Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

দেশে দেশে সর্বজনীন পেনশন

Icon

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী

প্রকাশ: ২৪ আগস্ট ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

দেশে দেশে সর্বজনীন পেনশন

দেশের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের ভবিষ্যৎ জীবনপ্রবাহ বিবেচনা করে বহুল আলোচিত-প্রতীক্ষিত সর্বজনীন পেনশন স্কিমের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে সামাজিক সুরক্ষার এক নতুন অধ্যায় রচিত হয়েছে। বেসরকারি খাতে কর্মরত জনগোষ্ঠী, প্রবাসী বাংলাদেশি, অনানুষ্ঠানিক খাত এবং নিুআয়ের মানুষের জন্য যথাক্রমে প্রগতি, প্রবাসী, সুরক্ষা ও সমতা নামে চারটি কর্মসূচির মাধ্যমে দেশের বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠীকে পেনশন সুবিধার আওতায় আনা হয়েছে। সরকারের এ উদ্যোগ অত্যন্ত প্রশংসনীয়। গত ১৭ আগস্ট মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচির উদ্বোধন করে বলেছেন, ‘এদেশের প্রতিটি মানুষের জীবনকে অর্থবহ করে তাদের জীবনমান উন্নত করতে চাই। শোকের মাসেই আমরা এই পেনশন স্কিম উদ্বোধন করছি। কারণ, আমার পিতা হয়তো দেখবেন। তিনি খুশি হবেন। তার প্রিয় দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য আমরা সর্বজনীন পেনশন চালু করছি। পেনশন স্কিম চালুর ফলে কাউকে আর ভাতার ওপর নির্ভরশীল হতে হবে না। এতে তাদের অর্থনৈতিক সুরক্ষা থাকবে। কারও কাছে হাত পাততে হবে না।’ তিনি আরও বলেন, ‘জাতির পিতার হত্যার পর দেশের অবস্থা এমন করা হয়েছে, না ছিল ভোটের অধিকার, না ছিল ভাতের অধিকার। আমরা সে অবস্থার পরিবর্তন করতে চেয়েছি। সে লক্ষ্যে কাজ করছি। মনে রাখতে হবে, জাতির পিতা যে স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন, সেটা যাতে ব্যর্থতায় পর্যবসিত না হয়। বাংলাদেশের ওপর দিয়ে অনেক ঝড় বয়ে গেছে। একদিকে করোনা, অন্যদিকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। এরই মধ্যে মিলিটারি ডিক্টেটরদের হাতে গড়া দলের ধ্বংসযজ্ঞ। এসব মোকাবিলা করে দেশকে এগিয়ে নিচ্ছি। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, দারিদ্র্য ও অতিদারিদ্র্য দূরীকরণ, সামাজিক নিরাপত্তাসহ সব খাতে সেবা দিচ্ছি।’

অর্থ বিভাগের বিধিমালা অনুযায়ী, ১৮ বছরের বা তদূর্ধ্ব বয়স থেকে ৫০ বছর বয়সি জাতীয় পরিচয়পত্রধারী সব বাংলাদেশি নাগরিক সর্বজনীন পেনশন স্কিমে অংশ নিতে পারবেন। পেনশন কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হলে একজন চাঁদাদাতা ৬০ বছর বয়সের পর থেকে আজীবন পেনশন সুবিধা পাবেন। কিন্তু চাঁদাদাতা মারা গেলে তার নমিনি বা উত্তরাধিকারী পেনশন পাবেন চাঁদাদাতার ৭৫ বছর বয়স পর্যন্ত।

৫০ বছরের অধিক বয়সের নাগরিকরাও স্কিমে অংশগ্রহণ করতে পারবেন। সেক্ষেত্রে স্কিমে অংশ নেওয়ার তারিখ থেকে ১০ বছর চাঁদা প্রদান শেষে তিনি যে বয়সে উপনীত হবেন, সেই বয়স থেকে আজীবন পেনশন প্রাপ্য হবেন। প্রবাসী বাংলাদেশি নাগরিকরা, যাদের জাতীয় পরিচয়পত্র নেই, তারা পাসপোর্ট দিয়ে নিবন্ধন করতে পারবেন। তবে স্বল্প সময়ের মধ্যে জাতীয় পরিচয়পত্র গ্রহণ করে এর অনুলিপি কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দিতে হবে। বর্তমানে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় থাকা ব্যক্তিরা স্কিমে অংশগ্রহণ করার আগে সংশ্লিষ্ট সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির সুবিধা সমর্পণ করে তাদের জন্য প্রযোজ্য স্কিমে অংশ নিতে পারবে। দেশে ও প্রবাসে অবস্থানরত বাংলাদেশি নাগরিকদের নির্ধারিত ফরম অনলাইনে পূরণ করে আবেদনসাপেক্ষে একটি ইউনিক আইডি নম্বর প্রদান করা হবে। মোবাইল ব্যাংকিং, অনলাইন ব্যাংকিং বা ডেবিট-ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে পেনশনের চাঁদা পরিশোধের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। গত ২০ আগস্ট গণমাধ্যমে প্রকাশিত পরিসংখ্যান অনুসারে, সর্বজনীন পেনশন স্কিম চালুর প্রথম তিন দিনে প্রায় ৪০ হাজার আবেদনকারী অনলাইনের মাধ্যমে নিবন্ধন এবং তাদের মধ্যে প্রায় সাড়ে চার হাজার আবেদনকারী চাঁদা পরিশোধ করে আবেদনের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছেন।

সরকারের সর্বজনীন পেনশন অর্থনীতিতে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করবে বলে মনে করছেন দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ীরা। তাদের মতে, এটি বর্তমান সরকারের একটি জনবান্ধব উদ্যোগ, যা দেশের অর্থনীতিতে অর্থপ্রবাহ বৃদ্ধি এবং নিুআয়ের মানুষের সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিতের পাশাপাশি দারিদ্র্য বিমোচনে সহায়তা করবে। দেশবরেণ্য অর্থনীতিবিদরা এ উদ্যোগকে স্বাগত জানালেও এর সঠিক ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করার বিষয়েও তাগিদ দিয়েছেন। ব্যবস্থাপনাগত বিচ্যুতির কারণে এমন একটি উদ্যোগের বিষয়ে জনগণের আস্থায় যাতে কোনো ঘাটতি তৈরি না হয়, তারা সেদিকে গুরুত্ব দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। প্রসঙ্গত, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ গণমাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘এই তহবিলটা হচ্ছে জনগণের সঞ্চয়। এটা স্বাধীনভাবে পরিচালনা করতে হবে। যে উদ্দেশ্য নিয়ে ফান্ডটা তৈরি করা হচ্ছে, সেটাই যেন মুখ্য থাকে। সেখান থেকে সরে আসা যাবে না। সর্বজনীন পেনশনের মাধ্যমে একটি বড় তহবিল হবে। এর সফলতা নির্ভর করছে সরকার কীভাবে এ তহবিল ব্যবস্থাপনা করবে তার ওপর। সঠিক খাতে বিনিয়োগ করতে না পারলে ঝুঁকি থাকবে। বিশেষ করে কোথায়, কীভাবে বিনিয়োগ করা হবে, তাতে কতটা রিটার্ন পাওয়া যাবে, এসবের ওপর তহবিলের সাফল্য নির্ভর করবে। বিশ্বের অনেক দেশে এ রকম উদ্যোগ নেওয়ার পর দেখা গেছে ভালো ব্যবস্থাপনা না থাকায় তা সফল হতে পারেনি। আবার যারা ভালো ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করেছে, তাদের ফলাফলও ভালো হয়েছে। এমন নজির অনেক রয়েছে।’

বিশ্বের অনেক দেশেই সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালু আছে। বর্তমানে সর্বোত্তম পেনশন ব্যবস্থা রয়েছে আইসল্যান্ডে। এছাড়া ভালো করছে নেদারল্যান্ডস, ডেনমার্ক, ইসরাইল, অস্ট্রেলিয়া, নরওয়ে, নিউজিল্যান্ড, ফিনল্যান্ড, কানাডা, জার্মানি, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, সিঙ্গাপুর ইত্যাদি দেশ। সুদক্ষ ব্যবস্থাপনা, সুশাসন, বয়স্ক সব জনগোষ্ঠীকে পর্যাপ্ত অবসর সুবিধার আওতায় আনা এবং রাষ্ট্রীয় উদার আর্থিক সমর্থন নিশ্চিতের কারণেই দেশগুলো বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হচ্ছে। বিশ্বে সাধারণত আনফান্ডেড, ফান্ডেড, ডিফাইন্ড বেনিফিট্স (ডিবি), ডিফাইন্ড কন্ট্রিবিউশন্স (ডিসি)-এ চার ধরনের পেনশন পদ্ধতি চালু আছে। আনফান্ডেড পেনশনে কোনো কর্মীকে চাঁদা দিতে হয় না বলে এর জন্য কোনো তহবিলও সৃষ্টি হয় না। ফান্ডেড পেনশনে কর্মী বা প্রতিষ্ঠান বা উভয়কেই চাঁদা দিতে হয়। ডিবি পদ্ধতি সরকারি কর্মচারীদের জন্য। ডিসি পদ্ধতিতে কর্মী বা প্রতিষ্ঠান থেকে একটি তহবিলে অর্থ জমা এবং সেখান থেকেই ব্যয় নির্বাহ করা হয়। কোনো কোনো দেশে বিমা কোম্পানির মাধ্যমেও পেনশন ব্যবস্থা চালু আছে।

বাংলাদেশের নিকটতম প্রতিবেশী দেশ ভারতে ২০০৪ সালের ১ জানুয়ারি থেকে জাতীয় পেনশন ব্যবস্থা (এনপিএস) চালু করা হয়, যেটি সর্বপ্রথম সামরিক বিভাগ ছাড়া শুধু কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মচারীদের জন্য প্রযোজ্য ছিল। ২০০৯ সালের ১ মে দেশের ভেতরে ও বাইরে থাকা ১৮ থেকে ৬০ বছর বয়সি সব নাগরিকের জন্য পেনশন ব্যবস্থা উন্মুক্ত করা হয়। ২০১১ সালের ডিসেম্বরে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি করপোরেট প্রতিষ্ঠানের কর্মীদেরও পেনশন সুবিধায় অংশগ্রহণের ব্যবস্থা রাখা হয়। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের কর্মজীবী এবং নিুআয়ের নাগরিকদের জন্য ২০১১-১২ অর্থবছর থেকে একটি এবং ২০১৫-১৬ অর্থবছর থেকে আরেকটি বিশেষ প্রকল্প নেওয়া হয়। এছাড়া দেশটিতে বয়স্ক, প্রতিবন্ধী ও বিধবাদের জন্য সামাজিক পেনশন ব্যবস্থাও চালু রয়েছে। তবে এক্ষেত্রে এশিয়ায় তুলনামূলকভাবে বেশ এগিয়ে রয়েছে চীন। মোট জনসংখ্যার ৭০ শতাংশ কর্মক্ষম দেশটির শহরে কর্মরতদের জন্য আরবান পেনশন সিস্টেম (ইউপিএস), সরকারি-আধাসরকারি চাকরিজীবীদের জন্য সিভিল ও পাবলিক সার্ভিস পেনশন সিস্টেম (সিপিএসপিএস) এবং গ্রামে বেসরকারি চাকরিতে নিয়োজিতদের জন্য রুরাল পেনশন সিস্টেম (আরপিএস) বিদ্যমান রয়েছে।

পক্ষান্তরে যুক্তরাজ্যে রাষ্ট্রীয়, পেশাগত, ব্যক্তিগত ও আনফান্ডেড-এ চার ধরনের পেনশন ব্যবস্থা চালু রয়েছে। রাষ্ট্রীয় পেনশনেও রয়েছে রাষ্ট্রীয় অবসরভাতা, সম্পূরক পেনশন ও পেনশন ক্রেডিট নামক তিনটি অংশ। রাষ্ট্রীয় অবসরভাতার আওতায় যাদের বার্ষিক আয় ৯ হাজার ৫০০ পাউন্ডের বেশি, তাদের বাধ্যতামূলক চাঁদা দিতে হয় জাতীয় বিমায়। যাদের আয় রাষ্ট্র নির্ধারিত নিুআয়সীমার নিচে, তাদের দেওয়া হয় ঐচ্ছিক সম্পূরক পেনশন। পেনশন ক্রেডিট হচ্ছে স্বল্প-আয়ের ৬০ বছরের বেশি বয়সিদের জন্য। পেশাগত পেনশন হচ্ছে কর্মীর বেতন থেকে ৩ শতাংশ এবং সরকার বা কোম্পানি থেকে ৫ শতাংশ জমা হওয়ার পদ্ধতি। এটি বিনিয়োগ করে মুনাফার টাকাসহ পেনশন দেওয়া হয়। এ ছাড়া আনফান্ডেড পদ্ধতিতে পেনশন দেওয়া হয় সামরিক, সরকারি কর্মচারী ও শিক্ষকদের। আর ব্যক্তিগত পেনশন হচ্ছে বিমা কোম্পানির মাধ্যমে পরিচালিত একটি গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি।

যুক্তরাষ্ট্রে রয়েছে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় সামাজিক নিরাপত্তা, চাকরিভিত্তিক, আনফান্ডেড ও ব্যক্তিগত পেনশন। রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় সামাজিক নিরাপত্তা পদ্ধতির আওতায় রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ৯৪ শতাংশ কর্মক্ষম লোক। গ্রাহকের কর ও ট্রাস্ট ফান্ডে জমা হওয়া অর্থ বিনিয়োগের মুনাফা থেকে এ পেনশন দেওয়া হয়। এ পদ্ধতিতে বছরে চারবার ১ হাজার ৪১০ ডলার করে জমা অর্থাৎ ১০ বছরে ৫৬ হাজার ৬০০ ডলার জমা হলেই পেনশনের প্রাথমিক যোগ্যতা অর্জন করা যায়। চাকরিভিত্তিক পেনশনের আওতায় কর্মী যা দেয়, তার সমপরিমাণ অর্থ দেয় সরকার বা কোম্পানি। ওই দেশের আনফান্ডেড পদ্ধতি ও ব্যক্তিগত পেনশন ব্যবস্থা যুক্তরাজ্যের মতোই পরিচালিত হয়।

বিজ্ঞজনদের মতে, সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী এ বিশাল জনগোষ্ঠীর মাঝে ব্যাপক সাড়া জাগানিয়া এ সর্বজনীন পেনশন সুবিধার কার্যকর বাস্তবায়ন সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হতে পারে। এসব চ্যালেঞ্জ উত্তরণে প্রয়োজন সমন্বিত ও প্রায়োগিক কর্মকৌশল। সামাজিক নিরাপত্তা খাতগুলো নানামুখী প্রণোদনায় ইতোমধ্যে ব্যাপক সমাদৃত হয়েছে। উন্নয়ন অভিযাত্রায় বাংলাদেশের অবস্থান অধিকতর মর্যাদাসম্পন্ন হোক। কালক্রমে দেশ এ ধরনের সামাজিক খাতগুলোর দ্বারা তার অগ্রগতির যাত্রাপথকে সমুন্নত রাখবে-এ প্রত্যাশা ব্যক্ত করছি।

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী : শিক্ষাবিদ; সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম