Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

দেশের অর্থনীতিতে ভারসাম্যহীনতার বিপরীতে চ্যালেঞ্জ

Icon

মুঈদ রহমান

প্রকাশ: ১৫ অক্টোবর ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

দেশের অর্থনীতিতে ভারসাম্যহীনতার বিপরীতে চ্যালেঞ্জ

রাজনীতি ও অর্থনীতি পাঠযোগ্য বিষয় হিসাবে পৃথক হলেও প্রায়োগিক দিক থেকে একটি আরেকটির পরিপূরক। রাজনীতিবিহীন অর্থনীতি অসম্পূর্ণ, আবার অর্থনীতিবিহীন রাজনীতি অস্তিত্বহীন। রাজনীতিকরা এ গুরুত্বপূর্ণ শর্তটি অনেক সময়ই ভুলে যান।

বর্তমান সময়ে রাজনীতির ডামাডোল অর্থনৈতিক সংকটকে আড়াল করে রেখেছে। এটি নিশ্চয়ই উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়াবে। ভারসাম্যপূর্ণ নীতি অনুসরণ না করায় দেশের অর্থনীতি ক্রমেই ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ছে। অর্থনীতিতে এ আচমকা পরিবর্তন সম্পর্কে অনেকেরই পূর্ব-অনুমান ছিল না। দেশের নীতিনির্ধারকরা তো বটেই, আন্তর্জাতিক সংস্থা আইএমএফের কাছেও বর্তমান পরিস্থিতি উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। বেসরকারি খাতও এক ধরনের স্নায়ুচাপের মধ্যে আছে। এ চাপ থেকে সহসা উত্তরণের কোনো আভাস-ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে না। একদিকে বিদেশি অনেক ব্যাংক বাংলাদেশের এলসি খোলায় অনীহা প্রকাশ করছে, অন্যদিকে বিভিন্ন দেশের দূতাবাস তাদের দেশের কোম্পানির বকেয়া পাওনা আদায়ে আদাজল খেয়ে চেষ্টা-তদবির চালাচ্ছে। এমনকি যারা সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখে বিদ্যুতের রমরমা ব্যবসা করেছেন, তারাও পাওনা টাকা ছাড় করতে না পেরে চরম হতাশায় ভুগছেন। আমরা বরাবরই দেখে এসেছি, প্রতিবছরের বাজেটে গড়পড়তা পরিচালন ব্যয়ের পরিমাণ প্রায় ৬০ শতাংশ এবং উন্নয়ন ব্যয় প্রায় ৪০ শতাংশ। প্রস্তাবিত বাজেটগুলোর একটি বড় অংশ ব্যয় হচ্ছে বেতন-ভাতাদি ও ঋণের সুদাসল পরিশোধ করতে। বড় সমস্যা হলো, সরকারের খরচ যে হারে বাড়ছে, কর আহরণ সে হারে বাড়ছে না। কোনো অর্থবছরেই করের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব হয়ে উঠছে না।

আমরা যদি গত কয়েক বছরের পরিসংখ্যানে নজর দিই, তাহলে দেখতে পাব দুটি নেতিবাচক ধারা আমাদের অর্থনীতিকে চেপে ধরেছে। একদিকে জিডিপি-কর অনুপাত কমছে, অন্যদিকে বাড়ছে জিডিপি-ঋণ অনুপাত। তার মানে হলো, সরকারের আয় কমছে; কিন্তু বাড়ছে দেনা। অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশের করের পরিমাণ ছিল মোট জিডিপির ৭ শতাংশ। এর পরের বছর অনুপাত কিছুটা বেড়েছিল। ২০২০-২১ অর্থবছরে করের হার সামান্য বেড়ে দাঁড়ায় জিডিপির ৭ দশমিক ৬৪ শতাংশ। ২০২১-২২ অর্থবছরে তা কিছুটা কমে দাঁড়ায় ৭ দশমিক ৫৪ শতাংশে। আর সদ্যসমাপ্ত ২০২২-২৩ অর্থবছরের ১১ মাসের হিসাব অনুযায়ী, আহরিত করের পরিমাণ জিডিপির ৬ দশমিক ৪১ শতাংশ। কর-জিডিপি অনুপাত সবচেয়ে বেশি ফ্রান্সে। সেখানকার করের পরিমাণ জিডিপির প্রায় ৪৬ শতাংশ। যুক্তরাজ্যে তা ৩৩ শতাংশ। আমরা যদি দক্ষিণ এশিয়াকে বিবেচনায় নিই, তাহলেও দেখব মালদ্বীপ ও নেপালে এ হার প্রায় ২০ শতাংশ। তবে বিশ্বব্যাংকের মত হলো, একটি ভালো কর-কাঠমোতে কর আহরণের পরিমাণ জিডিপির অন্তত ১৫ শতাংশ হওয়া বাঞ্ছনীয়, যা করতে হলে আমাদের করের পরিমাণ দ্বিগুণ করার প্রয়োজন। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, ঢালাওভাবে পরোক্ষ কর বাড়িয়ে তা করতে হবে, যা নিম্নআয়ের মানুষের ওপর বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। বরং প্রত্যক্ষ কর হিসাবে ধনিক গোষ্ঠীর ওপর সম্পদ করারোপ করেও করের পরিমাণ বাড়ানো যায়।

কর আহরণের প্রবৃদ্ধি কমতির দিকে হলেও বাড়ছে সরকারি ঋণের পরিমাণ। বিগত কয়েক বছরের তথ্য সে কথাই বলছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বলছে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে সরকারের ঋণ-জিডিপির অনুপাত ছিল ৩৪ দশমিক ৫ শতাংশ। পরের বছর, অর্থাৎ ২০২০-২১ অর্থবছরে এ অনুপাত বেড়ে দাঁড়ায় ৩৫ দশমিক ৬ শতাংশে। ২০২১-২২ অর্থবছরে সরকারের ঋণ-জিডিপির অনুপাত বেড়ে দাঁড়ায় ৩৯ দশমিক ১ শতাংশে, আর বিদায়ি ২০২২-২৩ অর্থবছরে তা সর্বোচ্চ হয়ে দাঁড়ায় ৪২ দশমিক ১ শতাংশে। ঋণ-জিডিপি অনুপাত বেশি হওয়াটা শঙ্কার কারণ না হলেও, যদি ঋণের ব্যবহার উৎপাদনশীল খাতে না হয়, তাহলে ভবিষ্যতে এ ঋণ অসহনীয় বোঝা হয়ে দাঁড়াতে পারে; কিন্তু একটি বিষয় আমাদের কাছে এখনো পরিষ্কার নয়। সরকারি তথ্য বলছে, আমাদের প্রবৃদ্ধি বেড়েই চলেছে। তাহলে করের অনুপাত বাড়ছে না কেন? কিংবা সেই প্রবৃদ্ধির অংশ সাধারণ মানুষের মধ্যে বণ্টিত হচ্ছে না কেন? যে উন্নয়ন ধনীকে অধিকতর ধনী করে, গরিবকে করে আরও গরিব, সে উন্নয়ন সাধারণ মানুষের কাম্য কি?

আর্থিক খাতে সরকারের ভারসাম্যহীন নীতির কিছুটা উদারণ দেওয়া যেতে পারে। এ বিষয়ে সরকারের আয়, ব্যয় এবং গৃহীত ঋণের দিকটিতে আলোকপাত করা যাক। গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে সরকার ৬ লাখ ৭১ হাজার টাকার বাজেট ঘোষণা করেছিল। পরবর্তী সময়ে তা কমিয়ে সংশোধিত বাজেট করা হয়েছিল ৬ লাখ ৫৫ হাজার ৮৯০ কোটি টাকা। সরকারের এ বিপুল পরিমাণ ব্যয় নির্বাহে কর আহরণের পরিমাণ ধরা হয়েছিল ৪ লাখ ৩৩ হাজার ৫ কোটি টাকা। পরবর্তী সময়ে সংশোধিত বাজেটে ৫ কোটি টাকা কমিয়ে ৪ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকায় নির্ধারণ করা হয়। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) মাধ্যমে আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু বছর শেষে দেখা গেল সংস্থাটি আহরণ করতে পেরেছে মাত্র ৩ লাখ ৩১ হাজার ৫০২ কোটি টাকা; যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা কম। গত অর্থবছরের ব্যয়ের যে পরিসংখ্যান পাওয়া গেছে, তাতে দেখা গেছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে সরকারের পরিচালন ও উন্নয়ন ব্যয় হিসাবে খরচ হয়েছে মোট ৪ লাখ ১৯ হাজার ৩০৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে পরিচালন খাতে ব্যয় হয়েছে ৩ লাখ ৮ হাজার ৫২৫ কোটি টাকা এবং উন্নয়ন খাতে ব্যয় হয়েছে ১ লাখ ১০ হাজার ৭৭৮ কোটি টাকা। এর অর্থ হলো, যদি বাজেটের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হয়, তাহলে শুধু জুনেই ব্যয় করতে হবে ২ লাখ ৩৬ হাজার ৫৮৭ কোটি টাকা; যা মোট বরাদ্দের ৩৬ শতাংশের কিছুটা বেশি। জুনের ব্যয়ের হিসাব প্রকাশিত হয়নি বলে প্রকৃত অবস্থার চিত্র তুলে ধরা যাচ্ছে না। আয়-ব্যয়ের এ বিশাল পার্থক্যের কারণে সরকারের ঋণের পরিমাণ বেড়েই চলেছে। ২০২৩ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত সরকারের মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৪ লাখ ৪৮ হাজার ৩৩৩ কোটি টাকা, যার মধ্যে ৬৩ শতাংশ অভ্যন্তরীণ ঋণ এবং ৩৭ শতাংশ বিদেশি ঋণ।

এ ভারসাম্যহীন নীতি অনুসরণ করার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে অর্থনীতির ওপর। চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে মূল্যস্ফীতি, প্রবাসী আয়, রপ্তানি আয়, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, খেলাপি ঋণ ও রাজস্ব আয়-সব সূচকের অবস্থাই অসন্তোষজনক। গত আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২ শতাংশেরও বেশি। এর পাশাপাশি সার্বিক মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে সর্বোচ্চ সাড়ে ৯ শতাংশ। গত এক যুগের মধ্যে এক প্রান্তিকে ৯ শতাংশের বেশি মূল্যস্ফীতি আমরা দেখতে পাইনি। এ মূল্যস্ফীতির বিপরীতে গড় মজুরির হার বাড়েনি। গত এক বছর ধরে মজুরি বৃদ্ধি হওয়ার গড় হার সাড়ে ৭ শতাংশ, যা মূল্যস্ফীতির হারের চেয়ে কম। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভারত, শ্রীলংকাসহ বিভিন্ন দেশ মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনলেও আমরা তা পারিনি।

আমাদের দেশের অর্থনীতির একটি অন্যতম শক্তি হলো প্রবাসী আয়। গত তিন মাস ধরে ধারাবাহিকভাবেই প্রবাসী আয়ের প্রবাহ কমছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম মাসে অর্থাৎ জুলাই মাসে প্রবাসীরা পাঠিয়েছিলেন ১৯৭ কোটি ডলার। আগস্ট মাসে তা কমে দাঁড়ায় ১৬০ কোটি ডলারে এবং সেপ্টেম্বরে তা আরও কমে দাঁড়ায় ১৩৪ ডলারে, যা গত ৪১ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। অথচ বিদেশি শ্রমবাজারে আমাদের শ্রমপ্রবাহ বাড়ছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে সব মিলে ১০ লাখ ৭৪ হাজার কর্মী বিভিন্ন দেশের শ্রমবাজারে যুক্ত হয়েছেন।

রপ্তানির বেলাতেও আশার কিছু নেই। জুলাই, আগস্ট, সেপ্টেম্বরের রপ্তানি আশা জাগাতে পারেনি। শীর্ষ পাঁচটি রপ্তানি পণ্যের মধ্যে পোশাক ছাড়া অন্য চারটির অবস্থা সন্তোষজনক নয়। গত জুলাই মাসে আমাদের মোট রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৪৫৯ কোটি ডলার। আগস্টে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৪৭৮ কোটি ডলারে, কিন্তু সেপ্টেম্বরে তা আবার কমে দাঁড়ায় ৪৩১ কোটি ডলারে।

তিন মাসে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমেছে ৪৪৬ কোটি বা ৪ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র বলছে, গত ৩০ জুন রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ১২০ কোটি ডলার। ৩ অক্টোবরের হিসাবে সেই রিজার্ভের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৬৭৪ কোটি ডলারে। অবশ্য আইএমএফের হিসাব-পদ্ধতি অনুযায়ী, রিজার্ভ এখন ২ হাজার ৯০ কোটি ডলার। আর প্রকৃত রিজার্ভ আরও কম, ১ হাজার ৭০০ কোটি ডলার। সরকারের আয়ের দিকটিও নেতিবাচক। চলতি অর্থবছরে এনবিআর যে পরিমাণ কর আহরণ করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল, প্রথম দুই মাসে তার প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা কম আয় হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, এবারেও বছর শেষে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা কম আয় হবে। অথচ ঋণ পরিশোধের চাপ ক্রমেই বেড়ে চলেছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে বিদেশি ঋণ পরিশোধ আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ৬০ শতাংশ বেড়েছে।

আমাদের এ উদাসীন পথচলা সম্পর্কে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেনের বক্তব্য দিয়েই শেষ করব। তিনি বলেছেন, ঝড় দেখেও আমরা ভুল পথে চলেছি। গত দেড় বছরের অর্থনীতি সামলাতে নীতিনির্ধারকরা যেসব নীতি নিয়েছেন, তা ফল দেয়নি; বরং উলটো হয়েছে। তারা যা চেয়েছেন, তা হয়নি। রিজার্ভ কমেছে, প্রবাসী আয় কমেছে, মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। আবার সামনে নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা আছে। এতে অর্থনীতির সমস্যাগুলো আরও গভীর হবে। তখন শুধু রাজনৈতিক অনিশ্চয়তাকে অজুহাত হিসাবে দেখিয়ে এর দায় চাপিয়ে দেওয়া ঠিক হবে না। এখন থেকে সঠিক নীতি নিতে হবে। নীতিনির্ধারকদের আগে অর্থনীতির সমস্যাকে স্বীকৃতি দিতে হবে।

মুঈদ রহমান : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম