নির্বাচনকালীন সরকার প্রশ্নে গণভোট হোক
ড. এম এ এস মোল্লা
প্রকাশ: ২৭ অক্টোবর ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
সমঝোতার ভিত্তিতে একটি (ফেব্রুয়ারি ১৯৯১) এবং সাংবিধানিক তিনটি (জুন ১৯৯৬, অক্টোবর ২০০১ এবং ডিসেম্বর ২০০৮) মোট চারটি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সাধারণ নির্বাচনের প্রতিটি অবাধ ও সুষ্ঠু হয়েছে।
এসব নির্বাচনে হেরে যাওয়া দল নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রাথমিক কিছু প্রশ্ন তুললেও ওই অসত্য দাবি অচিরেই স্তিমিত হয়ে বাতাসে মিলিয়ে গেছে।
সব রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী ও জনগণ এ বিষয়টি ভালোভাবেই বোঝেন ও মানেন যে, স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭৩ সাল থেকে অদ্যাবধি ক্ষমতাসীন দলীয় সরকারের অধীনে কোনো সাধারণ নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়নি। কিন্তু কিছু ক্ষমতান্ধ রাজনৈতিক শক্তি এ বাস্তব সত্যের বিরুদ্ধে এখন উচ্চৈঃস্বরে কথা বলে।
সবাই জানেন, ১৯৯১ সালের প্রথম সুষ্ঠু নির্বাচনে বিজয়ী দল বিএনপি পঞ্চম সংসদের মেয়াদ থাকতে প্রত্যাশিত নির্দলীয়, নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংসদে পাশ করাল না। গণ-আন্দোলনের মুখে দলটি অগত্যা ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ভুয়া নির্বাচনে ঠুনকো ষষ্ঠ সংসদ প্রতিষ্ঠা করে অল্প সময়ে নির্দলীয়, নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার কাঠামো পাশ করাল; এতে কাঠামোটিতে কিছু সমস্যা থেকে গেল।
ওই সমস্যাপূর্ণ কাঠামোতেই নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করে মাসেকের মধ্যে ক্ষমতা হস্তান্তর করে বেগম জিয়ার নেতৃত্বের প্রথম (নামকাওয়াস্তে দ্বিতীয়) বিএনপি সরকার বিদায় নিল। বিএনপি ওই নির্বাচনটি করেছিল ভুলের ‘কাফ্ফারা’ হিসাবে, ক্ষমতায় থাকার জন্য নয়। কিন্তু আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ভুয়া নির্বাচনের উদাহরণ টেনে নিজেদের সব অপকর্ম জায়েজ করার ব্যর্থ চেষ্টায় মেতে থাকে।
ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার খায়েশ পূর্ণ করার লক্ষ্যে আওয়ামী লীগ ২০০১ সালে এবং বিএনপি ২০০৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে অকার্যকর করার চেষ্টা করেছে। প্রথম অপচেষ্টা ভন্ডুল করেন প্রধান উপদেষ্টা বিচারপতি লতিফুর রহমান; দ্বিতীয়টি ভন্ডুল হয় ‘এক-এগারো’খ্যাত, সাংবিধানিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আদলে গঠিত সামরিক মদদপুষ্ট দুবছর মেয়াদি ‘অসাংবিধানিক’ (Ultravires) সরকারের হাতে।
কথা সত্য, বিএনপি ২০০৬ সালে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে হত্যা করতে চেষ্টা করেছিল; কিন্তু ওই ‘Attempt to murder’ ফেল করেছিল। অথচ ২০১১ সালে প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের ঘাড়ে বন্দুক রেখে আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা হত্যার কাজটি আপাতভাবে সেরে ফেলে।
অবশ্য আমি মনে করি, এদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পয়গম্বর হজরত ইউনুস (আ.)-এর মতো বেঁচে থাকার গুণসম্পন্ন। যিনি/যারাই ওই সরকারকে অজগরের মতো গিলে ফেলে থাকুন, ওটা একসময় জ্যান্ত বেরিয়ে আসবেই।
উচ্চতম আদালতের যে সংক্ষিপ্ত রায়ের বরাতে আওয়ামী লীগ নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার না রাখার সিদ্ধান্ত নেয়, তা শুধু অনৈতিক নয়, সম্পূর্ণ অবৈধ। বিষয়টি আমার আগের লেখায় (জাতি কি এ সংকট থেকে পরিত্রাণ পাবে? ১৫ অক্টোবর) এবং অন্যদের বর্ণনায় স্পষ্ট। কারণ, বিচারপতি খায়রুল হক বিভক্ত ও অত্যন্ত ত্রুটিপূর্ণ রায়েও ‘দশম ও একাদশ সংসদ নির্বাচন ত্রয়োদশ সংশোধনীর অধীনে অনুষ্ঠিত হতে পারে’ বলে উল্লেখ করেছিলেন।
উল্লেখ্য, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার ওপর মতামত দেওয়ার জন্য ২০১০ সালে সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর নেতৃত্বে একটি সংসদীয় কমিটি গঠন করা হয়েছিল; ওই কমিটি সর্বসম্মতভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাখার পক্ষে মত দিয়েছিল; কিন্তু প্রধানমন্ত্রী একক সিদ্ধান্তে সংসদীয় কমিটির মত বাতিল করে ৩০ মে (২০১১) নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার না রাখার খারাপ সিদ্ধান্তটি নেন অগণতান্ত্রিক পন্থায় (আদালতের রায়ের নামে সংসদীয় কমিটিকে উপেক্ষা করে)।
তার এ অগণতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত এবং এর ফলে সংবিধানের তাড়াহুড়ো (আদালতের পূর্ণ রায় প্রকাশের ১৫ মাস আগে) ও আইনত অবৈধ পঞ্চদশ সংশোধনী বর্তমান রাজনৈতিক অচলাবস্থার মূল কারণ। স্মর্তব্য: তাড়াহুড়ো না করে খায়রুল হকের ‘পাতানো’, সংক্ষিপ্ত রায় থেকে সরে আসা, পূর্ণ রায় প্রকাশের পর আনলে পঞ্চদশ সংশোধনী আইনগত ভিত্তি পেত।
ওই অবৈধ সংশোধনীর পর রাষ্ট্রের পবিত্র সংবিধান তার মূল চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য হারিয়ে ফেলেছে। এখন যারা এ সংবিধান দেখিয়ে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ‘মৃত’, ‘মরে ভূত হয়ে গেছে’, ‘আজিমপুর কবরস্থানে চিরনিদ্রায় ঘুমিয়ে আছে’ ইত্যাদি বলে চিৎকার করে, তারা মানসিক বৈকল্যের শিকার সংকীর্ণ, স্বার্থান্ধ, এবং দলান্ধও বটে।
এ জাতির রাজনৈতিক পিতাদের প্রথমজন খাজা নবাব স্যার সলিমুল্লাহ প্রতিষ্ঠিত মুসলিম লীগ যখন আর জনস্বার্থ রক্ষা করতে পারছিল না, সদ্য আজাদিপ্রাপ্ত পাকিস্তানের দুবছরও অতিক্রম করেনি, তখন জননেতা মওলানা ভাসানী মুসলিম লীগের ‘আওয়ামী’ (জনগণের) শাখা প্রতিষ্ঠা করলেন (২৩ জুন, ১৯৪৯)। আওয়ামী মুসলিম লীগ মাত্র ছয় বছরের মধ্যে ‘মুসলিম’ শব্দ ছেঁটে ফেলার মাধ্যমে পূর্ণ অসাম্প্রদায়িক দলে পরিণত হলো।
জাতির প্রধান রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে একমাত্র একে ফজলুল হক ছাড়া সবাই আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের সঙ্গে যুক্ত থেকে দলটিকে গণমানুষের তীর্থে পরিণত করেছিলেন। এ কারণেই দলটি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধীনতা অর্জনে মূল দায়িত্ব পালনে সক্ষম হয়। অথচ বাংলাদেশের রাজনৈতিক কৃষ্টিতে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার অনির্দিষ্টকালের জন্য জরুরি বলে প্রমাণিত হওয়া সত্ত্বেও দলটি তা অস্বীকার করে পরপর দুই মেয়াদ সম্পূর্ণ অবৈধভাবে ‘সরকার’ পরিচালনা করে এখনো নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন না করে ‘ক্ষমতায়’ থেকে নির্বাচনের নামে কারচুপি করার দৃঢ়তা প্রকাশ করছে।
আমার ধারণা এবং বিভিন্ন জরিপে প্রমাণিত যে, দেশের অন্তত ৭৫ শতাংশ মানুষ নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার চায়। অথচ জনগণ ‘তাদের সঙ্গে আছে’ দাবিতে বিরোধী জোটের আন্দোলন বন্ধ করে দেওয়ার, এমনকি ‘ষড়যন্ত্রকারী’ ও ‘দেশদ্রোহী’ আখ্যা দিয়ে তাদের রাজধানী ঢাকার সড়কে দাঁড়াতেই না দেওয়ার হুমকি দিচ্ছে আওয়ামী লীগ ‘সরকার’।
ওদিকে বিরোধী জোট কোনোভাবেই আর খেলো নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করতে বদ্ধপরিকর; এমনকি ওরকম ভুয়া নির্বাচন করতে না দেওয়ার কথাও বলছে তারা। তাদেরও দাবি জনগণ ‘তাদের সঙ্গেই’ আছে। সরকারি ও বিরোধী উভয় জোটের এ জনগণের পক্ষের দাবি প্রমাণ করার উপায় কী?
যে গণভোট পঞ্চদশ সংশোধনীর জন্য জরুরি ছিল, এখন সে পথেই যেতে হবে। সাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রের মালিক জনগণের অভিপ্রায় জেনে দেশ ও জনগণকে বর্তমান সামাজিক সংকট থেকে উদ্ধার করা যায়। কিন্তু সে গণভোট কে করবে, কার অধীনে অনুষ্ঠিত হবে? এটা তো নিশ্চিত করে বলা যায়, বর্তমান নির্বাচন কমিশনের যতই সাংবিধানিক ক্ষমতা থাকুক, কমিশন তা ব্যবহার করতে পারে না। সুতরাং, নির্বাচন কমিশন যেমন সুষ্ঠু নির্বাচন করতে পারে না, গণভোটও করতে পারবে না। তাহলে এখন কী করা?
গণভোট পরিচালনার দায়িত্বে দুটো বিকল্প সংস্থার কথা বলা যায়। একটি দেশীয় সামরিক বাহিনী, অপরটি আন্তর্জাতিক (জাতিসংঘ)। ১. দেশের সুশৃঙ্খল সামরিক বাহিনীকে জাতীয় অনেক দুর্যোগেই ডেকে আনা হয়; তাদের প্রাকৃতিক ও সামাজিক উভয় প্রকার দুর্যোগে কার্যকর দায়িত্ব পালনের বেশ সুনামও রয়েছে। গণভোটটি তাদের তত্ত্বাবধানে হতে পারে। ২. বিশ্বে যে কোনো গুরুতর আন্তর্জাতিক সমস্যা সমাধানে জাতিসংঘ ম্যান্ডেটধারী; সুতরাং, গণভোটটি জাতিসংঘের নিয়ন্ত্রণে হলে ক্যান্টনমেন্টকে কারও কারও দেওয়া ‘বদনাম’ থেকে রক্ষা করা যায়।
তাহলে অতিসত্বর সরকারি ও বিরোধী উভয় জোট আলোচনা করে নিজেদের সামরিক বাহিনী অথবা জাতিসংঘের নিয়ন্ত্রণে গণভোট আয়োজন করে মাতৃভূমি বাংলাদেশকে নিজেদের সৃষ্ট সামাজিক সংকট থেকে রক্ষা করুক। গণভোটে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে গণরায় পেলে একাদশ সংসদের মেয়াদ থাকাবস্থায় সংবিধান ‘আইনসম্মতভাবে’ সংশোধন করে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন করা যাবে। আশা করি, এ জাতির ধ্রুপদি নেতাদের প্রতি ন্যূনতম শ্রদ্ধা থাকলে এবং জনগণের প্রতি সম্মান ও দেশপ্রেম থেকে থাকলে সরকার এ পন্থায় খাদের কিনারা থেকে জাতিকে ফিরিয়ে আনবে।
ড. এম এ এস মোল্লা : সমাজ নিরীক্ষক ও নিবন্ধকার
momas71@yahoo.com