দুর্নীতি প্রতিরোধে হাইকোর্টের পরামর্শগুলো গুরুত্বপূর্ণ
![Icon](https://cdn.jugantor.com/uploads/settings/icon_2.jpg)
ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু
প্রকাশ: ১০ নভেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
![দুর্নীতি প্রতিরোধে হাইকোর্টের পরামর্শগুলো গুরুত্বপূর্ণ](https://cdn.jugantor.com/assets/news_photos/2023/11/10/image-738467-1699580600.jpg)
দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে গত ৭ নভেম্বর জাতীয় সংসদ ও দুর্নীতি দমন কমিশনকে ১৬টি গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দিয়েছেন হাইকোর্ট। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কর্মচারী নিয়োগের জন্য পৃথক, স্বতন্ত্র ও স্বাধীন নিয়োগ বোর্ড এবং স্বতন্ত্র ক্যাডার সার্ভিস গঠনসহ এ ১৬ পরামর্শ বাস্তবায়ন করলে ১০ বছরের মধ্যে বাংলাদেশ দুর্নীতিমুক্ত দেশ হিসাবে বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে এবং ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সের (রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের পদক্রম) আওতাভুক্ত ব্যক্তিরা যদি দুর্নীতিমুক্ত হন, তাহলে কোনো ব্যক্তির পক্ষে দুর্নীতি করা সম্ভব হবে না বলেও আশা প্রকাশ করেছেন হাইকোর্ট।
দেশে দুর্নীতি নতুন কোনো বিষয় নয়। অনেক আগে থেকেই তা চলে আসছে। এ কথা অনস্বীকার্য যে, দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি ও প্রবৃদ্ধি হয়েছে। তবে এ প্রবৃদ্ধির সুফল কারা ভোগ করছে, সেটা সঠিকভাবে বণ্টন হচ্ছে কিনা এ বিষয়গুলো সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সবারই ভালোভাবে খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনেক উন্নতি করলেও সমাজে দুর্নীতি থাকায় জনগণ এর সুফল পরিপূর্ণভাবে পাচ্ছে না।
দুর্নীতি না থাকলে আমাদের দেশের যে আরও অনেক উন্নতি হতো, সে কথা বলা যায় নিঃসন্দেহে। এদেশে যতগুলো সমস্যা জাতীয় উন্নয়ন-অগ্রগতি, ন্যায়বিচার ও সুশাসনের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং দাঁড়াচ্ছে, দুর্নীতি এর অন্যতম। অধিক জনসংখ্যা ও ক্ষুদ্র আয়তনের এদেশটিতে একদিকে যেমন এখনো বিরাজ করছে দারিদ্র্য ও সম্পদের অভাব, তেমনি অপরদিকে সমাজের বিভিন্ন স্তরে বিরাজ করছে দুর্নীতির কালো ছায়া।
দুর্নীতির কারণে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এদেশের ভাবমূর্তি মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন হয়েছে। দুর্নীতির কারণে একদিকে যেমন জিডিপি তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেনি, তেমনি দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচিও কাঙ্ক্ষিত সফলতা পায়নি। অপরদিকে জীবনযাত্রার মানও হয়েছে নিুগামী। আবার দুর্নীতির কারণে বৈদেশিক সাহায্যের পরিমাণ ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে, বিভিন্ন সরকারের আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ বেড়েছে নাটকীয়ভাবে। প্রায় সব ক্ষেত্রেই দুর্নীতির মহোৎসব চলতে দেখা গেছে।
আইডিবি, এডিবিসহ বিভিন্ন দাতাসংস্থা ও নীতিনির্ধারকরা দীর্ঘদিন ধরেই দুর্নীতি হ্রাস করার উপায় হিসাবে অনেক পরামর্শ দিয়ে আসছে। টিআইবিও বিভিন্ন সময় সভা, সেমিনার ও রিপোর্টের মাধ্যমে দুর্নীতি প্রতিরোধের বিষয়ে নানাভাবে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। এবার দুর্নীতি প্রতিরোধে জাতীয় সংসদ ও দুর্নীতি দমন কমিশনকে হাইকোর্ট ১৬টি পরামর্শ দিলেন। ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সের (রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের পদক্রম) আওতাভুক্ত ব্যক্তিরা যদি দুর্নীতিমুক্ত হন, তাহলে কোনো ব্যক্তির পক্ষে দুর্নীতি করা সম্ভব নয় বলে উল্লেখ করেছেন হাইকোর্ট।
পরামর্শগুলোর মধ্যে রয়েছে-যে প্রক্রিয়ায় জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে অধস্তন আদালতে বিচারক নিয়োগ দেওয়া হয়, একই প্রক্রিয়া ও প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে দুদকের কর্মকর্তা নিয়োগ করা; দুদকের অন্যান্য কর্মচারী নিয়োগের ক্ষেত্রেও পৃথক, স্বতন্ত্র ও স্বাধীন নিয়োগ বোর্ড গঠন করা; দুদকে কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ পাওয়ার পর যোগদানের সময় সম্পদের বিবরণ দাখিল করা; প্রতিবছর বাধ্যতামূলকভাবে সম্পত্তির হিসাব জনসমক্ষে বা কমিশনের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা ইত্যাদি।
অপর এক পরামর্শে বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিদের মধ্য থেকে দুদকের চেয়ারম্যান, হাইকোর্ট বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিদের মধ্য থেকে দুদকের সদস্য নির্বাচন করার কথা বলা হয়েছে। আরও যেসব পরামর্শ দেওয়া হয় সেগুলো হলো-সৎ, দক্ষ, অভিজ্ঞ আইনজীবীদের সমন্বয়ে উচ্চ আদালত ও অধস্তন আদালতের জন্য দুদকের পৃথক প্রসিকিউশন প্যানেল গঠন করা; প্রতি তিন বছর পর প্যানেল পুনর্গঠন করা; প্রসিকিউশন প্যানেলে আইনজীবী মনোনয়নের জন্য একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বোর্ড গঠন করা; প্রসিকিউশন প্যানেলের অন্তর্ভুক্ত আইনজীবীদের জন্য যুগোপযোগী সম্মানিসহ অন্যান্য সহায়তার ব্যবস্থা করা ইত্যাদি।
দুর্নীতি প্রতিরোধ করতে সব কাজের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার যথাযথ ব্যবস্থা করা, দারিদ্র্য বিমোচন ও আয়বৈষম্য কমানোর উদ্যোগ গ্রহণ ও তার বাস্তবায়ন, সর্বদা দুর্নীতি দমন কমিশনকে প্রকৃত অর্থেই স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেওয়া এবং দুর্নীতিবিষয়ক মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করা জরুরি। পাশাপাশি দুর্নীতিবাজদের রাজনৈতিক পরিচয় বাদ দিয়ে তাদের শুধু ‘দুর্নীতিবাজ’ হিসাবে চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করাসহ তাদের সামাজিকভাবে বর্জন করার ব্যবস্থা করা দরকার।
দুর্নীতি রোধের ক্ষেত্রে প্রশাসনিক সংস্কারসহ কার্যকর গবেষণার মাধ্যমে দুর্নীতির প্রকৃত কারণ উদ্ঘাটন ও তা দূর করতে বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করাও আবশ্যক। এছাড়া গণমাধ্যমকে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দিয়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জনমত সৃষ্টির সুযোগ করে দেওয়া, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দলীয় সম্পৃক্ততা বিচ্ছিন্ন করা এবং সর্বক্ষেত্রে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও দলীয় দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটানোও জরুরি। সর্বোপরি, দুর্নীতি থেকে দেশ ও জাতিকে রক্ষা করার জন্য দেশের সর্বত্র প্রয়োজন ‘সততা’র একটি আবহ। দরকার স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার একটি সুষ্ঠু-সুন্দর পরিমণ্ডল।
সবারই স্মরণ রাখা দরকার, এদেশটি আমার, আপনার, সবার। ১৯৭১ সালে যেসব উদ্দেশ্য সামনে রেখে এদেশের জন্ম হয়েছে, সেসব উদ্দেশ্যকে সফল করার পাশাপাশি স্বাধীনতার প্রকৃত সুফল পেতে হলে এবং বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত দেশের বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠীকে বাঁচাতে হলে দেশ থেকে দুর্নীতি নামক সর্বগ্রাসী ব্যাধিকে যে কোনো মূল্যে প্রতিরোধ করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।
তাই আসুন, আমরা সবাই মিলে সম্মিলিত কণ্ঠে দুর্নীতিকে ‘না’ বলি। দুর্নীতির পাশাপাশি দুর্নীতিবাজদের ঘৃণা করি এবং তাদের কঠোর হস্তে প্রতিহত করি। আর সত্যিকার অর্থেই নিজ নিজ অবস্থান থেকে চেষ্টা করি বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশকে দুর্নীতিমুক্ত একটি দেশ হিসাবে উপস্থাপন করার। দুর্নীতি প্রতিরোধে সরকার হাইকোর্টের দেওয়া ১৬ পরামর্শ সঠিকভাবে পর্যালোচনাপূর্বক গ্রহণ করবে বলে সবার প্রত্যাশা। সর্বোপরি, দুর্নীতি প্রতিরোধে যা কিছু করণীয়, তা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে।
ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু : অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, আইন বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি
kekbabu@yahoo.com