Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

জেব্রা ক্রসিং সড়কে অনেকটাই শৃঙ্খলা ফেরাতে পারে

Icon

সালাহ্উদ্দিন নাগরী

প্রকাশ: ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

জেব্রা ক্রসিং সড়কে অনেকটাই শৃঙ্খলা ফেরাতে পারে

কয়েকদিন আগে রাতের বেলা শ্যামলী রিং রোডের একটি মার্কেটে স্ত্রীসহ কেনাকাটা করে বাসার দিকে রওয়ানা হয়ে শ্যামলী সিনেমা হলের সামনে রিকশা থেকে নেমে হেঁটে রাস্তা (মিরপুর রোড) পার হওয়ার জন্য দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে আছি। এখানে মিরপুর রোডের উপর একটি ফুটওভার ব্রিজ ছিল, কিছুদিন আগে সেটি ভেঙে ফেলা হয়েছে। এখন মানুষজনের রাস্তা পার হওয়ার স্বীকৃত কোনো পন্থা নেই। রাস্তার যেসব অংশে দুই ডিভাইডারের মাঝে ফাঁক আছে, রাস্তা পার হওয়ার জন্য সেই অংশগুলোকে বেছে নেওয়া হচ্ছে। বেপরোয়া গতির চলন্ত যানবাহনকে পাশ কাটিয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কোনোভাবে রাস্তা পার হতে হচ্ছে।

স্ত্রীসহ এভাবে তো রাস্তা পার হতে পারব না, তাই উপায়ান্তর না দেখে শুধু রাস্তা পার হওয়ার জন্য আড়াই’শ টাকায় বাসা পর্যন্ত সিএনজি অটোরিকশা নিতে হলো, যে পথটুকুর রিকশা ভাড়া সর্বোচ্চ ৩০ টাকা। এখানে মিরপুর রাস্তার দুপাশেই বসতি ও প্রচুর দোকানপাট আছে এবং মানুষের রাস্তার এপার-ওপার হতে ভোগান্তির শেষ থাকে না। তাই মনে হয়, যেসব রাস্তায় রিকশা চলাচল বন্ধ, কিন্তু রাস্তার দুই পাশের এলাকায় রিকশা চলে এবং মানুষজনকে হরহামেশা এপার-ওপার হতে হয়, সেখানে অবশ্যই রিকশা পারাপারের ব্যবস্থা রাখা দরকার।

যাক মূল প্রসঙ্গে আসি। ব্যস্ত রাস্তাগুলো পার হওয়া আসলেই কঠিন কাজ। ঢাকা শহরে যানজটের কারণে এমনিতেই ২০ কিলোমিটারের বেশি গতিতে গাড়ি চালানো যায় না। তার মধ্যে সুযোগ পেলেই ড্রাইভারদের লাগামহীন গতি মানুষকে ভয় পাইয়ে দেয়। উন্নত দেশগুলোয় রাস্তায় চলা গাড়িগুলোকে দেখে ভয় লাগে না। রাজপথ কাঁপিয়ে পথচারীর বুকে কাঁপন তৈরি করে না। আর আমাদের নগরজুড়ে ঠিক এর বিপরীত চিত্র। ঢাকা শহরের প্রায় সব রাস্তার উঁচু উঁচু ডিভাইডার টপকে দ্রুতগতির যানবাহনের ফাঁক গলিয়ে এলোমেলোভাবে রাস্তা পার হতে জনগণ যেমন চরম ঝুঁকির মধ্যে পড়েন, ঠিক তেমনি যানবাহনের স্বাভাবিক গতিও বিঘ্নিত হয়, আর এতে করে শহরজুড়ে রাস্তাগুলোয় অরাজকতা বিরাজ করে।

যানবাহন চলাচল নির্বিঘ্ন ও মানুষজনের রাস্তা পার হওয়াকে বিপদমুক্ত রাখতে বহু আগে থেকেই ফুটওভার ব্রিজের প্রচলন হয়েছে। কিন্তু রাস্তা পারাপারে মানুষের মধ্যে ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহারে আগ্রহই নেই। অনেকে সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠতে চান না, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রোড ডিভাইভার লাফিয়ে, যানবাহন মাড়িয়ে, গাড়ির সামনে দুহাত তুলে আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে রাস্তা পার হন। অনেক মহিলা কোলে এক শিশু, হাতে আরেক শিশু এবং পিঠে স্কুল গোয়িং সন্তানের ব্যাগ চড়িয়ে রাস্তা পার হন। অনেকেই পায়ে ব্যথা, কোমরে ব্যথা এবং অন্যান্য শারীরিক অসুস্থতার জন্য ফুটওভার ব্রিজে উঠতে-নামতে পারেন না। আবার তাদের অপারগতাকে অ্যাড্রেস করতে গিয়ে সব ফুটওভার ব্রিজে লিফট লাগানো সম্ভব নয়। তাই ওই ধরনের মানুষকে ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহারে চাপ দেওয়া যাচ্ছে না। আবার ভীতি নিয়ে তাদের রাস্তা পার হওয়াকেও সমন্বয় করা হচ্ছে না। ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহারে অনীহা সত্ত্বেও ঢাকার যে ব্রিজগুলো নষ্ট হয়ে গেছে, সেগুলো ভেঙে এবং শ্যামলী সিনেমা হলের সামনে আবার নতুন করে ফুটওভার ব্রিজ তৈরি হচ্ছে।

ফুটওভার ব্রিজ তৈরিতে জায়গার যেমন অপচয় হয়, ঠিক তেমনি অনেক টাকাও খরচ হয়। সঠিক মেইনটেনেন্সের অভাবে পুরো স্থাপনাটি কদর্য আকার ধারণ করে, দিনে ফেরিওয়ালা ও রাতে ভাসমান মানুষের দখলে চলে যায়, এমনকি সেখানে অনৈতিক কার্যকলাপের কথাও শোনা যায়। আমাদের শহরগুলোয় যে আঙ্গিকে ফুটওভার ব্রিজ তৈরি হয়, তাতে শহরের বা রাস্তার সৌন্দর্যবর্ধন দূরে থাক, বরং সৌন্দর্যের হানি ঘটে। ঢাকা শহরে ফুটওভার ব্রিজের সংখ্যা ৮৯, তবে অনেকগুলোই ব্যবহৃত হয় না। তিনটি আন্ডারপাসও তৈরি হয়েছে পথচারী পারাপারের জন্য; কিন্তু এগুলোর দশা ফুটওভার ব্রিজের মতোই।

একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত এক দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী প্রতিদিন মগবাজার থেকে ধানমন্ডিতে যান। বাংলামোটরে এসে তাকে আবার রিকশা বদলাতে হয়, বাংলামোটর মোড়ের ফুটওভার ব্রিজে ওঠার জন্য অনেক দিন চেষ্টা করেছেন, কিন্তু তড়িঘড়ি করে ওঠা সম্ভব হয়নি। তাই এ ধরনের মানুষের জন্য রাস্তা পার হওয়া খুবই কঠিন একটি কাজ।

রাস্তা পারাপারে ফুটওভার ব্রিজ কি আধুনিক কোনো কনসেপ্ট? পৃথিবীর ঘনবসতিপূর্ণ ব্যস্ত কয়টা শহরে ফুটওভার ব্রিজ আছে? উন্নত দেশগুলো থেকে এগুলো অপসারিত হয়েছে এবং হচ্ছে। বিশ্বে ফুটওভার ব্রিজ তৈরির কনসেপ্টটি চালু হওয়ার সময় রাস্তায় যানবাহনকে অগ্রাধিকার দিয়ে তার চলাচল নির্বিঘ্ন রাখতে ফুটওভার ব্রিজ তৈরি হয়। সময় পালটেছে, এখন জনসাধারণ বা পথচারীকে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। ফুটওভার ব্রিজ অসুস্থ, বৃদ্ধ, শিশুদের জন্য ব্যবহারবান্ধব নয়। তাই উন্নত দেশগুলোয় ট্রাফিক সিগন্যালকে উন্নত করে জনগণের চলাচলকে সহজ করার চেষ্টা করা হচ্ছে। এ ধরনের প্রেক্ষাপটে রাস্তা পারাপারে জেব্রা ক্রসিংয়ের দিকেই মনোযোগ বাড়ছে।

পথচারী পার হওয়ার জন্য রাস্তার মাঝে আড়াআড়িভাবে যে দাগ দেওয়া হয়, তাকেই জেব্রা ক্রসিং বলে। এ দাগগুলো সাধারণত ৪০-৬০ সেন্টিমিটার প্রশস্ত হয়। হলুদ, অফহোয়াইট, কমলা, সাদা বিভিন্ন রঙের জেব্রা ক্রসিং থাকলেও সবচেয়ে বেশি প্রচলিত রং সাদা। কালো-সাদার আড়াআড়ি নকশা জেব্রাসদৃশ হওয়ায় সেখান থেকে জেব্রা ক্রসিং নামের উৎপত্তি বলে অনেকেই মনে করেন। ১৯৫১ সালে যুক্তরাজ্যে সব এলাকায় জেব্রা ক্রসিং পদ্ধতি চালু হয় এবং পরবর্তীকালে বিশ্বের অন্যান্য দেশেও পথচারী পারাপারের জন্য তা জনপ্রিয় হয়ে উঠে।

আমাদের রাজধানীর সড়কগুলোর কোনো কোনো জায়গায় জেব্রা ক্রসিং থাকলেও পথচারীরা এর কোনো সুবিধা পাচ্ছেন না। এর একমাত্র কারণ হলো জেব্রা ক্রসিংকে কার্যকর করার চেষ্টা করা হচ্ছে না। তাই পথচারীরা একেকজন একেক দিক দিয়ে রাস্তা পার হন। আমাদের গাড়িচালকরা জেব্রা ক্রসিংয়ের সামনে যানবাহন থামানো বা গতি কমানো কোনোটিতেই অভ্যস্ত নয়। ফলে মানুষকে জেব্রা ক্রসিংয়ের উপর দিয়েই ঝুঁকি নিয়ে সড়ক পার হতে হয়। কখনো কখনো তো জেব্রা ক্রসিংয়ের বাস থামিয়ে যাত্রী ওঠানামাও করানো হয়। জেব্রা ক্রসিংয়ের বিধি মানতে চালকদের কোনো বাধ্যবাধকতায় আনা হয়নি। তাই তাদের মধ্যে সচেতনতা ও দায়িত্ববোধ সৃষ্টি হয়নি।

উন্নত দেশগুলোয় রাস্তা পারাপারে জেব্রা ক্রসিংই অন্যতম পন্থা। উন্নত দেশে জেব্রা ক্রসিং দিয়ে একজন মানুষও যদি রাস্তা পার হয়, তাহলেও সব গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকে। ওসব দেশে পথচারীকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। পঙ্গু, বৃদ্ধ, অসুস্থ ব্যক্তি হুইলচেয়ারে করে এবং মা শিশুসন্তানকে কোলে, কাঁখে, প্যারাম্বুলেটরে নির্বিঘ্নে রাস্তা পার হচ্ছেন। কোনো হুড়োহুড়ি নেই, ভয় নেই, ভীতি নেই।

জেব্রা ক্রসিংয়ের ব্যাপারে অনেকের ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিও আছে। অনেকেই বলেন, আমাদের শহরগুলোর জনসংখ্যা অত্যধিক, যদি মূল সড়কে জেব্রা ক্রসিং দিয়ে মানুষ পারাপার হয়, তাহলে গাড়ি ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তায় আটকে থাকবে। এতে যানজট আরও বাড়বে।

জেব্রা ক্রসিংকে আরও কার্যকর ও পথচারীবান্ধব হিসাবে তৈরি করতে এখনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে এবং এরই ধারাবাহিকতায় এখন চালু হয়েছে থ্রিডি জেব্রা ক্রসিং, যা পেইন্টিংয়ের মাধ্যমে রাজপথে এক ধরনের ইলিউশন তৈরি করে। ফলে গাড়িচালকরা স্বাভাবিক গতি কিংবা তার তুলনায় অধিক জোরে গাড়ি চালালেও এ থ্রিডি পেইন্টিংয়ের সামনে এলেই তা রাস্তা থেকে খানিকটা উপরে উঠে রয়েছে মনে হয়, ফলে ধাক্কা লাগার একটা আশঙ্কা তৈরি হওয়ায় বাধ্য হয়ে বিপদ এড়াতে তারা স্বাভাবিকভাবেই গাড়ির গতি কমিয়ে দেয়। এতে করে পথচারী থেকে শুরু করে গাড়িচালক প্রত্যেকেই অতিরিক্ত সাবধান হয়ে যায় বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। আর এজন্য সংযুক্ত আরব আমিরাত থ্রিডি প্রযুক্তির জেব্রা ক্রসিং প্রচলন করেছে, যা অতি সহজেই চালকদের চোখে পড়বে।

প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকেন, যানবাহনের গতি কিছুটা কমলে পার হবেন এ আশায়। এভাবে অপেক্ষায় থাকতে থাকতে দেরি হয়ে যায়, যথাসময়ে গন্তব্যে পৌঁছতে পারেন না, এ তো প্রতিদিনের রাজপথের সাধারণ চিত্র। এমনকি জেব্রা ক্রসিংয়ে দাঁড়িয়েও কোনো কাজ হয় না। এভাবে মানুষের কত কর্মঘণ্টা যে শেষ হয়ে যায়, সে হিসাবটা একটু করা দরকার। জেব্রা ক্রসিং যে রাস্তা পারাপারের একটি উপায়, সেটি আমাদের দেশে প্রতিষ্ঠা পায়নি। তাই গাড়িচালক জেব্রা ক্রসিংয়ে গাড়ি থামান না, আর আমরাও যেখানে-সেখানে রাস্তা পার হই। কার্যকর জেব্রা ক্রসিংয়ের ব্যবস্থা না থাকা ও ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহারে অনীহার কারণে যানবাহনের ফাঁক গলিয়ে ঝুঁকি নিয়ে পথচারী রাস্তা পারাপার হন।

জেব্রা ক্রসিং পথচারীর জন্য ইউজার ফ্রেন্ডলি। এখানে সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠতে বা নিচে নামতে হয় না। ফুটওভার ব্রিজ ও আন্ডারপাসের অস্বস্তিকর ময়লা-আবর্জনার মুখোমুখি হতে হয় না। সর্বোপরি সময়ের অপচয় হয় না। জেব্রা ক্রসিংয়ে রাস্তায় রং লাগানো ও ক্ষেত্রবিশেষে দুপ্রান্তে সিগন্যাল লাইট লাগানো ছাড়া আর বাড়তি কোনো খরচ থাকে না। মানে অনেকটা নিঃখরচায় জেব্রা ক্রসিং প্রস্তুত করা যায়।

পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোয় জেব্রা ক্রসিংই রাস্তা পারাপারে সর্বাধিক পছন্দের। যানবাহন চলাচল ও সাধারণ মানুষের রাস্তা পার হওয়াকে সমন্বয় করার জন্য আমাদের ট্রাফিক সিগন্যাল উন্নতকরণ এবং জেব্রা ক্রসিংয়ের দিকে ঝুঁকতে হবে। রাজধানীর রাস্তায় জেব্রা ক্রসিংয়ের ব্যবহার প্রতিষ্ঠা করতে পারলে সড়কে শৃঙ্খলা বাড়বে বলে আশা করি।

সালাহ্উদ্দিন নাগরী : কলাম লেখক

snagari2012@gmail.com

 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম