সাংবিধানিক পরিবর্তন নারীকে পুরুষ কিংবা পুরুষকে নারী করতে পারে না
মইনুল হোসেন
প্রকাশ: ০২ অক্টোবর ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
সম্প্রতি এক প্রশ্নের উত্তরে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধি দলকে আশ্বস্ত করেছেন যে, আসন্ন সংসদীয় নির্বাচনকে অবাধ ও নিরপেক্ষ করার ব্যাপারে তিনি সরকারের তরফ থেকে সব ধরনের সহযোগিতা পাচ্ছেন। এখন সরকারকে সঠিক সাহায্য প্রদানের কথা বলতে হবে তাকে।
নির্বাচন যাতে অবাধ ও নিরপেক্ষ হয়, সেজন্য আওয়ামী লীগের পীড়াপীড়িতে বিএনপি ও অন্যান্য দল নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যবস্থা যথারীতি সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত করেছিল।
কিন্তু আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে তড়িঘড়ি করে সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে দিয়ে সংবিধানে এমন সংশোধনী সংযোজন করে, যেখানে ক্ষমতাসীন তথা আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এ সংশোধনী এতটাই বিতর্কিত যে, সে সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনায় যেতে চাই না।
এখানে যে বিষয়টি লক্ষণীয় তা হলো, যে আওয়ামী লীগ অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার অপরিহার্য বিবেচনা করেছিল, সেই আওয়ামী লীগ সংবিধানে পরিবর্তন এনে ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠান করে চলেছে। আর তখন থেকে প্রতিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিজয় অর্জন করেছে। তাই আওয়ামী লীগ আর নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রয়োজনবোধ করছে না। প্রধান নির্বাচন কমিশনার সরকারের অবস্থানগত স্ববিরোধিতার বিষয়টি তুলে ধরছেন না।
দলীয় সরকারের অধীনে আসন্ন নির্বাচনে জনগণ যে অবাধে ভোট প্রদান করতে পারবে, তার কী নিশ্চয়তা দিচ্ছে সরকার? সেটা তো প্রধান নির্বাচন কমিশনার ব্যাখ্যা করে বলছেন না। সংসদীয় ব্যবস্থায় নির্বাচিত সরকারের অধীনে কোথাও নির্বাচন করা হয় না, নির্বাচন কমিশনের এখতিয়ার প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে অবশ্যই জানতে হবে। সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক অত্যন্ত উৎসাহ নিয়ে তার নিজস্ব এক ভোটের ব্যবধানে সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগে রায় দিয়ে বললেন, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নির্বাচনকালেও জনগণের নির্বাচিত সরকার থাকতে হবে। নির্বাচনকালে কেয়ারটেকার সরকার বৈধ নয়। অন্যান্য কোনো দেশেই যে নির্বাচিত সরকারের অধীনে নির্বাচন হয় না, তা বুঝতে চাইলেন না।
নির্বাচিত সরকার ও রাষ্ট্রপতির মনোনীত ব্যক্তিদের দ্বারা গঠিত সরকারের মধ্যেকার পার্থক্য বোঝার মতো রাজনৈতিক নেতৃত্বও আমাদের নেই। প্রতিবার নির্বাচনে বিজয় অর্জন করার এমন নিশ্ছিদ্র ভোট কারচুপির ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে, যেখানে জনগণ তার ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারল কিনা সেটা বিবেচ্য বিষয় নয় এবং এ সম্পর্কে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কিছু জানারও প্রয়োজনবোধ করছেন না। এ ব্যবস্থাধীনে নির্বাচন কারচুপি করবে সরকারি কর্মকর্তারা, আর তা দূর থেকে তদারকি করবেন প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং এবং নির্বাচনি নাটক প্রযোজনা করবে নির্বাচন কমিশন। নির্বাচন কারচুপি যে সরকারি কর্মকর্তারা করবে, তাদের সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের কোনো সম্পর্ক থাকবে না, তারা তাদের কাজ করবেন দৃষ্টির আড়ালে থেকে। নির্বাচন প্রতারণার এ মহাপরিকল্পনা কার্যকর করার জন্যই ক্ষমতাসীন সরকারের ক্ষমতায় থাকা এতটা গুরুত্বপূর্ণ।
সরকারের নির্বাচনি কারচুপির নীলনকশা সম্পর্কে আমরা একটা ধারণা দিতে পারি মাত্র, কিন্তু নির্বাচন কমিশন পরীক্ষা করে দেখতে পারে সরকারি কর্মকর্তাদের সম্পৃক্ত করে সরকারের এ বিশাল নির্বাচনি কারচুপি করার পরিকল্পনা কার্যকর করা সম্ভব কিনা। প্রধান নির্বাচন কমিশনার সরকারের এ নির্বাচন কারচুপি করার গুরুত্বপূর্ণ নীলনকশা সম্পর্কে উদাসীন থাকতে পারেন না।
বিরোধীদলীয় রাজনীতিকদেরও পরিষ্কার ভাষায় কথা বলা দরকার। বিগত দুটি সংসদীয় নির্বাচনে তাদের নির্দিষ্টসংখ্যক সিট ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। নির্বাচন এলে সরকার সিদ্ধান্ত নেবে কোন দল সংসদে কয়টি আসন পাবে। উপরন্তু নগদ অর্থও উদারভাবে বিলি-বণ্টন করা হয়েছিল, যাতে এটি পরিষ্কার হয়ে যায়, নির্বাচনের সময়টাই রাজনৈতিক ব্যবসা করে অর্থ উপার্জন করার মোক্ষম সময়।
অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের অনুকূল বাস্তব অবস্থা বিদ্যমান আছে কিনা, সে সম্পর্কে নির্বাচন কমিশনকেই সন্তুষ্ট হতে হবে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার কোন কাজ করার জন্য সরকারের কাছ থেকে সাহায্য পাচ্ছেন? নির্বাচনকালীন কেয়ারটেকার সরকার প্রতিষ্ঠার দাবি ছিল আওয়ামী লীগের, আর আজ আওয়ামী লীগ সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিকে এড়িয়ে যাওয়ার ব্যাপারে সহযোগিতা করে চলেছে নির্বাচন কমিশনকে!
আরও পরিষ্কার ভাষায় বললে, আওয়ামী লীগের বিবেচনায় ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যতীত অবাধ ও স্বচ্ছ নির্বাচন হওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু আওয়ামী লীগ এখন বলছে, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার দরকার নেই। আওয়ামী লীগের এ স্ববিরোধিতা সংকটের জন্ম দিয়েছে। অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য যে ব্যবস্থা অপরিহার্য, তা সাংবিধানিক পরিবর্তন এনে বদলানো যায় না।
বাংলাদেশের জন্মের পর থেকে এখানে যাতে জনগণের সমর্থনপুষ্ট সরকারের বদলে পুতুল সরকার বহাল থাকে তার জন্য গণতন্ত্র ধ্বংসের একটা গভীর ষড়যন্ত্র বলবৎ থাকে।
ব্রিটিশ পার্লামেন্ট সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে যে এর ক্ষমতা অসীম। কেবল নারীকে পুরুষ এবং পুরুষকে নারী করতে পারে না। একইভাবে কোনো নির্বাচন কমিশন কোনো অস্বচ্ছ নির্বাচনকে স্বচ্ছ নির্বাচন ঘোষণা করতে পারে না।
গুপ্তহত্যা ও জোরপূর্বক অপহরণ করার ব্যবস্থা অনুসরণ করার কারণে আমরা সবাই কাপুরুষ ও অদৃষ্টবাদী হয়ে পড়েছি।
সংবিধান আমাদের জীবন রক্ষার অধিকার দিলেও সেটিও লঙ্ঘিত হচ্ছে জাতিসংঘ ও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের পক্ষ থেকে প্রতিবাদ করা সত্ত্বেও।
জনগণের অধিকার রক্ষার বিষয়টি কোনো সরকারের নিজস্ব পছন্দের ব্যাপার নয়, এটি ইউনাইটেড ন্যাশনস কর্তৃক গৃহীত মৌলিক অধিকারের বিষয়, যার সুরক্ষা দিতে হবে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে।
সুতরাং, যুক্তরাষ্ট্র সরকার তার ভিসানীতি ঘোষণার বিষয়টি বাংলাদেশে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের সঙ্গে সম্পর্কিত রেখেছে। তাই আমরা যদি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারি, তাহলে ভিসানীতি স্বয়ংক্রিয়ভাবে অকার্যকর হয়ে যাবে। বিষয়টি ইউএস স্টেট ডিপার্টমেন্টের মুখপাত্র মি. ম্যাথু মিলার ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন, ‘এই মার্কিন ভিসানীতির লক্ষ্য বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন অবাধ, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠান নিশ্চিত করা।’
ভারতের সঙ্গে আমাদের বন্ধুত্ব অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও এবং ভারত বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশকে গণতান্ত্রিক দেশ হিসাবে গড়ে উঠতে সাহায্য করছে কিনা তা এক প্রশ্ন। গণতন্ত্র অর্জনে বাংলাদেশের সংগ্রাম ও রক্তদানের কাহিনি ভারতের অজানা নয়। সেই বাংলাদেশ আজ গণতন্ত্রের সমাধিক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। এখানে আইনের শাসন নেই। আসন্ন নির্বাচন যাতে অবাধ-নিরপেক্ষ হয়, সেজন্য আমরা ভারতের কাছ থেকে সর্বাত্মক সহযোগিতা চাই। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি তো আওয়ামী লীগই করেছিল, যখন সে বিরোধী অবস্থানে ছিল।
সরকারি যন্ত্র পরিচালনার অভিজ্ঞতা তো আমলাদেরই বেশি থাকে। সরকারি রাষ্ট্রযন্ত্রটি যাতে জনগণের স্বার্থে ব্যবহৃত হয়, তা দেখার জন্য শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা রাজনৈতিক নেতাদের থাকতে হয়। তারা নিজেরাও স্বীকার করবেন কী ধরনের শিক্ষা নিয়ে তারা রাজনৈতিক নেতা হয়েছেন। একজন রাজনীতিবিদ বিত্তশালী হওয়ার জন্য রাজনীতি করেন না। রাজনীতিবিদদের গৌরব এবং অহংকার হলো তারা নিঃস্বার্থভাবে জনসেবা করে তাদের যোগ্যতার স্বাক্ষর রাখেন।
সরকার চলছে মূলত আমলাদের ওপর নির্ভরশীল থেকে। সরকার জনবিচ্ছিন্ন হয়েছে বলেই কি নির্বাচনে কারচুপির আমলা-নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। জনগণের ভোটাধিকার অস্বীকার করার অর্থ আমার ও আপনার নাগরিকত্ব অস্বীকার করা। দেশ স্বাধীন, কিন্তু সরকার গঠনে বা পরিবর্তনে ন্যূনতম ভোটের অধিকারও আমাদের নেই। স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের সরকার পরিবর্তনের ভোট থেকে জনগণকে বঞ্চিত রেখে কীভাবে কারা স্বাধীনতার পক্ষশক্তি হিসাবে দাবি করেন, তা বোধগম্য নয়।
ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন : আইন ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ