শতফুল ফুটতে দাও
বাংলাদেশ একদিন নগররাষ্ট্র হতে পারে
ড. মাহবুব উল্লাহ্
প্রকাশ: ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
আজ থেকে ৭-৮ বছর আগে গবেষণা প্রতিষ্ঠান পিপিআরসির একটি সেমিনারে আমি মন্তব্য করেছিলাম, ২০৫০ সালের মধ্যে পুরো বাংলাদেশ একটি নগরীর অবয়ব গ্রহণ করবে। সেমিনারটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টারের সেমিনার কক্ষে। সেমিনারে যারা অংশগ্রহণ করেছিলেন, তাদের মধ্যে একটি বিরাট অংশ ছিল সাংবাদিক। আমার মন্তব্যে সেমিনারে উপস্থিত অনেকেই আমাকে বাংলাদেশ নগররাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার বিষয়ে নানা প্রশ্ন করেছিলেন। এ ধরনের ভবিষ্যদ্বাণী নানা ধরনের প্রশ্নের জন্ম দেয়। এসব প্রশ্নের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, বাংলাদেশের গ্রামগুলো যদি শহরের আদল গ্রহণ করে, তাহলে বাংলাদেশের কৃষির ভবিষ্যৎ কী? এ ধরনের পরিবর্তনে কৃষি পরিণত হয় প্রধান শিকারে। এমনিতেই প্রতিবছর ১ শতাংশ করে কৃষিজমি অকৃষি ব্যবহারে চলে যাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে বেড়ে চলা জনগোষ্ঠীর জন্য খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে উঠছে। আপাতদৃষ্টিতে বাংলাদেশে খাদ্যশস্য উৎপাদনে ঘাটতি না হলেও অধিকাংশ বছর বিদেশ থেকে খাদ্য আমদানি করতে হয়। খাদ্য আমদানির ওপর নির্ভরতা বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর ভীষণ চাপ সৃষ্টি করছে।
বাংলাদেশে খাদ্য নিরাপত্তা বলতে বোঝানো হয় প্রয়োজনীয় খাদ্যশস্য উৎপাদন। বাংলাদেশের কৃষিতে বিগত ১৫-২০ বছরে একটি নতুন প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। কৃষকরা সুযোগ পেলে উচ্চমূল্যের ফসলের আবাদ করছে। উচ্চমূল্য সবজির মধ্যে রয়েছে ব্রোকলি, ক্যাপসিকাম, মাশরুম ইত্যাদি। এছাড়া রয়েছে আম, আনারস, আপেল, কমলা, ড্রাগন ফল, লিচু, পেয়ারা, রামবুটান, কলা ইত্যাদি। পুকুর ও জলাভূমিতে মাছের চাষ হচ্ছে। বাণিজ্যিকভাবে হাঁস-মুরগির খামারও গড়ে উঠছে। ভারসাম্যমূলক খাদ্যের জন্য কৃষিতে ফলজাতীয় ফসলের উৎপাদন এবং মাছের উৎপাদন অবশ্যই কাম্য। তবে আমাদের বুঝতে হবে, এসব ফসলের জন্য যে জমি ব্যবহার করা হয়, সে জমি ধান, গম ও ভুট্টার উৎপাদনের জন্য পাওয়া যায় না। এ কারণে প্রধান খাদ্যশস্য উৎপাদন বিঘ্নিত হয়। উল্লিখিত প্রবণতা বৃদ্ধি পেলে প্রধান খাদ্যশস্যের জোগানে ঘাটতি সৃষ্টি হবে। উচ্চমূল্য ফসলের চাষ করে কৃষকরা লাভবান হচ্ছে। এ কারণে কৃষকদের মধ্যে উচ্চমূল্য সবজি ও ফলফলাদি উৎপাদনে ব্যাপক আগ্রহ পরিলক্ষিত হয়। দীর্ঘদিন এ প্রবণতা অব্যাহত থাকলে কৃষির অভ্যন্তরে একটি বড় ধরনের পরিবর্তন দেখা দেবে। এ পরিবর্তনে প্রধান খাদ্যশস্য উৎপাদনে ঘাটতি সৃষ্টি হলে বিদেশ থেকে খাদ্যশস্য আমদানির ওপর নির্ভরতা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাবে। অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, প্রয়োজনের সময় খাদ্যশস্য আমদানি সংকটের মুখোমুখি হয়। পৃথিবীতে মুষ্টিমেয় কয়েকটি দেশ খাদ্যশস্য রপ্তানি করে। এসব দেশের মধ্যে রয়েছে ভারত, থাইল্যান্ড, মিয়ানমার, ভিয়েতনাম, অস্ট্রেলিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউক্রেন। অনেক সময় খাদ্যশস্য রপ্তানিকারক দেশগুলো উদ্বৃত্ত থাকা সত্ত্বেও খাদ্যশস্য রপ্তানি করতে চায় না। এ সমস্যার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভিঘাত। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে কোথাও দেখা দিচ্ছে খরা আবার কোথাও দেখা দিচ্ছে অতিবৃষ্টি। এ ছাড়া অতি অল্প সময়ের মধ্যে প্রবল বর্ষণে সৃষ্টি হচ্ছে বন্যা। এগুলোর সবকিছুই কৃষি উৎপাদনকে ব্যাহত করে। দেখা যাচ্ছে, খাদ্য উৎপাদন সম্পর্কিত নীতি-কৌশল প্রণয়ন কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে উঠছে। বাংলাদেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার মাঝারি অঙ্কের হলেও সংকট সৃষ্টির জন্য যথেষ্ট। বাংলাদেশিদের এক থেকে দুই কোটি কর্মব্যাপদেশে বিদেশে অবস্থান করার ফলে খাদ্যশস্যের মজুত রক্ষায় কিছুটা নিশ্বাস ফেলার সুযোগ পাওয়া যাচ্ছে। তবে এ সুযোগ কতদিন অব্যাহত থাকবে তা আÍবিশ্বাসের সঙ্গে বলা যাচ্ছে না। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, প্রতিবছর বাংলাদেশের কৃষি জমি ১ শতাংশ হারে অকৃষি কাজে রূপান্তরিত হচ্ছে। এর ফলে খাদ্য নিরাপত্তার ওপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। বর্ধিত জনসংখ্যার জন্য ঘরবাড়ি নির্মাণ, স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল, সরকারি দপ্তর, হাটবাজার, কলকারখানা স্থাপন এবং সড়ক নির্মাণে কৃষিজমি ব্যবহার করার ফলে কৃষিজমি সংকুচিত হচ্ছে। যে ধরনের ভূমি ব্যবহার খাদ্য নিরপত্তার জন্য বাধা হিসাবে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে, সেগুলো গ্রাম থেকে শহরে রূপান্তরের অনুষঙ্গ হিসাবে কাজ করছে। স্বাধীনতা-উত্তরকালে বাংলাদেশে সড়ক, মাহাসড়ক, ফিডার রোড, গ্রামীণ রাস্তাঘাট ইত্যাদি ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পেয়েছে। দেখা গেছে, যেখানেই নতুন সড়ক নির্মিত হচ্ছে, সেখানেই সড়কের দুপাশে দোকানপাট, হাটবাজার গড়ে উঠছে। এসব স্থাপনা সড়ক-মহাসড়কে যানবাহন চলাচলে বিঘ্ন সৃষ্টি করলেও এবং মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনার কারণ হয়ে দাঁড়ালেও এসব প্রবণতাকে রুখে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
বস্তুত সড়ক-মহাসড়ককে ভিত্তি হিসাবে গ্রহণ করে শহররূপী স্থাপনার গুচ্ছশহর জাতীয় বিকাশকে ত্বরান্বিত করছে। মহাকাশে ভ্রাম্যমাণ ভূ-উপগ্রহের ক্যামেরায় এ প্রক্রিয়া চিত্রিত হয়। রাতের অন্ধকারে বৈদ্যুতিক বাতিগুলো ভূ-উপগ্রহের ক্যামেরায় ধরা পড়ে। এ ছবি কালো অন্ধকারে উজ্জ্বল আলোর দ্যুতি হিসাবে ধরা পড়ে। এগুলো মহাসড়ককেন্দ্রিক নগর বিকাশের প্রাথমিক অবস্থা। এ ধরনের সড়ককে চিহ্নিত করা হয়েছে আরবান করিডোর হিসাবে। সড়কভিত্তিক যাতায়াত ব্যবস্থা নগরায়ণের পথকে উন্মুক্ত করে দিচ্ছে। যদি শুরুতেই এ ধরনের বিকাশ পরিকল্পিতভাবে নিয়ন্ত্রণ করা না যায়, তাহলে যে নগরায়ণ হবে, সে নগরায়ণ চরিত্রগতভাবে বিকৃত নগরায়ণ হবে। এ ধরনের নগরায়ণ একেবারেই কাঙ্ক্ষিত নয়। বাংলাদেশের জমিতে এ ধরনের স্থাপনার বিকাশ দেখেই আমি মন্তব্য করে ছিলাম, ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ একটি নগররাষ্ট্রে পরিণত হবে। লুক্সেমবার্গ, সিঙ্গাপুর, হংকং ইত্যাদি নগররাষ্ট্রের আদর্শ উদাহরণ। এ রাষ্ট্রগুলো আয়তনের দিক থেকে ক্ষুদ্র। একটি নগরীর আয়তন যতটুকু হওয়া উচিত, তার চেয়ে এগুলোর আয়তন বেশি নয়। এ নগররাষ্ট্রগুলোতে চমৎকার সুশাসন বিরাজ করছে। এগুলোর অর্থনৈতিক ব্যবস্থা রাষ্ট্রের ভেতরকার উৎপাদন ক্ষমতা এবং অন্য দেশের ওপর আমদানিনির্ভরতা ভারসাম্যমূলক। এসব নগররাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থা খুবই সন্তোষজনক।
সিঙ্গাপুরের জনক লি কুয়ান ইউ যখন মালয়েশিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া সিঙ্গাপুরের দায়িত্ব পেয়েছিলেন, তখন তিনি অশ্রুসজল হয়ে উঠেছিলেন। সিঙ্গাপুরের জনগণের জন্য কীভাবে খাদ্যবস্ত্রের সংস্থান করবেন, সেটাই ছিল তার দুর্ভাবনা। সিঙ্গাপুর তখন ছিল নিছক এক জেলেপল্লি। সিঙ্গাপুরের বৈদেশিক মুদ্রা আহরণের একমাত্র মাধ্যম ছিল সেখানে অবস্থিত ব্রিটিশ সেনা ঘাঁটি। সে ঘাঁটিও গুটিয়ে নেওয়ার চিন্তা করেছিল ব্রিটিশ সরকার। লি কুয়ান ইউ ব্রিটিশ সরকারকে বুঝিয়ে-সমঝিয়ে ঘাঁটিটি আরও কিছু সময়ের জন্য সিঙ্গাপুরে রেখে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। আজ সিঙ্গাপুর পৃথিবীর অন্যতম ধনী দেশ। বাংলাদেশের অনেকের ব্যবসা-বাণিজ্য সিঙ্গাপুরকেন্দ্রিক। চিকিৎসা নেওয়ার জন্য অনেক বাংলাদেশি প্রতিবছর সিঙ্গাপুরে গমন করেন। সিঙ্গাপুর সুশাসিত নগররাষ্ট্রের চমৎকার দৃষ্টান্ত। পুরো বাংলাদেশের ৫৬ হাজার বর্গমাইল এলাকা যদি নগরায়িত হওয়ার পথে ধাবমান হয়, তাহলে এর জন্য কী ধরনের উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হবে, তা নিয়ে গভীরভাবে চিন্তাভাবনা ও গবেষণা করতে হবে। প্রাথমিকভাবে এটুকু বলা যায়, এ উন্নয়নের বৈশিষ্ট্য হবে অকৃষি কাজের জন্য যথাসম্ভব ভূমির ব্যবহার সীমিত করা এবং কৃষির জন্য জমি যথাসাধ্য বরাদ্দ করা। কৃষির রূপ কী হবে এবং অকৃষি খাতে বিশেষায়ন ও স্থানীয়করণ কী রূপ পরিগ্রহ করতে পারে, তার জন্য প্রয়োজন হবে উন্নতমানের গবেষণা। মনে রাখতে হবে সময়ের এক ফোঁড় অসময়ের ১০ ফোঁড়ের সমান।
ড. মাহবুব উল্লাহ : শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ