নীতি দুর্নীতি অর্থনীতি
বাজারে কি আসলেই ‘ক্যাশ’ বেশি?
ড. আর এম দেবনাথ
প্রকাশ: ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
খবরের শিরোনাম : ‘নিত্যপণ্যের চড়া দামে কষ্টে মানুষ, মজুরি বৃদ্ধির চেয়ে মূল্যস্ফীতির হার বেশি, বছরে গড় মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ২০ শতাংশ’। বড় শিরোনাম, কিন্তু এতে ইস্যু তিনটি : পণ্যের দাম চড়া, মূল্যস্ফীতির হার বেশি এবং মজুরি বৃদ্ধির হার কম। এ কারণে যে মানুষের কষ্ট হবে, তা বলাই বাহুল্য।
আমি সে আলোচনায় যাচ্ছি না। আমার জানার ইচ্ছা, পণ্যের দাম বৃদ্ধি পেলে ‘ক্যাশের’ প্রয়োজন কত বাড়ে? দৈনন্দিন খরচ যেমন-কাঁচাবাজার, মাছ-মাংস, পরিবহণ-যাতায়াত, বাড়িভাড়া, স্কুল খরচ, হাতখরচ ইত্যাদির জন্য মানুষের হাতে কিছু ‘ক্যাশ’ সব সময়ই থাকে। এর একটা হিসাব কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে আছে। একে তারা বলে ‘ক্যাশ আউটসাইড ব্যাংকস’ (সিওবি)। কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রতি মাসেই এ হিসাব করে। এটা মানি সাপ্লাইয়ের (মুদ্রা সরবরাহ) একটি অংশ।
বাকি দুটি অংশ হচ্ছে : তলবি আমানত এবং মেয়াদি আমানত। তিনটি মিলেই ‘ন্যারো মানি’ বা ‘ব্রডমানি’ হয়। এই মানি কতটুকু বাড়বে তার একটা প্রক্ষেপণ কেন্দ্রীয় ব্যাংক করে। বলা হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক মূল্যস্ফীতির হার, জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার, এবং ‘মানিটাইজেশনে’র হার যোগ করে মুদ্রা সরবরাহের টার্গেট করে। এখন প্রশ্ন, ওই মুদ্রা সরবরাহের কতটুকু হবে ‘ক্যাশ’ বা ‘ক্যাশ আউটসাইড ব্যাংকস’? এর হিসাবও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিশ্চয়ই আছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য তা কত, আমি তা জানি না।
কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার ইতোমধ্যেই বলে দিয়েছেন, মানুষের হাতে ‘ক্যাশ’ বেশি হয়ে গেছে। সাম্প্রতিককালে নাকি এটি ২-৩ শতাংশ বেড়ে গেছে। তিনি এতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বলে কাগজে দেখলাম। তিনি ব্যাংকের ওপর মানুষের আস্থা কমেছে বলেও ইঙ্গিত করেছেন। ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের সঙ্গে এক বৈঠকে (১৬.০৮.২৩) তিনি তাদের আস্থা নষ্টের কারণ খুঁজে বের করতে বলেছেন। এবং মানুষের আস্থা অর্জন করে ‘ক্যাশ’কে আমানতে রূপান্তরিত করার নির্দেশ দিয়েছেন। প্রসঙ্গত, রিপোর্টে দেখলাম, গত মার্চ মাসে ‘ক্যাশ আউটসাইড ব্যাংকস’ ছিল ২ লাখ ৫৪ হাজার ৬৬৮ কোটি টাকা। এপ্রিলে তা বেড়ে হয়েছে ২ লাখ ৬৩ হাজার ৩৭৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ বৃদ্ধির পরিমাণ মাত্র ৮ হাজার ৭০৫ কোটি টাকা। কী কারণে এই বৃদ্ধি?
এখন মুশকিল হচ্ছে, গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের বক্তব্যের সুর ধরে মিডিয়ার একাংশ নানা স্টোরি ছেপে যাচ্ছে। তারা বলছে, অতিরিক্ত ক্যাশে বাজার সয়লাব। এতে আছে ঘুস-দুর্নীতির টাকা, হুন্ডির টাকা ইত্যাদি অবৈধ টাকা, যা আমাদের সর্বনাশ ডেকে আনছে। নির্বাচনের বছর, তার ওপর ‘ক্যাশের’ উল্লম্ফন স্বাভাবিকভাবেই নানা প্রশ্নের জন্ম দেয়। আবার প্রশ্নও থাকে যে, বাজারে আদৌ কি ‘ক্যাশের’ পরিমাণ বেশি? মূল্যস্ফীতির নিরিখে, টাকার অবমূল্যায়নের প্রেক্ষিতে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাসের প্রেক্ষাপটে কি বাজারে ‘ক্যাশ’ বেশি হচ্ছে? মানুষ বেশি বেশি ‘ক্যাশ’ রাখতে বাধ্য হচ্ছে? এক টাকার পণ্য দেড় টাকা-দুই টাকায় কিনতে গিয়ে কি বাজারে ‘ক্যাশের’ পরিমাণ বাড়ছে?
ব্যবসায়ীরা কি আগের মতো দিনের ‘ক্যাশ’ দিনে ব্যাংকে জমা দিতে পারছেন না নিজেদের চাহিদা মেটাতে গিয়ে? সরকারি ‘ক্যাশ’ খরচ কি বেড়ে গেছে? এ এক গোলকধাঁধা। মুশকিল হচ্ছে, যারা এর উত্তর দেবে তারাই বলে দিচ্ছে বাজারে ‘ক্যাশ’ বেশি। এর সূত্র ধরে কেউ কেউ বলতে চেষ্টা করছেন, মানুষ বস্তায় ভরে, বালিশের নিচে ‘ক্যাশ’ রাখছে। মারাত্মক সব অভিযোগ। এর উত্তর এমনিতে দেওয়া মুশকিল। গবেষকরা তথ্য-উপাত্ত জোগাড় করে বছরওয়ারি, জিডিপি বৃদ্ধিওয়ারি, মূল্যস্ফীতিওয়ারি একটা নির্ভরযোগ্য অবস্থা আমাদের জানাতে পারেন। ইতোমধ্যে খালি চোখে যা দেখা যাচ্ছে, তার ওপর সামান্য আলোকপাত করা যেতে পারে।
আমি আলোচনার জন্য একটি দৈনিক প্রকাশিত দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির একটা তালিকার আশ্রয় নিতে চাই। বলা বাহুল্য, এসব পরিসংখ্যান সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অফ বাংলাদেশ (টিসিবি) থেকে সংগৃহীত হয়েছে বলে জানানো হয়েছে। এক বছর আগে চিনির দাম ছিল কেজিপ্রতি ৮৮-৯০ টাকা, এখন ১৩০-১৩৫ টাকা। এক হালি ডিমের দাম এ সময়ে ৪০-৪২ টাকা থেকে বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ৪৮-৫২ টাকা। দেশি পেঁয়াজ কেজিতে ৪৫-৫০ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৮০-৯০ টাকা। আমদানিকৃত পেঁয়াজের দাম ৪০-৪৫ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৬৫-৭৫ টাকা। দেশি রসুনের দাম ৬০-৮০ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ২২০-২৬০ টাকা। আমদানিকৃত রসুনের দাম ১০০-১২০ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ২২০-২৫০ টাকা।
রুই মাছের কেজি ছিল ২৫০- ৩৫০ টাকা, এখন ৪৫০-৫৫০ টাকা। গরুর মাংসের দাম ছিল কেজিতে ৬৫০-৭০০ টাকা, এখন ৭৫০-৭৮০ টাকা। আলোচ্য কাগজে এ কয়েকটি পণ্যের দাম উল্লেখ করা হয়েছে। আর আমাদের রয়েছে ব্যক্তিগত জীবনের অভিজ্ঞতা। যেমন, যে রিকশাভাড়া ছিল ৪০ টাকা, তা এখন ৬০ টাকা। সব ধরনের মাছের দাম দেড়গুণ হয়েছে কম করে হলেও। যে ইলিশ গত বছর কেজিতে ১০০০-১২০০ টাকা ছিল, তার দাম এখন ১৫০০-১৮০০ টাকা। বিদেশি ফলের দামের কথা না বলাই ভালো। অথচ সবার না হোক, কিছু লোক বিদেশি ফল খায়, তাদের খেতে হয়। যেমন, কিডনির রোগী। তার আপেল খেতে হয়। এর দাম কত? একটা ছোট মিষ্টি আনারসের দাম ছিল ২০ টাকা, এখন ৪০ টাকা। এক লিটার দুধের দাম ছিল ৭০ টাকা, এখন ৯০ টাকা।
মুশকিল হচ্ছে, এ হিসাবের সঙ্গে মূল্যস্ফীতির হিসাব মিলবে না। মূল্যস্ফীতি বলা হচ্ছে ১০ শতাংশ। কিন্তু মধ্যবিত্তের, উচ্চবিত্তের বাজার খরচ অনেক বেশি। গরিবেরও তাই। হিসাবের ক্ষেত্রে দেখা যাবে, আগে মানুষের দৈনন্দিন খরচ যা ছিল, এক বছর পর মোট খরচ কমপক্ষে দেড়গুণ হয়েছে। রাস্তার পাশের দোকানে এক কাপ চায়ের দাম কত ছিল, একটা পরোটার দাম কত ছিল? এখন কত? এসব হিসাব দেওয়া আসলে আমার পক্ষে বোকামি। বোকামি হলেও কিছু পণ্য ও সেবার মূল্য তুলে ধরলাম একটা বিষয় বোঝার জন্য। দৈনন্দিন বাজার খরচ, কাঁচাবাজার, মাছ-মাংস, যাতায়াত ইত্যাদি খাতে যদি মধ্যবিত্তের খরচ ৫০ শতাংশ নয়, ২০ শতাংশও বাড়ে, তাহলে বাজারে ‘ক্যাশের’ চাহিদা কত হবে? নাকি তা ‘ক্রেডিট’, ‘ডেবিট’ কার্ডের মাধ্যমে হবে।
নাকি এসব হবে ‘ক্যাশলেস’ লেনদেন? এ জায়গাটাতেই বাংলাদেশ ব্যাংকের কাজ করতে হবে। যারা লেখক, গবেষক, তাদেরও এখানে কাজ করতে হবে। ‘ক্যাশের’ বিরাট অংশ চুরিচামারি, দুর্নীতি, ঘুস, হুন্ডির টাকা, অবৈধ টাকা-এ কথা ঢালাওভাবে বলে আতঙ্ক সৃষ্টি করা কতটুকু যুক্তিসংগত? যেমন, উদাহরণ দেই। ব্যাংক শাখায় সব দিন সমান ‘ক্যাশ’ জমা হয় না। আবার সমান ‘ক্যাশ’ তোলাও হয় না। দেশের একেক অঞ্চলে লেনদেনের, ক্যাশ লেনদেনের বৈশিষ্ট্য একেক রকম। ডিসেম্বরের দিকে একেক প্রান্তিকে ব্যাংকে টাকা জমা হয়। আবার পরের মাসেই তা বাজারে যায়।
অনেক ব্যবসায়ী কিস্তির টাকা, মাসিক/ত্রৈমাসিক কিস্তির টাকা যখন জমা দেয়, তখন বাজারে ‘ক্যাশ’ কমে। আবার মুহূর্ত পরেই তা বেড়ে যায়। ‘ক্যাশ’ বাজারে বাড়ে-কমে তার নিজের প্রয়োজনে। একে বিচার করতে হবে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার, মূল্যস্ফীতির হার, মানিটাইজেশনের হারের সঙ্গে। ‘রিজার্ভ মানি’, ‘ব্রডমানি’, ‘ন্যারো মানি’র বিচারও এতে থাকবে। এসব দেখেশুনে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আমাদের পরিষ্কার করে বলুক প্রকৃত ঘটনা কী।
এদিকে দেখা যাচ্ছে, গভর্নর সাহেব ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের বলেছেন ব্যাংকের ওপর আস্থা বৃদ্ধির চেষ্টা করতে, আমানত বৃদ্ধি করতে। এখানে সবিনয়ে একটা প্রশ্ন করতে চাই। ব্যাংক খাতের ওপর আস্থা বৃদ্ধির কাজ ব্যাংকগুলো কতটুকু করবে, আর কতটুকু করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক? ঘনঘন খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা পরিবর্তন, আমানতের সুদের হার ধরে রাখা, ব্যাংকের পরিচালকদের মেয়াদ দফায় দফায় বৃদ্ধি করা, এক পরিবার থেকে পরিচালকের সংখ্যা চোরাগোপ্তাভাবে বৃদ্ধি করা, গ্রুপের কোম্পানির মধ্যে একটি খেলাপি হলে অন্যটি ঋণ পাবে না-এই নিয়ম রহিত করা, ঋণ কিছু বিজনেস হাউজ, কিছু গ্রাহকের হাতে কেন্দ্রীভূত হওয়া, খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নেওয়া-এসবের জন্য ব্যাংকগুলো কতটুকু দায়ী?
অথচ এসব কারণেই ব্যাংকের ওপর মানুষের আস্থা কমছে। গভর্নর সাহেবসহ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঊর্র্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বলব পরিচয় না দিয়ে বাজারে মানুষের সঙ্গে কথা বলতে। বুঝতে পারবেন কেন মানুষের আস্থার অভাব ঘটছে। ব্যাংকগুলোর মালিকানা, বড় ব্যবসার মালিকানা, রাজনীতি এক হয়ে আজকের পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। ব্যাংক খাতে পুরোপুরি কাঁচাবাজারের অবস্থা।
এসব কথার পর দুটি কথা বলতেই হয়। বলতে হয় মানুষের হাতে টাকা নেই, ক্যাশ নেই। মানুষ কষ্টে আছে। ব্যাংকে টাকা রাখার মতো টাকা কয়জনের আছে এখন? দৈনন্দিন খরচ চালাতে গিয়েই মানুষ হিমশিম খাচ্ছে। টাকা ব্যাংকে রাখবে কোত্থেকে? এরপরও যাদের কিছু ‘ক্যাশ’ আছে, তারা কেন ব্যাংকে টাকা রাখবে? ব্যাংকে টাকা রাখলেই লোকসান। সুদের হার মূল্যস্ফীতির হারের চেয়ে কম। তারপর অগ্রিম কর কাটা, নানা ধরনের চার্জ আরোপ। এসব আমানত বৃদ্ধির পরিবেশ নয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজার অর্থনীতি থেকে দূরে সরে দাঁড়ানোর ফল নয় কি এসব? প্রভাবশালী গভর্নর সাহেব একটু ভাববেন কি?
ড. আর এ দেবনাথ : অর্থনীতি বিশ্লেষক; সাবেক শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়