শতফুল ফুটতে দাও
এমন মৃত্যুর সদুত্তর কী?
ড. মাহবুব উল্লাহ্
প্রকাশ: ০৯ নভেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
কবি কিশোর সুকান্ত লিখেছিলেন, ‘অবাক পৃথিবী অবাক যে বারবার/দেখি এই দেশে মৃত্যুরই কারবার।’ বিপ্লবী কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য মাত্র ২১ বছর বয়সে বাংলা কবিতায় যে অবদান রেখে গেছেন, তার তুলনা হয় না। একের পর এক জনচৈতন্য উদ্বেল করা কবিতা যখন তিনি রচনা করছিলেন, তখন তিনি দুরারোগ্য যক্ষ্মায় ভুগছিলেন। সেই সময় যক্ষ্মার উন্নত কোনো চিকিৎসা ছিল না। সে কারণে বলা হতো ‘যার হয় যক্ষ্মা তার নাই রক্ষা।’ কবি সুকান্ত অপরিণত বয়সে পৃথিবী থেকে বিদায় নেন। তিনি ১৯৪৭-এর ১৩ মে মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুর পর ৭৬ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। দেশ স্বাধীন হয়েছে, রাজনীতির পালা বদল হয়েছে। মৃত্যুর কারবার থেমে যায়নি। বারবার আমাদের জনপদে নানা অসিলায় মৃত্যুর নির্মম হাত মানুষের অমূল্য সম্পদ জীবনটি কেড়ে নিয়েছে। এই তো সেদিন আরোপিত রাজনৈতিক সংঘর্ষে যুবদলের কর্মী, পুলিশ সদস্য ও প্রৌঢ় সাংবাদিকের মৃত্যু হয়েছে। এ মৃত্যু কারোরই কাম্য ছিল না। অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু একটি স্বাধীন জাতির ললাটে কলঙ্ক তিলক এঁকে দেয়। শুধু রাজনীতি নয়, সমাজ জীবনের অনেক অসংগতি অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু ডেকে আনে। সামাজিক বিবেচনাবোধ এবং ক্রোধের পরিবর্তে সহমর্মিতা ও সমবেদনা এসব অবাঞ্ছিত মৃত্যুকে রোধ করতে পারে।
দৈনিক সমকাল মঙ্গলবার ৭ নভেম্বর সপ্তম পৃষ্ঠায় মৃত্যুর সংবাদ পরিবেশন করতে গিয়ে শিরোনাম করেছে, ‘যাওয়ার জায়গা না থাকলে নদীতে ঝাঁপ দিয়া মর’। ঘটনা পরম্পরা বোঝার জন্য সমকালে প্রকাশিত কাহিনিটি পুরোপুরি তুলে ধরলাম।
শরীয়তপুরের নড়িয়ায় তিন সন্তান নিয়ে নদীতে ঝাঁপ দেওয়া সালমা বেগমের (২৯) লাশ এখনো মেলেনি। গতকাল সোমবার উদ্ধার হয়েছে তার বড় ছেলে সাহাবি ওরফে জাফরের (৭) মরদেহ। তবে ঘটনার সঙ্গে সঙ্গেই তার দুই সন্তান আনিকা (৩) ও সলেমানকে (১) উদ্ধার করে স্থানীয়রা। তারা ডায়াপার পরে থাকায় ভেসে উঠেছিল।
রোববার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে উপজেলার ভোজেশ্বর বাজার সেতুর কাছে কীর্তিনাশা নদীতে তিন সন্তানসহ ঝাঁপিয়ে পড়েন সালমা। তিনি জপসা ইউনিয়নের মাইজপাড়া গ্রামের আজবাহার মাদবরের স্ত্রী। সালমার বাবা পাচক গ্রামের লোকমান ছৈয়াল পেশায় রিকশাচালক।
সালমার বোন শারমিন আক্তার গতকাল বলছিলেন, ‘আমার বাবা রিকশাচালক বলে শাশুড়ি শাহিদা বেগম, ননদ কলি ও কমলা আমার বোন সালমাকে সারাক্ষণ জ্বালা-যন্ত্রণা দিত। বোন কোনো প্রতিবাদ করলেই মারধর করত।’ সালমার স্বামী আজবাহার আগে পাটের ব্যবসা করতেন। কয়েক বছর ধরে তিনি বেকার, বিদেশ যাওয়ার চেষ্টা করছেন। এজন্য সালমাকে বাবার বাড়ি থেকে টাকা এনে দিতে চাপ দিচ্ছিলেন বলে জানান শারমিন।
তিনি আরও জানান, শনিবার রাতেও সালমাকে মারধর করেন আজবাহার। টাকা আনতে না পারলে বাড়ি থেকে বের হয়েও যেতে বলেন। এ সময় সালমা বাবার দারিদ্র্যের কথা জানিয়ে টাকা এনে দিতে অস্বীকার করেন। তখন আজবাহার বলেন, ‘কাল সকালে যৌতুক আনতে না পারলে বাড়ি থেকে ছেলেমেয়ে নিয়ে চলে যাবি।’ ছোট তিন সন্তান নিয়ে কোথায় যাবেন জানতে চাইলে আজবাহার জবাব দেন, ‘তোর কোথাও যাওয়ার জায়গা না থাকলে পোলাপান নিয়া নদীতে ঝাঁপ দিয়া মর।’ শনিবার রাত ১২টার দিকে মোবাইল ফোনে শারমিনকে এসব জানান সালমা। পরদিন সকালেই নদীতে ঝাঁপ দেন সালমা।
ঘটনার পর থেকেই নদীর পাড়ে বিলাপ করছেন সালমার মা সেলিনা বেগম, বাবা লোকমান ছৈয়াল, বোন শারমিন আক্তার, স্বামী আজবাহারসহ স্বজনরা। আশপাশের লোকজনও সেখানে ভিড় করেন। মেয়ে ও এক নাতি হারিয়ে পাগলপ্রায় সেলিনা। সোমবার বারবার তাকে জ্ঞান হারাতে দেখা গেছে। একপর্যায়ে সেলিনা বলেন, ‘গরিব হওয়ায় ওরা আমার মেয়েকে শান্তিতে থাকতে দেয়নি। এতদিন সব অত্যাচার-নির্যাতন মুখ বুঝে সহ্য করেছে। তারা ঠিকমতো খাওন দিত না মেয়েকে।’
তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেন সালমার স্বামী আজবাহার। তাকে ঘটনার পর থেকেই নদীর পাড়ে বিলাপ করতে দেখা যায়। তিনি দাবি করেন, স্ত্রীকে প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসেন। একটা ফুলের টোকাও দেননি। তার মা-বোনও সালমাকে খারাপ জানেনি। তবু কী জন্য সন্তানদের নিয়ে নদীতে ঝাঁপ দিয়েছেন-তা আল্লাহপাক জানেন।
ঘটনার পর থেকেই উদ্ধার কাজ শুরু করেন নড়িয়া ফায়ার সার্ভিসের সাতজন ও মাদারীপুরের চার ডুবুরি। নড়িয়া ফায়ার সার্ভিসের দলনেতা রওশন জামিল বলেন, রোববার সন্ধ্যা পর্যন্ত মা সালমা ও তার বড় ছেলেকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। সোমবার বেলা ১১টার দিকে ঘটনাস্থলে ৫০০ ফুট ভাটিতে স্থানীয় জেলেরা সাহাবীরের মরদেহ উদ্ধার করেন। দুপুর পর্যন্ত সালমার খোঁজ মেলেনি।
নড়িয়া থানার ওসি মো. হাফিজুর রহমান বলেন, বড় ছেলের লাশ ময়নাতদন্তের জন্য সোমবার শরীয়তপুর সদর হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়েছে। নিখোঁজ সালমাকে উদ্ধারে অভিযান চলছে। আমাদের সমাজে তিন সন্তান নিয়ে সালমা বেগমদের নদীতে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করা খুব বিরল ঘটনা নয়। মনস্তাত্ত্বিকরা বলেন, মানুষ নিজেকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে। তাই সহ্যের সীমা চূড়ান্ত মাত্রায় অতিক্রম করলেই কোনো মানুষ আত্মহত্যার কথা ভাবতে পারে। ২৯ বছর বয়সি সালমা তার তিন সন্তানসহ কীর্তিনাশা নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মাহুতি দিয়েছেন। তার সন্তানদের মধ্যে তিন বছর বয়সি আনিকা ও এক বছর বয়সি সোলেমান অলৌকিকভাবে প্রাণে রক্ষা পায়। সাত বছর বয়সি সাহাবীর ওরফে জাফর মৃত্যুবরণ করেছে। তার মরদেহ উদ্ধার হয়েছে। কিন্তু সালমা বেগমের লাশ উদ্ধার হয়নি। তার লাশ উদ্ধারে অভিযান চলছে।
সালমা বেগম কেন আত্মহত্যার পথ বেছে নিলেন? কেন তিন সন্তানকে, যারা একেবারেই শিশু তাদেরকে তার সঙ্গী করলেন? সংবাদপত্রে পরিবেশিত কাহিনি থেকে জানা যায়, সালমা বেগম নিরন্তর তার স্বামীর অসহনীয় অত্যাচার এবং কথার কশাঘাতে জর্জরিত হয়েছিলেন। সালমা বেগমের বিয়ে হয়েছিল আজবাহার নামে এক ব্যক্তির সঙ্গে। তিনি পাটের ব্যবসা করতেন। বেকার হয়ে পড়ায় তিনি বিদেশ যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন। বিদেশ যাওয়া তো সহজ কোনো বিষয় নয়। এর জন্য প্রয়োজন হয় প্রচুর অর্থের। কিন্তু আজবাহারকে অর্থ দেবে কে? তার দৃশ্যমান কোনো আয়ের উৎস ছিল না। এ কারণে কোনো অনাত্মীয়ের কাছ থেকে টাকা পাওয়া বা ঋণ নেওয়া সম্ভব ছিল না। তিনি তার ব্যক্তিগত সম্পর্কের দুর্বল জায়গায় হাত দিলেন। স্ত্রীর ওপর চাপ দিতে থাকলেন বাবার বাড়ি থেকে টাকা নিয়ে আসতে। সালমা বেগমের বাবা রিকশা চালাতেন। একজন রিকশাচালক শ্বশুর তার জামাতার বিদেশ যাওয়ার অর্থ জোগাড় করে দিবেন বা নিজের থেকে দিবেন, এর কোনোটাই সম্ভব ছিল না। বাংলাদেশে সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে বেকার মানুষদের বিদেশে কর্মসংস্থানের জন্য যাওয়ার ব্যবস্থা চালু হয়। অনেকে ভাবতে শুরু করলেন বিদেশ যাওয়া মানে সোনার হরিণ হাতে পাওয়া।
সোনার হরিণের স্বপ্ন যে কত বিভ্রান্তিকর, তার প্রমাণ পাওয়া যায় ব্যর্থ অভিবাসনের গল্পগুলো থেকে। বিদেশে অভিবাসনের মাধ্যমে কর্মসংস্থানের সুযোগ বাংলাদেশের দুর্বল অর্থনীতিতে রক্ত সঞ্চালন শক্তিশালী করেছে এমন কথা অস্বীকার করা যাবে না। এ কথাও সত্য যে, প্রবাসে কর্মসংস্থান সুগম করার নামে একদল দালালরূপী ব্যবসায়ীর উদ্ভব ঘটেছে। যারা দরিদ্র কিন্তু জীবনে পরিবর্তন আনার জন্য বেপরোয়া, তারা অনেক সময় ভাবতে চায় না দালালের খপ্পরে পড়ে কী সর্বনাশ হতে পারে। স্বামী বেপরোয়া বলেই তারা স্ত্রীর ওপর ভয়ংকর চাপ সৃষ্টি করে তার পিতার কাছ থেকে প্রয়োজনীয় অর্থের জোগান দিতে। যখন আমরা বড়াই করে বলি, বাংলাদেশের প্রবাসী শ্রমিকরা তাদের কর্মস্থল থেকে রেমিট্যান্স পাঠিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে মজবুত করছে, তখন আমরা ভাবতে চাই না প্রায় প্রতিটি প্রবাসে কর্মসংস্থানের পেছনে রয়েছে ঘাম, অশ্রু ও রক্তক্ষরণের বেদনা। প্রবাসের রেমিট্যান্স যদি হয় অর্থনীতির জন্য বেনিফিট, তার পাশাপাশি বিদেশ গমনের ব্যয় সংস্থানের জন্য যে ত্যাগ ও কষ্ট পুঞ্জীভূত হয়, তাকে অবশ্যই দেখতে হবে বিদেশে কর্মসংস্থানের ব্যয় হিসাবে।
আজবাহার তার স্ত্রী সালমাকে প্রায় রাতেই টাকার জন্য মারধর করতেন। সালমা তার স্বামীকে বলে দিয়েছিলেন তার পক্ষে দরিদ্র পিতার কাছ থেকে টাকা আনা সম্ভব নয়। সালমার কথার পিঠে আজবাহার বলেছিলেন, ‘কাল সকালে যৌতুক আনতে না পারলে বাড়ি থেকে ছেলে মেয়ে নিয়ে চলে যাবি।’ ছোট তিনটি সন্তান নিয়ে কোথায় যাবেন প্রশ্ন করলে সালমার স্বামী আজবাহার বলেছিলেন, তোর কোথাও যাওয়ার জায়গা না থাকলে পোলাপান নিয়া নদীতে ঝাঁপ দিয়া মর।’ এসব কথা সালমা তার বোনকে কীর্তিনাশা নদীতে ঝাঁপ দিয়ে মরার আগের রাতে বলেছিলেন। সালমা চলে যাওয়ার পর স্বামী আজবাহার বেঁচে যাওয়া দুটি ক্ষুদ্র সন্তানকে কোলে নিয়ে অনেক কান্নাকাটি করেছেন। কিন্তু এ কান্নাকাটি আজবাহারের জন্য কোনো সহানুভূতি সৃষ্টি করতে পারেনি। একে বোধহয় শোকের কান্না না বলে মায়াকান্না বলাই শ্রেয়।
জীবনটাকে একটু সচ্ছল করার জন্য বাংলাদেশের গ্রামে গ্রামে গরিব মানুষগুলো যেভাবে ইটের পর ইট জোড়া লাগানোর মতো করে কষ্টের পর কষ্ট জুড়ে দিয়ে যাচ্ছে, তার খবর কি আমরা সেভাবে রাখি? এখন বিদেশ থেকে রেমিট্যান্স প্রবাহ আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেছে, তা সত্ত্বেও আমরা ভাবতে চাই না দরিদ্র মানুষগুলোর কষ্টের কথা। আমরা নিমগ্ন থাকি আনুষ্ঠানিক চ্যানেল ও হুন্ডির মধ্যে ফারাক নিয়ে।
ড. মাহবুব উল্লাহ : শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ