Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

শতফুল ফুটতে দাও

জ্ঞান সৃষ্টিতে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা কী?

Icon

ড. মাহবুব উল্লাহ্

প্রকাশ: ১২ অক্টোবর ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

জ্ঞান সৃষ্টিতে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা কী?

গত কিছুদিন ধরে সংবাদপত্রে পাঠকের আকর্ষণ রাজনৈতিক সংবাদ ও বিশ্লেষণ। আমরা এমন একটি সময় পার করছি, যখন দেশে বড় কোনো ঘটনা ঘটে যেতে পারে। সেজন্য এ মুহূর্তে সংবাদপত্র বড় আকর্ষণের উৎসে পরিণত হয়েছে। সংবাদপত্রে রাজনৈতিক তাৎপর্যপূর্ণ সংবাদ এখন প্রকাশিত হচ্ছে। কিন্তু এর পাশাপাশি ছোটখাটো কিছু সংবাদ পরিবেশিত হয়, যেগুলোর গুরুত্ব রাজনৈতিক সংবাদের তুলনায় কোনো অংশে কম নয়। এমন একটি সংবাদ হলো জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এ বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ক্যাম্পাসে রেগুলার অনার্স কোর্স চালু করতে ইচ্ছুক। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন এটা মানতে পারছে না। কমিশনের বক্তব্য হলো, এ ধরনের একাডেমিক স্কিম জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় আইনের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ভাবনা শুরু হয়েছিল বিগত শতাব্দীর আশির দশক থেকে। সে সময় তিনটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে অনার্স ও পাস কোর্সের ওপর তদারকি চালাত। কোর্স কারিকুলাম তৈরি করা, কলেজগুলোর নিবন্ধন, শিক্ষক নিয়োগ এবং চূড়ান্ত পরীক্ষা গ্রহণ ইত্যাদির দেখভাল করত তিনটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। এ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হলো-ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। এ বিশ্ববিদ্যালগুলো মেডিকেল কলেজগুলোও দেখভাল করত। সময়ের বিবর্তনে কলেজের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মূল ক্যাম্পাসে নতুন ধরনের বিষয়াবলি চালু করার প্রয়োজন দেখা দিল। এর ফলে উল্লিখিত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের প্রশাসনিক কাজকর্ম চালাতে গিয়ে হিমশিম খায়। এ পরিস্থিতিতে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষাবিদরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ওপর কলেজশিক্ষার চাপ কমাতে একটি এফেলিয়েটিং বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। এ চিন্তা থেকে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯৯১ সালে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় এলে দুটি নতুন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়। এ বিশ্ববিদ্যালয় দুটি হলো-জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এবং উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়। চিন্তার দিক থেকে এ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ব্যতিক্রমধর্মী ও অভিনবও বটে।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় আইন পড়ে দেখলে আমরা দেখব এ আইনটি খুবই চমৎকার। এ আইনের খসড়া প্রস্তুত করেছিলেন প্রয়াত অধ্যাপক ড. মুজাফফর আহমেদ। এ আইনের প্রাগ্রসর শিক্ষা অধ্যায়টি পাঠ করলে আমরা বুঝতে পারি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ শুধু কলেজগুলোকে এফিলিয়েট (নিবন্ধন) করা নয়। দুর্ভাগ্যের বিষয়, প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রাগ্রসর শিক্ষার গোড়াপত্তন ও বিকাশের জন্য তেমন কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় আইনের প্রধান দুর্বলতা হলো এ আইনে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অপ্রতিরোধ্য ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। ক্ষমতাকে কেউ যদি কল্যাণের জন্য ব্যবহার করে, তাহলে অনেক মঙ্গল হওয়া সম্ভব। কিন্তু দুঃখের সঙ্গে লক্ষ করা গেছে, এ বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা উপাচার্য ছিলেন তাদের অনেকেই মঙ্গলচিন্তায় মগ্ন ছিলেন না। তাদের বেশিরভাগই দিনগত পাপ ক্ষয়ের মন্ত্রে উজ্জীবিত ছিলেন। ব্যক্তিগতভাবে আমি ছিলাম এ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপ-উপাচার্য। ১৯৯৩ সালের অক্টোবরে আমি এ দায়িত্ব গ্রহণ করি। তখন উপাচার্য ছিলেন ড. আবদুল বারী। তিনি এখন আর বেঁচে নেই। তাই পরলোকগত এ মানুষটি সম্পর্কে মন্তব্য করা শোভন মনে করছি না।

আগেই বলেছি, এ বিশ্ববিদ্যালয় আইনে উপাচার্য হলেন মহাক্ষমতাধর। তার ইচ্ছার বাইরে কোনো কিছু করা সম্ভব ছিল না। প্রতিকূলতা সত্ত্বেও আমি বারবার বলেছি প্রাগ্রসর শিক্ষার স্বার্থে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি উৎকৃষ্ট গ্রন্থাগার, বিজ্ঞান গবেষণার জন্য ল্যাবরেটরি এবং অন্যান্য গবেষণার জন্য মিউজিয়াম থাকা উচিত। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত অনেক কলেজে অনার্স ও মাস্টার্স কোর্স চালু হয়েছে। দিন দিন এ ধরনের কলেজের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এভাবে কলেজগুলোতে অনার্স মাস্টার্স কোর্স চালু হওয়ার পেছনে দেশের বিভিন্ন এলাকার সংসদ সদস্য বিশাল চাপ সৃষ্টি করেন। শেষ পর্যন্ত এ ধরনের চাপ সামাল দিতে না পেরে এমপি সাহেবের চাপের প্রতি আত্মসমর্পণ করতে হয়। নিজ এলাকার কলেজে অনার্স ও মাস্টার্স কোর্স চালু করতে পারলে ভোটের বাজারে সুবিধা পাওয়া যায়। কিন্তু তারা ভাবেন না অনার্স/মাস্টার্স কোর্স পড়ানোর যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষক আছেন কি না। গ্রন্থাগার ও বিজ্ঞানের ল্যাবরেটরি রয়েছে কি না। এসব সুযোগ-সুবিধা তৈরি না করে অনার্স ও মাস্টার্স কোর্স চালু করার ফলে যেসব শিক্ষার্থী এ কলেজগুলোতে ভর্তি হয়, তারা তাদের শিক্ষার স্তরের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ জ্ঞান অর্জন করতে ব্যর্থ হয়। এসব শিক্ষার্থী যে করেই হোক অনার্স ও মাস্টার্সের সনদ পেলেও সনদের দাবি অনুযায়ী জ্ঞান অর্জনে ব্যর্থ হয়। এতে দেশের সময় ও সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় যখন যাত্রা শুরু করে তখন যেনতেন কলেজে অনার্স ও মাস্টার্স কোর্স চালু করতে দেওয়া হয়নি। কিন্তু পরবর্তীকালে রাজনৈতিক চাপ এতটাই প্রবল আকার ধারণ করে, যার ফলে প্রয়োজনীয় পরিবেশ না থাকা সত্ত্বেও অনেক কলেজে অনার্স ও মাস্টার্স কোর্স চালু করতে হয়।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে কিছু শিক্ষক কাজ করছেন। কিন্তু এদের সংখ্যা হাতেগোনা যায়। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে করণিক ও কর্মকর্তারাই এ প্রতিষ্ঠানের লোকবলের ৯০-৯৫ শতাংশ। সাধারণভাবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় যেসব প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও কর্মচারী থাকেন, তাদের কাজ হলো একাডেমিক দায়িত্ব পালনকারী শিক্ষকরা যাতে অনায়াসে তাদের দায়িত্ব পালন করতে পারেন তার জন্য সহায়তা করা। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে সংখ্যার প্রাবল্য সেখানকার পরিবেশ ও পরিস্থিতির নিয়ামক হয়ে গেছে।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় যদি যথার্থ অর্থে তার দায়িত্ব পালন করতে চায়, তাহলে কলেজগুলোর যোগ্য শিক্ষকদের জন্য এর মূল ক্যাম্পাসে এমফিল ও পিএইচডি কোর্স চালু করতে পারে। যতদূর জানা যায়, এ ধরনের কোর্স চালুর আইনগত ব্যবস্থা করা আছে। কিন্তু যোগ্য স্কলারদের আকৃষ্ট করতে ব্যর্থ হওয়ার কারণে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে এমফিল ও পিএইচডি গ্রোগ্রাম যথার্থভাবে চালু করা সম্ভব হচ্ছে না। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অ্যাডভান্সড মাস্টার্স কোর্সও চালু করা যেতে পারে। তবে অনার্স কোর্স চালু করা নিয়ে ভাবতে হবে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষের চিন্তাটি বোধকরি এরকম যে, অনার্স কোর্স চালু করলে প্রচুর শিক্ষার্থী পাওয়া যাবে। এবং এসব শিক্ষার্থীকে ভিত্তি হিসাবে গ্রহণ করে উচ্চতর কোর্সগুলো চালু করা সম্ভব হবে।

বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় আর্থিকভাবে রীতিমতো ধনী একটি বিশ্ববিদ্যালয়। শিক্ষার্থীর সংখ্যার দিক থেকে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজগুলোর শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর তুলনায় ৩০-৪০ গুণ হতে পারে। এদের কাছ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়টি নানা ধরনের ফি আদায় করে। এর ফলে বিশ্ববিদ্যালয়টির পুঁজির তহবিল শতকোটি টাকার ঘরে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অর্থাভাবে গবেষণা প্রোগ্রাম যথাযথভাবে চালু করতে পারছে না। কিন্তু জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে অর্থ কোনো সমস্যা নয়। দেড়-দুই বছর আগে পত্রিকায় পড়েছিলাম সরকার আর অর্থনৈতিক দায় মেটাতে বেশকিছু প্রতিষ্ঠানের সঞ্চিত তহবিল থেকে অর্থ আদায়ের কথা ভাবছে। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ও অন্তর্ভুক্ত ছিল। অলস অর্থ যুক্তিসংগতভাবে ব্যবহার করতে না পারলে সরকার ক্ষমতা প্রয়োগ করে এ অর্থ আদায় করে নিয়ে যেতে পারে। বাংলাদেশে কোনো কারণে সরকারের কাছে অর্থ গেলে সেই অর্থ ফেরতযোগ্য হলেও ফেরত পাওয়া যায় না। কাজেই সময় থাকতে জমা অর্থের সদ্ব্যবহার করা উচিত। গত কয়েক বছরে মূল্যস্ফীতি বাড়-বাড়ন্ত থাকার ফলে সঞ্চিত অর্থ দ্রুত মূল্যমান হারিয়েছে। ব্যাংকগুলো আমানতের জন্য যে সুদ দেয়, তার তুলনায় মূল্যস্ফীতির হার বেশি হওয়ায় সুদের হার ঋণাত্মক হয়ে গেছে। ফলে ব্যাংকে জমা রাখা অর্থের মূল্য দিনের পর দিন হ্রাস পাচ্ছে। এ বিবেচনায় হলেও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তার সঞ্চিত অর্থ একটি ওয়ার্ল্ড ক্লাস জ্ঞান সৃষ্টির কেন্দ্র নির্মাণের কাজে ব্যবহার করার চিন্তা করতে পারে জরুরিভাবে।

ড. মাহবুব উল্লাহ : শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম