটি রেলওয়ে জংশন আছে। এখান থেকে বুড়িমারী স্থলবন্দর পর্যন্ত রুটটিকে বলা হয় বিডিআর (বেঙ্গল ডুয়ার্স রেলওয়ে) লাইন। বুড়িমারী থেকে লালমনিরহাট জেলা সদরের দূরত্ব ৯০ কিলোমিটার। এ রুটে ট্রেন কখন আসে আর কখন যায়, তা নিশ্চিত করে বলা কঠিন। বুড়িমারী স্থলবন্দর হওয়ার কারণে যদিও এ রুটের গুরুত্ব অনেকটাই বেড়ে যাওয়ার কথা; কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। অথচ বুড়িমারী স্থলবন্দর দিয়ে ভারত, ভুটান ও নেপাল থেকে কয়লা, কাঠ, টিম্বার, পাথর, সিমেন্ট, চায়না ক্লে, কোয়ার্টজ, রাসায়নিক সার, গবাদি পশু, কসমেটিক সামগ্রী, পশুখাদ্য, বিভিন্ন ধরনের তৈজসপত্র, ফলমূল, পেঁয়াজ, রসুন, আদা, চাল, ডাল, গম, বিভিন্ন ধরনের বীজ, তামাক ডাঁটা ইত্যাদি পণ্যসামগ্রী আমদানি করা হয়। অন্যদিকে বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি করা হয় ইলিশ, মেলামাইনের তৈরি বাসনপত্র, ওষুধ, শাড়ি-কাপড়সহ বিভিন্ন সামগ্রী। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বুড়িমারী স্থলবন্দর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। যোগাযোগব্যবস্থা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল ইত্যাদিসহ সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের বিভিন্ন দিক থেকে বাংলাদেশের সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া অনুন্নত এলাকা সম্ভবত এটাই। পিছিয়ে পড়ার কারণে এ এলাকার অধিকাংশ মানুষই আর্থিক দিক থেকে সাশ্রয়ী, নিশ্চিত ও নিরাপদ ভ্রমণের জন্য এবং যানজটের কবল থেকে রক্ষা পাওয়াসহ বিভিন্ন কারণে রেলে ভ্রমণ করতেই স্বচ্ছন্দবোধ করেন। এখানে যোগাযোগের মাধ্যম হিসাবে বাস সার্ভিস চালু থাকলেও লাগেজ বা মালামাল নিয়ে বাসে ভ্রমণের ঝক্কি-ঝামেলা অনেক এবং ভাড়াও রেলের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। সড়কের চেয়ে রেলে দুর্ঘটনা অপেক্ষাকৃত কম হওয়ায় মানুষ রেল ভ্রমণেই স্বচ্ছন্দবোধ করেন বেশি। এ ছাড়াও তুলনামূলকভাবে রেলের ভ্রমণ বাসের চেয়ে আরামদায়ক। তাই এ এলাকার অধিকাংশ মানুষ, বিশেষ করে দরিদ্র ও নিুমধ্যবিত্ত শ্রেণি রেলের ওপর নির্ভরশীল।

এ অঞ্চলের অনেক স্টেশনে সুইপার বা ক্লিনার না থাকায় দুর্গন্ধে স্টেশনে দাঁড়ানোর পরিবেশ নেই বললেই চলে। ওয়েটিং রুমগুলোর অবস্থাও তথৈবচ এবং প্রায় সময়ই তা বন্ধ থাকে। অনেকে বিনা টিকিটে ভ্রমণ করে। আবার কেউ টিকিট কেটে ভ্রমণ করতে চাইলেও কাউন্টার বন্ধ থাকায় বিনা টিকিটে ভ্রমণ করতে বাধ্য হয়। এতে সরকার বিরাট অঙ্কের রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয়েছে এবং হচ্ছে। পুরোনো লক্কড়ঝক্কড় মার্কা মেয়াদোত্তীর্ণ ট্রেনের ইঞ্জিন ও বগি দিয়েই চলছে রেল। জানা যায়, বর্তমানে ৮৭ শতাংশ ইঞ্জিন ও ৭৭ শতাংশ কোচের আয়ুষ্কাল শেষ। এগুলো চালু রাখার জন্য যন্ত্রাংশ আমদানি করতে হচ্ছে। এ ছাড়াও সংস্কারবিহীন রেললাইনের কারণে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটছে।

প্রতিবছর রেলের বরাদ্দ বাড়লেও বাড়ছে না ট্রেনের গতি এবং সেবার মান। এখানকার ট্রেনগুলোতে মাঝেমাঝে যে দু-একজন টিকিট চেকার/কালেক্টর দায়িত্বে আসেন, তারা অবৈধ উপায়ে যাত্রীদের কাছ থেকে অর্থ নিয়ে নিজেদের পকেট ভারী করেন। উন্নয়নের পথে বিরাট বাধা হিসাবে কাজ করছে এই দুর্নীতিপরায়ণ মানসিকতা। রেলওয়ের ওয়ার্কশপগুলোয় নতুন নতুন ইঞ্জিন ও বগি, আধুনিক যন্ত্রপাতি ও যন্ত্রাংশ তৈরির জন্য স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি। এতে একদিকে যেমন আমাদের কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হবে, নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে; অন্যদিকে রেল থেকে সরকারের রাজস্ব আয় কয়েকগুণ বৃদ্ধি পাবে। রেলকে আর লোকসানের মুখে পড়তে হবে না।

দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে উত্তর জনপদের অবহেলিত মানুষের যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়ন তথা স্বাচ্ছন্দ্যে রেল ভ্রমণের জন্য প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া প্রতিশ্রুতি তিনবিঘা এক্সপ্রেস অবিলম্বে বাস্তবায়ন এবং বর্তমান রেলের বগি সংযোজনসহ সেটআপ অনুযায়ী লোকবল প্রদানে এ অঞ্চলের জনপ্রতিনিধিসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যত দ্রুত এগিয়ে আসবেন, এ অঞ্চলের যাত্রীদের দুর্ভোগ ও কষ্ট তত দ্রুত লাঘব হবে।

মনজু আরা বেগম : লেখক; সাবেক মহাব্যবস্থাপক, বিসিক

monjuara2006@yahoo.com

 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম