র্যাগিং নামের কাপুরুষতা বন্ধ হোক
পবিত্র সরকার
প্রকাশ: ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
যাদবপুরে যে মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড ঘটে গেল তার চুলচেরা বিশ্লেষণ হয়েছে ও হবে, প্রতিবাদ হয়েছে ও হবে। এখন এটি আইনের দখলে চলে গেছে, আইন তার পথ ধরে চলবে (আশা করি)। নিশ্চয়ই অপরাধীদের শাস্তি লঘু করার জন্য তাদের শুভানুধ্যায়ীরা যথাসাধ্য চেষ্টা করবেন, সেটা তাদের অধিকারের মধ্যেই পড়ে। আমি এ চেষ্টাগুলোকে অবৈধ বলি না। কিন্তু স্বপ্নদীপের ওপর নৃশংস অত্যাচার আর তাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া যে অমার্জনীয় অপরাধ এবং এ অপরাধের ‘দৃষ্টান্তযোগ্য শাস্তি’ হওয়া দরকার, এ সম্বন্ধে কোনো দ্বিমত কোথাও থাকার কথা নয়। যদিও আমি খুব সংশয়ে আছি, শেষ পর্যন্ত কতদূর কী হবে তাই নিয়ে। অপরাধীদের বাঁচাতে কোনো ‘প্রভাবশালী মহল’ (শুধু রাজনৈতিক অর্থে নয়) নেমে পড়বে কিনা তা এখনো বোঝা যাচ্ছে না। এখনই ‘এ আমার এ তোমার পাপ’ গোছের একটা ধুয়ো উঠেছে, কোথাও ক্ষীণ একটা সহানুভূতির ঢেউও যেন জাগছে-কারও জীবন বা কেরিয়ার নষ্ট হতে চলেছে, এ আশঙ্কা কেউ কেউ প্রকাশ করছেন। আমার ধারণা, এটি একটা নির্লজ্জ শ্রেণি-পক্ষপাত। অপরাধীরা লেখাপড়া করা (‘শিক্ষিত’ বলতে চাইছি না, সবাই তা নয়) মধ্যবিত্ত সন্তান না হলে, অর্থাৎ ‘আমাদের’ অংশ না হলে এ সহানুভূতির হাওয়া উঠত না। যদি খুনিরা, দাগি অপরাধী না হলেও, তথাকথিত ‘ভদ্রলোক’ সমাজের বাইরের ‘ওরা’ হতো, তাহলে এ চাপা দীর্ঘশ্বাস কি তৈরি হতো? যে শ্রেণিই করুক, অপরাধ অপরাধই, তা-ও সজ্ঞানে বীভৎস অত্যাচার আর খুন। ‘দৃষ্টান্তযোগ্য শাস্তি’ বলতে সবাই যা বোঝে, আমিও তাই বুঝি, যাতে এ অপরাধ বা অপরাধের ইচ্ছা চিরকালের মতো বন্ধ হয়। কিন্তু শুধু এই একটা মাত্র কাজ করলে সব সমস্যার সমাধান হবে না। আবার আমার এ কথার মধ্যে যেন কেউ অপরাধীদের প্রতি সহানুভূতি না দেখেন। স্বপ্নদীপের মতো একটি ছেলের খুনিদের যে শাস্তি প্রাপ্য, তা তাদের দিতে হবে।
এ অপরাধের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন দায়ী, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এবং সর্বোচ্চ স্তরের প্রশাসন। তাদের দীর্ঘদিনের শৈথিল্য এ ব্যবস্থাকে প্রশ্রয় দিয়েছে, উৎসাহ দিয়েছে। উপাচার্য, নিবন্ধক ইত্যাদিরা এসেছেন আর গেছেন (এখন আরও খুব তাড়াতাড়ি আসেন আর যান, আগেকার দিনের সিনেমার ফাস্ট মোশনের দৃশ্যের মতো), কিন্তু কেউ ভীমরুলের চাকে ঘা দেওয়ার সাহস করেননি। তার বিরুদ্ধে নানা আন্দোলনের ফলে একজন প্রভূত অজনপ্রিয় পদত্যাগকারী উপাচার্য নাকি এসব ভালো কাজ করেছিলেন বলে এখন দাবি করছেন, সে সম্বন্ধে প্রত্যক্ষদর্শীরা বলতে পারবেন। নেশার আড্ডা তৈরি হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনের রাস্তায়, তা-ও বন্ধ করা যায়নি। কাজেই শুধু অপরাধীদের শাস্তি দিলে এ অনাচার বা অপরাধ বন্ধ হবে তা নয়। প্রশাসনকে অনেক অপ্রিয়, কিন্তু বজ কঠিন পদক্ষেপ নিতে হবে। তারাও শ্রেণি-পক্ষপাতে ভোগে; ভাবে, ‘আহা, এরা তো আমাদেরই ঘরের ছেলেমেয়ে!’ রাজ্যের শিক্ষা-প্রশাসন এ বিষয়টায় এখন নজর দিচ্ছে এ-ও খুব ভালো কথা। অনেক আগেই নজর পড়লে হয়তো ভালো হতো। ইউজিসি তো সেই কবে থেকেই অ্যান্টি-র্যাগিং বিধি চালু করেছে। এটা সারা দেশের অভিশাপ বলে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ‘স্বাধিকার’ আছে বলে এ অন্ধকার দিকগুলো সম্বন্ধে উদাসীন থাকা উচিত হয়নি।
এ রোগ দক্ষিণ এশিয়াজুড়ে ব্যাপ্ত ছিল, জানি না বাংলাদেশে এ রোগের প্রাদুর্ভাব কতটা। আর এ যেন একটা বিষচক্র। যারা র্যাগিংয়ের শিকার হয়, তারাই আবার লায়েক হয়ে উঠে অন্যদের মহাফুর্তিতে র্যাগিং করতে লেগে যায়, এমন ঘটনা দুর্লভ নয়। কে যে কখন আপেক্ষিক ক্ষমতা বা বীরত্বের আসনে চড়ে বসে, বলা মুশকিল। এ যেন সার্কাসের এক নাগরদোলা, এরা উপরে উঠছে তো ওরা নামছে, ওরা উঠছে তো এরা নামছে। আসলে যে কথাটা হয়তো এখনো স্পষ্ট করে বলা হয়নি, তা হলো, এসব সিনিয়র দাদা বা দিদি (হ্যাঁ, মেয়েদের হোস্টেলেও র্যাগিং হয় না তা নয়) মোটেই বীর নয়, আসলে তারা ‘কাপুরুষ’, জানি না মেয়েদের ক্ষেত্রেও কাপুরুষ কথাটা চলে কিনা। কারণ, এরা অপেক্ষাকৃত সবল অবস্থানে থেকে, তুলনায় দুর্বলদের ওপর অত্যাচার করে।
আর এ র্যাগিং শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ে হয় না। কখনো স্কুলে শিক্ষক/শিক্ষিকা তুলনায় অনেক দুর্বল ছাত্রছাত্রীর ওপর এক অর্থে র্যাগিং করেন, সমাজে সবল-দুর্বলের ওপর অত্যাচার করে। আমরা এদের কাপুরুষ ছাড়া আর কিছু ভাবি না। ইংরেজিতে একটা কথা আছে : Go, fight with one of your own size, ‘যাও, তোমার নিজের সাইজের কারও সঙ্গে লাগো গিয়ে।’ কিন্তু যারা এ সার্বিক সামাজিক র্যাগিংয়ে অংশ নেয়, তাদের ও কথা শুনতে বয়েই গেছে! তারা খোঁজে নিজের চেয়ে দুর্বল, প্রতিরোধ বা আত্মরক্ষায় অসমর্থ, সমর্থকহীন, অভিভাবকহীন দুর্বল প্রাণীদের। আধিপত্যের পরম্পরাতে তুমি কারও নিচে হলেই তুমি গেলে, প্রবলের অত্যাচারের হাত থেকে তোমার রেহাই নেই। শিক্ষক ও ছাত্র, পুলিশ ও গরিব অসহায় প্রজা, সরকারি কর্মচারী ও সেবাপ্রার্থী নিরীহ নাগরিক, ঊর্ধ্বতন ও নিুতন কর্মচারী, পুরুষ ও নারী, পুরোহিত ও যজমান, উঁচু জাত আর তথাকথিত নিচু জাত ও দলিত, চেয়ারের পিঠে তোয়ালেওয়ালা অফিসার আর তোয়ালেহীন কর্মী, কাউন্টারের ওপারে বসা লোক ও সেবাপ্রার্থী-কত যে এ সবল-দুর্বলের বিন্যাস আছে তার ইয়ত্তা নেই।
উপরে এক জায়গায় ‘প্রাণী’দের কথাটা অনবধানে লেখা নয়। বহুদিন আগে সেই মান্ধাতা আমলের হলিউডের অভিনেতা ড্যানি কেয়ির একটা ছবি দেখেছিলাম। ছবির নামটা ভুলে গেছি, ঘটনাটা মধ্যপ্রাচ্যের, মানে পশ্চিমাদের কল্পিত মধ্যপ্রাচ্যের, তাতে মধ্যপ্রাচ্যের এক সুলতান অন্তঃপুরে বেগমের কাছ থেকে চড় খেয়েছেন (ধরে নেওয়া যাক, বেগম নারী হলেও সেই সময়ে আধিপত্যের অবস্থানে ছিলেন)। তৎক্ষণাৎ তিনি দরবারে ছুটে এসে তার প্রধানমন্ত্রীকে চড় লাগালেন, প্রধানমন্ত্রী ফিরে চড় মারলেন পাশের সেনাপতিকে, সেনাপতি ছুটে গিয়ে চড় লাগালেন দরবারের দ্বাররক্ষীকে, দ্বাররক্ষী ছুটে বেরিয়ে গিয়ে ভেড়া নিয়ে যাচ্ছিল একটা লোক, তাকে চড় মারল, আর ভেড়াওয়ালা আর কী করে, সে ভেড়াটাকে চড় মেরে বৃত্তটা শেষ করল।
এ আপাত লঘু আখ্যানটা এ প্রবল কষ্টের বৃত্তান্তে হাস্যবিরাম আনার জন্য বলিনি। বলেছি সমাজে নানা ধরনের র্যাগিং যে সর্বত্রই চলে এ মর্মান্তিক কথাটা আমাদের মনে গেঁথে দেওয়ার জন্য। আবার বলি, এ কথাটাও অপরাধীদের পক্ষ নিয়ে বলার জন্য উচ্চারিত নয়। কথাটা উচ্চারণ করা এজন্য যে, দুর্বলের ওপর সবলের এ অত্যাচার আমাদের চোখে পড়ুক, সর্বত্র বন্ধ হোক, অত্যাচারীরা শাস্তি পেয়ে নিজেদের শিক্ষা নিক, দুর্বল যারা তাদের জীবন নিরাপদ হোক।
সাবেক বা থার্ড ইয়ারের বা ‘সিনিয়র’ দাদা বা দিদিরা ওই সবলের অবস্থানের সুযোগ নেয়, কারণ তারা নিজেরা কাপুরুষ। তারা নতুন ফার্স্ট ইয়ারের, বিশেষত গ্রাম থেকে আসা ছাত্রছাত্রীদের ওপর এ অত্যাচার চালায়। নাগরিক ছেলেমেয়েরাও আছে শক্তির অবস্থানে, তাদের তুলনায় গ্রামের ছেলেমেয়েরা দুর্বল। বড়লোক গরিবের শক্তির আপেক্ষিকতা তো আছেই।
এ কাপুরুষতা বন্ধ হোক। রাষ্ট্র এগিয়ে আসুক, প্রতিষ্ঠান এগিয়ে আসুক, সমাজ এগিয়ে আসুক, শুভবুদ্ধির মানুষেরা এগিয়ে আসুক। ভবিষ্যতে আর কোনো স্বপ্নদীপের এ পরিণতি যেন না ঘটে।
পবিত্র সরকার : খ্যাতনামা ভারতীয় লেখক; সাবেক উপাচার্য, রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা