বাউল সাধক উকিল মুন্সী
সাজ্জাদুল হাসান
প্রকাশ: ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
বাউল শিল্পী বা বাউল সাধক একটি বিশেষ ধরনের গোষ্ঠী ও লোকাচার সংগীত পরিবেশক, যারা গানের সঙ্গে সুফিবাদ, দেহতত্ত্ব প্রভৃতি মতাদর্শ প্রচার করে থাকেন। বাংলাদেশে ভাবসংগীত ও মরমি কিংবা সুফি চিন্তার ফলে বাউল দর্শনের উদ্ভব হয়েছে। বিভিন্ন শিল্পীর কণ্ঠে উকিল মুন্সীর গান গণমাধ্যম, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে প্রচার হলেও কে এই উকিল মুন্সী? তার প্রকৃত নামই বা কি? কীভাবে তিনি আজকের উকিল মুন্সী হলেন, আমাদের ভাটি অঞ্চলে অনেকের জানা থাকলেও আবার অনেকের কাছে তা অজানা। তার অনন্য সৃষ্টিকে ব্যবহার করে কেউ কেউ জনপ্রিয় হয়েছেন; কিন্তু উকিল মুন্সী রয়ে গেছেন দৃষ্টির আড়ালে। উকিল মুন্সীর সম্মান ও স্বীকৃতি আরও বেশি হয়তো প্রাপ্য। তাই বাউল সাধক, গীতিকার, সুরকার উকিল মুন্সী সম্পর্কে ক্ষুদ্র পরিসরে মানুষের কাছে তথ্যগুলো পৌঁছে দেওয়াই আজকের এ লেখার উদ্দেশ্য।
গানের জগতে উকিল মুন্সী ছিলেন এক বিরহী ডাহুক। তিনি নারী-পুরুষের অন্তরের আকুতি, প্রেম-ভালোবাসা, সুখ-দুঃখ, বিরহ গাথা নিয়ে গান রচনা করতেন এবং সৃষ্টিকর্তাকে উদ্দেশ্য করে বিরহের অনুভূতি প্রকাশ করতেন। উকিল মুন্সীর জীবদ্দশায় সাধারণ মানুষ তাকে মরমি কবি উকিল মুন্সী, বাউল ফকির উকিল মুন্সী, দরদি বাউল উকিল মুন্সী, বাউল কবি উকিল মুন্সী প্রভৃতি নামে ডাকতেন। প্রকৃত অর্থে তিনি ছিলেন একজন বিরহী বাউল। তার গান ও সুরে বিরহের ব্যাকুলতা প্রাধান্য পেয়েছে। হাওড়াঞ্চলের বিচ্ছেদ গানের ধারায় তিনিই ছিলেন শ্রেষ্ঠ এবং আদরণীয়।
উকিল মুন্সী ১৮৮৫ সালে ১১ জুন নেত্রকোনা জেলার খালিয়াজুরী উপজেলার নূরপুর বোয়ালী গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার প্রকৃত নাম আব্দুল হক আকন্দ। তার পিতার নাম গোলাম রসুল আকন্দ ও মাতা উকিলেন্নেসা। বিচিত্র এবং নির্মোহ জীবনযাপন করেছেন তিনি। একদিকে মসজিদের ইমামতি, অন্যদিকে সুরের সাধনায় তিনি এ অঞ্চলের মানুষের জীবনকেই হাজির করেছেন গানে। আব্দুল মজিদ নামে তার এক ছোট ভাই ছিল। পিতা-মাতা চেয়েছিলেন ছেলে লেখাপড়া শিখুক; কিন্তু বিধি বাম। শৈশবেই বাবাকে হারান। গৃহশিক্ষকের কাছে তিনি শৈশবেই বাংলার পাশাপাশি আরবি, ফারসি ও পবিত্র কোরআন শিক্ষা নেন। পিতাকে হারানোর পর পড়াশোনা আর বেশিদিন করা হয়নি উকিল মুন্সীর। জীবদ্দশায় মোহনগঞ্জের জৈনপুর, গাগলাজুর, শ্যামপুর, আটবাড়ি বিভিন্ন জায়গায় দিনযাপন করেন তিনি। উকিল মুন্সীর বয়স যখন ৩০ বছর, তখন তিনি ইবাদতের জন্য মসজিদে চলে যান এবং সেখানে তিনি ইমামতি করেন ও ছেলেমেয়েদের আরবি পড়ান। নির্জনে উকিল মুন্সী নিজেই গজল রচনা করতেন এবং উচ্চস্বরে সুমধুর কণ্ঠে গাইতেন। গভীর রাতে তাহাজ্জুদ নামাজ শেষে তিনি সুমধুর কণ্ঠে কুরআন তেলাওয়াত করতেন ও গজল গাইতেন। এভাবেই তিনি রাত পার করতেন। উকিল মুন্সী ইমামতির পাশাপাশি গান-বাজনা করতেন এবং গান লিখতেন। বিশেষ দোয়া-মাহফিল এবং ঈদের নামাজের ইমামতির জন্যও তিনি সুবিদিত ছিলেন। মোনাজাতে বিলাপে বিলাপে এমন সুর ও কথা বলতেন, উপস্থিত মুসল্লিরা অঝোরধারায় চোখের পানি ফেলতেন। শৈশব থেকেই তিনি ঘেটুগান, গজল এগুলোর সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তৎকালীন ভাটি অঞ্চলে ঘেটুগানের খুব প্রচলন ছিল। উকিল মুন্সী নিয়মিত বিভিন্ন গ্রামে গিয়ে সারারাত ঘেটু গান শুনতেন। ঘেটু গান তার অন্তরকে নাড়া দিলে ঠিক করেন যে তিনি নিজেই ঘেটু গান রচনা করবেন এবং গাইবেন। কিশোর উকিল মুন্সীর মধুর ও দরাজ কণ্ঠে দর্শক-শ্রোতা নিমেষেই মুগ্ধ হতেন। উকিল মুন্সীর বয়স যখন ১৮-২০ বছর তখন থেকেই ঘেটু গানের দলের সঙ্গে যুক্ত হয়ে বর্ষাকালে নেত্রকোনা, হবিগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ ও ময়মনসিংহসহ ভাটি অঞ্চলে গান পরিবেশন করতেন। সুমধুর কণ্ঠের কারণে তিনি খুব অল্প সময়েই জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন।
অনেকেই প্রশ্ন করেন, তার নাম তো ছিল আব্দুল হক আকন্দ, তিনি কীভাবে উকিল মুন্সী হলেন? এই প্রশ্নের মীমাংসা করা খুব সহজ হবে না। তবে ধারণা করা হয়, উকিল নামটা শৈশবেই তার ডাকনাম হিসাবে যুক্ত হয়ে যায়। মায়ের নাম ছিল উকিলেন্নেসা। তার মা চাইতেন ছেলে লেখাপড়া করুক, উকিল হোক। আইনের লোক হোক। মসজিদে ইমামতি করার পরে মুন্সী যুক্ত হয়েছে।
উকিল মুন্সী হাজারেরও বেশি গান লিখেছেন। বর্তমানে বেশিরভাগ গানের সন্ধান পাওয়া যায় না। তার জনপ্রিয় গানের মধ্যে রয়েছে ‘আষাঢ় মাইস্যা ভাসা পানিরে’, ‘আমার গায়ে যত দুঃখ সয়’, ‘লিলুয়া বাতাসে’ উকিল মুন্সীর আলোচিত গানগুলোর অন্যতম। এই গানগুলো বাংলাদেশের সব শ্রেণির মানুষের কাছে খুবই জনপ্রিয়। প্রয়াত নাট্যকার ও নির্মাতা হুমায়ূন আহমেদের ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ সিনেমায় উপরের প্রথম দুটি গান ব্যবহারের পর, হৃদয় স্পর্শ করা কথা ও সুরের জন্য গানগুলো মানুষের অন্তরে জায়গা করে নেয়। বিংশ শতাব্দীর গ্রামীণ বাংলার জীবনকে নিয়ে রচিত হুমায়ূন আহমেদের বহুকেন্দ্রিক উপন্যাস ‘মধ্যাহ্ন’র অন্যতম চরিত্র উকিল মুন্সী।
পিতা-মাতাহীন উকিল মুন্সীর মনের অতৃপ্তি, অনাদর-অবহেলা, প্রিয়জনের ভালোবাসাহীনতা, গভীর শূন্যতা থেকেই নিজের মনে বিরহকে লালন করেছিলেন। তিনি প্রাপ্তবয়সে বাউল সাধনায় মগ্ন হন। তার অসংখ্য গান এখনো মানুষের হৃদয়ে স্থান দখল করে আছে। তার গানের দার্শনিক মূল্যবোধ ভাটি অঞ্চলের মানুষের চিন্তাকে ব্যাপক প্রভাবিত করেছে। বাংলা বিচ্ছেদ গানের সাধক পুরুষ তিনি। বাউল গানের জগতে তিনি এমন এক বিচ্ছেদ গানের সুর স্থাপন করেছেন যা স্বতন্ত্র এবং অনন্য।
মরমি এই কবি ১৯৭৮ সালের ডিসেম্বর মাসের ১২ তারিখে এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন। উকিল মুন্সীর ইচ্ছা ও নির্দেশনা অনুযায়ী তাকে জৈনপুর গ্রামের বেতাই নদীর কোলঘেঁষা বাড়ির উঠানে পুত্রের সমাধির পাশে দাফন করা হয়। মরমি বাউল সাধক উকিল মুন্সীর সমাধিক্ষেত্রটি বহুদিন অবহেলিত ছিল। তার সমাধিক্ষেত্র কীভাবে উন্নয়ন করা যায়, জনগণকে কীভাবে সম্পৃক্ত করা যায়, সে বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে যখন কর্মরত ছিলাম তখন থেকেই চিন্তা করি। বারবার সেখানে ছুটে গেছি। উকিল মুন্সীর পুত্রবধূ বাউল সাধক আব্দুস সাত্তারের স্ত্রী ফুলবানুর সঙ্গে কথা বলেছি। উকিল মুন্সী এবং তার পুত্র সাত্তারের সমাধির পাশেই একটি জীর্ণশীর্ণ বাড়িতে আব্দুস সাত্তারের স্ত্রী বসবাস করতেন। দেখে খুব কষ্ট পেলাম। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা প্রায়ই বলেন, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড তৃণমূলে ছড়িয়ে দিতে হবে। শত শত বাউলের প্রতিভা গ্রামে-গঞ্জে ছড়িয়ে আছে। তাই হাওড় অঞ্চলকে, উকিল মুন্সীর আঙিনাকে কীভাবে সাংস্কৃতিক বলয়ের মধ্যে আনা যায়, যাকে কেন্দ্র করে গ্রামে-গঞ্জে সাংস্কৃতিক আবহ সৃষ্টি হবে- তা ভাবতে থাকি। একই সঙ্গে সমাধিক্ষেত্রটিও সংস্কারের চিন্তা করি। বেতাই নদীর পাড়ে মনোরম পরিবেশে ‘উকিল মুন্সী সাংস্কৃতিক কেন্দ্র’ নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হলো। চার কোটি ২২ লক্ষ ২৩ হাজার ৫০০ টাকা ব্যয়ে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে উকিল মুন্সী সাংস্কৃতিক কেন্দ্র নির্মাণের কাজ ২০২০ সালের ২০ সেপ্টেম্বর শুরু হয়ে ২০২২ সালের ৩১ ডিসেম্বর শেষ হয়। প্রকল্পের প্রধান কাজগুলো হলো : ১. সমাধিস্থল সংস্কার ও উন্নয়ন, ২. সংগীতচর্চার জন্য ভবন, ৩. উন্মুক্ত মঞ্চ, ৪. নদীর পাড়ে ঘাটলা, ৫. সীমানা প্রাচীর, ৬. উকিল মুন্সীর পরিবারের জন্য একটি আবাসিক ভবন, ৭. দেওয়ালে টেরাকোটা, ৮. দৃষ্টিনন্দন গেট, ৯. রান্নাঘর ইত্যাদি। আনন্দের বিষয়, ১২ মার্চ ২০২৩ তারিখে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাননীয় প্রতিমন্ত্রী কেএম খালিদ এমপি দৃষ্টিনন্দন এ স্থাপনাটি উদ্বোধন করেন। অবশেষে সংস্কৃতিমনা ভাটি অঞ্চলের মানুষের বহুদিনের লালিত স্বপ্নের পূর্ণতা পায়।
মরমি বাউল সাধক উকিল মুন্সী স্মৃতিকেন্দ্রের মাধ্যমে বাংলার আবহমানকালের প্রাচীন শিল্প, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যমণ্ডিত লোকসংগীত নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা হবে। এ লক্ষ্যে বিভিন্ন ধরনের সাংস্কৃতিক উৎসবের আয়োজন করা হবে। মরমি বাউল সাধক উকিল মুন্সী স্মৃতি কেন্দ্রের মাধ্যমে নেত্রকোনা জেলার অন্যান্য বাউল শিল্পী, সাধক ও মনীষীদের কর্মময় জীবন, লোকসংগীতে তাদের অবদান জনসমক্ষে তুলে ধরার লক্ষ্যে কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে। এসব আয়োজনের লক্ষ্য বাংলার লোকায়ত সংস্কৃতির অসাম্প্রদায়িক, উদার ও মানবতাবাদী চেতনায় মানুষকে উদ্বুদ্ধ করা। এক্ষেত্রে উকিল মুন্সীর মতো অসামান্য বাউল সাধক আমাদের জন্য অফুরন্ত প্রেরণার উৎস।
সাজ্জাদুল হাসান : সংসদ সদস্য (নেত্রকোনা-৪)