Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

এটা কি গণতন্ত্র, নাকি দলতন্ত্র?

Icon

এ কে এম শাহনাওয়াজ

প্রকাশ: ০৭ নভেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

এটা কি গণতন্ত্র, নাকি দলতন্ত্র?

প্রতীকী ছবি

মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে মাটিচাপা দিয়ে বাংলাদেশ এখন অধরা গণতন্ত্রের দেশে পরিণত হয়েছে। এদেশে গণতন্ত্র আটকে আছে শুধু রাজনৈতিক নেতাদের বক্তৃতায়। বড় রাজনৈতিক দলগুলো এখন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় টিকে থাকা এবং ক্ষমতায় যাওয়ার লড়াইয়ে ব্যস্ত। ‘জনগণ’ উভয়ের জপমালা ছাড়া অন্য কিছু নয়। প্রকৃতপক্ষে সবাই জনগণের মাথায় কাঁঠাল রেখে কোয়া ভেঙে খেতে উদগ্রীব। ক্ষমতান্ধরা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকা ও অধিষ্ঠিত হওয়ার জন্য দেশবাসীর বক্ষ বিদীর্ণ করছেন প্রতিদিন।

যেভাবেই হোক, ক্ষমতা ধরে রাখার দৌড়ে অনেকটা অন্ধ আওয়ামী লীগ। বিএনপি নেতারা আন্দোলন-সংগ্রামের পথ ধরে ক্ষমতায় আসার নিয়মতান্ত্রিক পথে হাঁটতে রাজি নন। অতটা ধৈর্যও তাদের নেই। প্রবাসী নেতা ঈশ্বরের কৃপায় আরাম-আয়েশে থেকে স্বপ্ন দেখেন দেশের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হওয়ার। যেহেতু নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি করার সাহস নেই প্রবল প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে, তাই সিরাতুল মুস্তাকিম খোঁজার জন্য ধরনা দিচ্ছে বিদেশি শক্তির দরবারে। ক্ষমতাপ্রত্যাশীরা পুরোনো কায়দায় জনগণের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা পদদলিত করে নৈরাজ্য তৈরি করে মোক্ষ লাভ করতে চাইছে।

বিএনপি যেভাবে দিন-রাত কূটনৈতিকপাড়ায় ছুটছে আর সংবাদমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, বিদেশিদের পক্ষে রাখার জন্য লবিস্ট নিয়োগে অর্থ ছড়াচ্ছে, তাতে মনে হয়, এসব নেতার কারও মধ্যে যদি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা অবশিষ্ট থাকে, তো এর কবর হয়েছে। পাকিস্তানি পন্থায় চলা বিএনপি নেতাদের অবশ্য মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করার বালাই নেই। মানুষের বর্তমান অর্থনৈতিক সংকট, চলমান শিক্ষা কার্যক্রম, ক্ষুদ্র থেকে বড় পেশাজীবীদের যাপিতজীবনকে স্থবির করে দিয়ে স্বেচ্ছাচারীর মতো অবরোধের পর অবরোধ চাপিয়ে দিচ্ছে। কেউ প্রশ্ন তুললে বলবে এসব নাকি গণতান্ত্রিক অধিকার! সাধারণ মানুষ কোন স্বার্থে নিজেদের ওপর আজরাইলের মতো চেপে বসাদের ক্ষমতায় বসাতে চাইবে?

আওয়ামী লীগ নেতারা ক্ষমতায় টেকার জন্য দৃশ্যত বিদেশি প্রভুদের পায়ে পড়ছে না ঠিকই, কিন্তু ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার জন্য মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমুন্নত রাখতে ব্যর্থ হচ্ছেন। মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দেওয়া দলের এমন স্খলন কাম্য নয়। আজকের নির্বাচন-পূর্ব সময়ে আওয়ামী লীগ নির্ভার থাকতে পারছে না কেন? তুলনাহীন উন্নয়নের পথে হাঁটছে দেশ। দেশবাসী অবকাঠামোগত উন্নয়নের ফসল ভোগ করছে। তবুও আওয়ামী লীগ নির্বাচন-পূর্ব সব হিসাবে নিশ্চয়ই দেখেছে, তাদের জনসমর্থন অনেক কমেছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে কেন?

এ সত্যটি অস্বীকার করা যাবে না, শুধু উন্নয়ন দেখিয়ে মানুষকে সন্তুষ্ট করা যায় না। পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, বঙ্গবন্ধু টানেল এসব অনেক বড় সাফল্য। নগরজীবনের বাইরে থাকা বড়সংখ্যক মানুষ এসবের দূরবর্তী প্রভাব নিয়ে ভাবে না। ফলে সাধারণ মানুষের যাপিতজীবনের কষ্ট অথবা আনন্দই ক্ষমতাসীন দলের জনসমর্থনের ওপর বড় প্রভাব ফেলে। এ ডিজিটাল যুগে গ্রামের সাধারণ মানুষকেও এখন বক্তৃতায় আবিষ্ট রেখে মোক্ষ লাভ করা যাবে না। কান পাতলেই শোনা যাবে শ্রমজীবী বা স্বল্পশিক্ষিত সাধারণ মানুষও এখন ভালো রাজনৈতিক বিশ্লেষক। নিত্যপণ্যের কঠিন বাজারে দাঁড়িয়ে তারা সরকারের ব্যর্থতাকেই শুধু দেখছে।

প্রায় পনেরো বছর টানা ক্ষমতায় থেকেও কি আওয়ামী লীগ সরকার সুশাসনের পথে হাঁটতে পেরেছে? কষ্টে থাকা মানুষ কাছে থেকে দেখছে কঠিন দলতন্ত্রের প্রশ্রয়ে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের অশুভ দাপট তাদের দুঃখ বাড়াচ্ছে কেবল। চোখ মেলেই দেখছে একদিকে সংসার নির্বাহ করা প্রতিদিন কঠিন থেকে কঠিনতর হচ্ছে, অন্যদিকে দলীয় নেতাদের অনেকেই অর্থবিত্তে ফুলে-ফেঁপে ঢোল হচ্ছেন। ঋণখেলাপিদের তালিকা বাড়ছে কেবল। দলীয় নেতা-সমর্থক হওয়ায় আইনও ছুঁতে পারছে না তাদের। অর্থ পাচার হয়ে যাচ্ছে সরকারের হাত গলে। সরকারের নিয়ন্ত্রকদের জন-স্বজনদের অর্থ পাচারের গুজবও বড় হচ্ছে। সাধারণ মানুষ নিজেদের কষ্টের কারণ হিসাবে এসবকে বিবেচনায় আনছে। অন্যদিকে শিক্ষিত-সচেতন মানুষ দলীয়করণের কারণে নিজেদের নানা ক্ষেত্রে বঞ্চিত হতে দেখছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাস্নাত মানুষ, যারা এতকাল আওয়ামী লীগকেই সমর্থন করত, তাদের অনেকে নির্বাচনের আগে মানসিকভাবে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ছে। বিএনপিকে তাদের পক্ষে আদর্শগত কারণে হয়তো সমর্থন করা সম্ভব হবে না; কিন্তু নিষ্ক্রিয় থাকাটাও আওয়ামী লীগের জন্য কম ক্ষতির নয়। কিন্তু দুর্ভাগ্য, এসব ক্ষত সারানোর জন্য কোনো প্রচেষ্টা আওয়ামী লীগ নেতারা করেছেন বলে মানুষ মনে করে না। বরং নেতাদের বক্তৃতার শব্দচয়নে কর্তৃত্ববাদী শব্দই বেরিয়েছে বারবার।

সরকারে থাকার কারণে আওয়ামী লীগেরই দায়িত্ব ছিল সব অচল অবস্থা কাটিয়ে সবাইকে নিয়ে নির্বাচনে আসা। জনগণের প্রতি আস্থা থাকলে মুক্ত নির্বাচনে ভীতি থাকার কথা নয়; কিন্তু সেপথে হাঁটার সাহস কি দেখাতে পেরেছে আওয়ামী লীগ? দেশে চোখ ধাঁধানো উন্নয়ন করার পরও সে সাহস আওয়ামী লীগ নেতারা কেন করতে পারছেন না, সে সত্য কি খোঁজার চেষ্টা করেছেন তারা?

বিএনপি কি গণতন্ত্রের মানসিকতা নিয়ে ‘লড়াই’ করছে? গণতন্ত্রের প্রথম শর্তই তো গণমানুষের কল্যাণ করা। জনকল্যাণের জন্য কি তারা কাঙ্ক্ষিত পথে হাঁটছে? জনগণকে সম্পৃক্ত করে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের পথে হেঁটে কি সরকারকে বাধ্য করতে পেরেছে গণতান্ত্রিক ধারা প্রতিষ্ঠা করতে? তাহলে অরাজকতা তৈরি করে মোক্ষ লাভে মরিয়া কেন! মোক্ষে পৌঁছার জন্য তারা অনেকবারই সহিংসতার পথে হেঁটেছে। কিন্তু লাভ হয়নি। বরং জনবিচ্ছিন্ন হয়েছে। তাদের কে রাজা-উজির হবেন, তার জন্য জনগণকে খেসারত দিতে হবে কেন? তিন দিনের অবরোধের পর আবার ৪৮ ঘণ্টা অবরোধ ডাকা হয়। ২ নভেম্বর বাজারে গিয়েছিলাম। সবকিছুর দাম লাগামছাড়া। যুক্তি একটিই-অবরোধের কারণে পণ্য সরবরাহ নেই, তাই মূল্যবৃদ্ধি। কী বিচিত্র এদেশের রাজনীতি! এক পক্ষকে যেভাবেই হোক সিংহাসন আঁকড়ে থাকতেই হবে, আরেক পক্ষের সিংহাসন দখল করতেই হবে! এ লক্ষ্য অর্জন করার জন্য জনগণকে পিঁপড়ার মতো পিষে মারতেও কারও দ্বিধা নেই। এরাই নাকি আমাদের গণতন্ত্রের দিশারি! অবরোধ কার্যকর করার জন্য রাজনীতির গুন্ডারা বরাবরের মতোই গাড়িতে আগুন দিচ্ছে। গাড়ি বের করতে সাহস পাচ্ছে না মালিক।

শ্রমিকরা জীবনযুদ্ধে ঘোর অন্ধকার দেখছে। পেশাজীবীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পথে বেরোচ্ছে। দীর্ঘদিন হরতাল-অবরোধ না থাকায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো দারুণ ছন্দে চলছিল। আবার অনিশ্চয়তায় ফেলছে ছাত্র-শিক্ষক-অভিভাবকদের। তারাই নাকি আবার গণতন্ত্রী! কতটা কপট হতে পারে আমাদের রাজনীতি! মানুষকে জিম্মি করা অবরোধ শেষ হলে বিএনপি নেতা রিজভী সাহেব ‘স্বতঃস্ফূর্তভাবে’ অবরোধ পালন করায় জনগণকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। যদি তাই হয়, তাহলে দয়া করে একটি চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করুন। অবরোধ বা হরতাল ডেকে নিশ্চয়তা দিন কেউ পিকেটিং করবে না, গাড়িতে বোমা-ককটেল-ঢিল ছুড়বে না।

আগুন দেবে না। তারপর আমরা দেখতে চাই, কতটা স্বতঃস্ফূর্তভাবে অবরোধ পালিত হয়। আমরা জানি, এ চ্যালেঞ্জ নেওয়ার সামান্যতম যোগ্যতা বা সাহস আপনাদের নেই। জনগণের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত করে নিজ নিজ দলীয় রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য দেওয়া কর্মসূচি মানুষ কতদিন সহ্য করবে? এভাবেই রাজনৈতিক দলগুলো জনসমর্থন হারায়। আমাদের দেশের ক্ষমতাপ্রিয় রাজনীতিকরা গণতন্ত্রের নামে গণতন্ত্রকে লাঞ্ছিত করেন, তাই আমরা চাই না এ ধারার গণতন্ত্রের বাণিজ্য অব্যাহত থাকুক। গণতন্ত্রের নামে স্বৈরাচারী আচরণ বরং মানুষকে নিপীড়িত করছে।

দুর্ভাগ্য আমাদের, স্বাধীনতা-উত্তর উৎকট ক্ষমতার রাজনীতি এদেশে সম্ভাবনাময় দেশপ্রেমিক মানুষকে মাথা তুলে দাঁড়াতে দেয়নি। নৈতিকতার পরাজয় ঘটেছে বলেই রাজনৈতিক কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য দেশজুড়ে তরুণ থেকে প্রৌঢ় পর্যন্ত বিবেকবর্জিত মানুষ অমানবিক আচরণ করে যাচ্ছে। দল ক্ষমতায় টিকে থাকলে অথবা দল ক্ষমতায় গেলে এরা হয়তো খুদকুঁড়োটাও পাবে না। আর আদর্শের লড়াই? একবার বিচার করে দেখুন তো, বক্তৃতার মঞ্চ ছাড়া প্রায়োগিক ক্ষেত্রে জনকল্যাণের আদর্শ কার কোথায় আছে? আমাদের প্রত্যাশা থাকবে, সব ভাঙচুরের মধ্য দিয়ে দেশপ্রেমিক রাজনীতিকরাই প্রকৃত গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনবেন।

ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

shahnawaz7b@gmail.com

Jamuna Electronics

var jquery = document.createElement("script"); jquery.src = "https://code.jquery.com/jquery-3.6.0.min.js"; document.getElementsByTagName("head")[0].appendChild(jquery); var isIframeLoaded = false; // Flag to track iframe load jquery.onload = function () { if (!isIframeLoaded) { var parentBody = $("body", window.parent.document); $(parentBody).append(` `); $(document).ready(function () { // Check if iframe is already appended if ($("#ReachablebannerElectromart", window.parent.document).length === 0) { $(parentBody).append(` `); // Set initial positions $("#ReachablebannerElectromartBTN", window.parent.document).bind("click", function () { $("#ReachablebannerElectromartBTN", window.parent.document).remove(); $("#ReachablebannerElectromart", window.parent.document).remove(); }); // Remove iframe and button after 15 seconds setTimeout(function () { $("#ReachablebannerElectromartBTN", window.parent.document).remove(); $("#ReachablebannerElectromart", window.parent.document).remove(); }, 15000); } // Set the flag to true once iframe is loaded isIframeLoaded = true; }); } };
Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম