Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

শতফুল ফুটতে দাও

উন্নয়ন প্রকল্পে গুণগত মানের বিকল্প নেই

Icon

ড. মাহবুব উল্লাহ্

প্রকাশ: ২৪ আগস্ট ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

উন্নয়ন প্রকল্পে গুণগত মানের বিকল্প নেই

অর্থনীতিশাস্ত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসাবে দাঁড়িয়ে যায় দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শেষে, যা উন্নয়ন অর্থনীতি হিসাবে পরিচিতি পায়। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর অনেক দেশ জাতীয় স্বাধীনতা অর্জন করে। ঔপনিবেশিক প্রভুরা এসব দেশ পরিচালনার দায়িত্ব দিয়ে গেল দেশীয় শাসকগোষ্ঠীগুলোকে। স্বাধীনতা অর্জনের জন্য এসব দেশের জনগণকে অনেক লড়াই সংগ্রাম করতে হয়েছে। স্বাধীনতা অর্জনের পর ভিন্ন ধরনের সংগ্রামের সূচনা হয়। এ সংগ্রাম পরিচালিত হয় ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে। ঔপনিবেশিক শাসনের জোয়াল ছুড়ে ফেলার পর এসব দেশের জনগণ উন্নততর জীবনের স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। এ স্বপ্ন বিপ্লবের চেয়ে কম কিছু নয়। একেই বলা হয় Revolution of rising expectation. দেশের জনগণের এ আকাঙ্ক্ষা পূরণে উপনিবেশ-উত্তর রাজনৈতিক নেতৃত্বকে বিরাট চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়। উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বাস্তবায়নের জন্য অর্থের সংস্থান, সর্বাধিক কল্যাণমুখী হবে এমন প্রকল্প গ্রহণ, উন্নয়ন প্রয়াসের ফলে আয় বৈষম্য যাতে বৃদ্ধি না পায় এবং উন্নয়ন প্রকল্পের ফলে কর্মসংস্থান যাতে কাঙ্ক্ষিত পরিমাণে বৃদ্ধি পায়, এর সবকিছু নিশ্চিত করা হয়ে ওঠে উন্নয়নের চ্যালেঞ্জ। স্পষ্টতই দেখা যাচ্ছে, উন্নয়ন প্রকল্পের ফলে অর্থনীতিতে যোগ হয় নানা ধরনের অবকাঠামো। সাদামাটাভাবে আমরা বুঝি, উন্নয়ন মানে নতুন নতুন সড়ক, সেতু, যাতায়াত ও যোগাযোগের জন্য প্রয়োজনীয় যানবাহন, স্কুল-কলেজসহ নানা ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্মাণ, হাসপাতাল নির্মাণ, নিরাপদ পানীয় জলের সংস্থান, জনস্বাস্থ্যের উন্নয়ন-এসব কিছু গড়ে ওঠে উন্নয়ন উদ্যোগের ফলে। বলা যায়, এগুলো হলো উন্নয়নের বৈশ্বিক রূপ।

তবে উন্নয়নের গুণগত দিকগুলো কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। উন্নয়ন প্রকল্পের ফলে যেসব স্থাপনা নির্মাণ করা হয়, সেগুলো টেকসই কিনা, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য উপযোগী কিনা, প্রকল্প থেকে কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় উপযোগ সৃষ্টি হচ্ছে কিনা, আঞ্চলিক বৈষম্য নিরসন করা যাচ্ছে কিনা, দারিদ্র্য বিদূরিত হচ্ছে কিনা, জনগণের চিন্তা চেতনা কুসংস্কারমুক্ত হচ্ছে কিনা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের মান বৃদ্ধি পাচ্ছে কিনা এসব কিছু উন্নয়নের গুণগত দিক। গুণগত দিকগুলো সঠিক মাত্রায় বিবেচনায় না নিয়ে যে উন্নয়ন হয় তাকে প্রকৃত উন্নয়ন বলা যায় না। উন্নয়নের একটি দুষ্ট ক্ষত হচ্ছে দুর্নীতি। উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে দুর্নীতি হলে উন্নয়নজনিত স্থাপনার আয়ু সংক্ষিপ্ত হয়ে যায়। প্রতিবছর এসব প্রকল্পের কোনো না কোনো সমস্যা দেখা দেয়, সেগুলো সারিয়ে ওঠার জন্য অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করতে হয়। বাংলাদেশে প্রতিবছর যেসব স্থাপনা নির্মিত হয়, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে যেগুলোর সঠিকভাবে পরিবীক্ষণ হয় না, সেগুলো অল্প সময়ের মধ্যে ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে ওঠে।

১৮ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প পানিতে ডুবল কেন, এমন প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছে একটি জাতীয় দৈনিক। পর্যটন শহর কক্সবাজার পর্যন্ত নির্মাণাধীন রেলপথে ইস্পাতের তৈরি রেলগুলো দুমড়ে-মুচড়ে যাওয়ার পর নানা আলোচনা- সমালোচনা চলছে। সাম্প্রতিককালে প্রবল বৃষ্টিপাতের ফলে যে পাহাড়ি ঢল নামে, সেই ঢলের তোড়ে নবনির্মিত রেল লাইন কোথাও দেবে গেছে, আবার কোথাও উপরের দিকে বাঁকা হয়ে উঠেছে। অনেকেই ভেবেছিলেন রেলে কক্সবাজারে ভ্রমণ করতে যাবেন। নতুন রেললাইনের ভগ্নদশা দেখে অনেকেই হতাশ হয়েছেন। প্রশ্ন উঠেছে, হাজার হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগের এ মেগা প্রকল্প কতটা জলবায়ুর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং কতটা টেকসই ও পরিকল্পিত?

আগস্ট মাসের শুরুতে চট্টগ্রাম অঞ্চলে রেকর্ড বৃষ্টিপাতের কারণে পাহাড়ি ঢলে নবনির্মিত রেল লাইনটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই রেললাইনের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে সাতকানিয়ার তেমোহনী এলাকায় আধা কিলোমিটারজুড়ে। ক্ষতিগ্রস্ত অংশে রেললাইন উঁচু-নিচু হয়ে আছে। স্লিপারের তলার পাথর সরে গিয়ে সৃষ্টি হয়েছে বড় বড় গর্ত। রেললাইনের ক্ষতিগ্রস্ত অংশের একটি ছবি ছাপা হয়েছে দৈনিক প্রথম আলোতে। এতে দেখা যায়, রেললাইনগুলো দুমড়ে-মুচড়ে গেছে। যথাযথভাবে সংস্কার করা না হলে এ রেললাইন ব্যবহার করা সম্ভব হবে না।

প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা ক্ষতির পরিমাণ নগণ্য বলে মন্তব্য করেছেন। তাদের এ মন্তব্য দেখে রবীন্দ্রনাথের ‘সামান্য ক্ষতি’ কবিতাটির কথা মনে পড়ল। বলা হচ্ছে, রেলপথের এই ক্ষতি মেরামতে দুসপ্তাহ কাজ করতে হবে। প্রকল্প পরিচালক দাবি করেছেন, পরিকল্পনা অনুযায়ী অক্টোবর মাসেই এর উদ্বোধন এবং ট্রেন চলাচল শুরু করা হবে।

‘যে ক্ষতি হয়েছে এটা যদি আমাদের চালু কোনো রেললাইন হতো, তাহলে আমরা একদিনে ঠিক করে ফেলতে পারতাম। আমার যে ক্ষতিটা হয়েছে এ ক্ষতির পরিমাণ তো খুব বেশি না। নগণ্য এ ক্ষতির পরিমাণ।’ ‘আমার পুরো প্রজেক্টের যে ব্যয়, ওই তুলনায় ক্ষতি তো এক দেড় কোটি টাকা। এটা সামান্য। একটা নরমাল মেইনটেনেন্সে আমাদের এটা লাগে। এ ধরনের ক্ষতি আমাদের যেগুলো চলমান রেলওয়ে আছে এগুলোতেও বন্যা হলে হয়।’ বললেন প্রকল্প পরিচালক।

রেললাইনের ক্ষতিকে সামান্য দাবি করা হলেও এটাকে মোটেও সামান্য বলে ভাবতে চান না বিশেষজ্ঞরা। এবারের অভিজ্ঞতা থেকে ক্ষতিগ্রস্ত রেললাইনটির সংস্কার অথবা মেরামতের স্থায়ী সমাধানে পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। ড. আইনুন নিশাত বলেন, ‘যেটা ঘটে গেছে সেটা কেন ঘটেছে সেটার হিসাব-নিকাশ করা হোক। একটা জাতীয় কমিটি হওয়া উচিত।’ ‘আমাদের দেশের কালচার হচ্ছে ভেঙেছে, ওইটাকেই আবার পুনর্নির্মাণ করা। কেন ভেঙেছে এই কারণটা খুঁজে বের করে ভবিষ্যতে যাতে এই ভুলের মধ্যে না পড়ি সেটা ঠিক করতে হবে।’ কীভাবে সমস্যার সমাধান হবে এ প্রশ্নে প্রকল্প পরিচালক বলেন, ‘সমাধান তো অনেকই আছে। কিন্তু এর আগে তো এখানে এ রকম বৃষ্টিপাত হয়নি। বিশেষজ্ঞরা যে মতামত দেয় সে মতামত আমরা সাদরে গ্রহণ করি।’

চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত নির্মাণাধীন রেললাইনের দৈর্ঘ্য ১০২ কিলোমিটার। এ প্রকল্পে ব্যয় হচ্ছে ১৮ হাজার কোটি টাকারও বেশি। এই অবকাঠামোটি সরকারের প্রাধিকারপ্রাপ্ত প্রকল্প। আগামী অক্টোবর মাসে উদ্বোধনের পর রেল চলাচল শুরু করার কথা আছে। রেললাইনটি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় পূর্বনির্ধারিত সময়ে এটি উদ্বোধন হবে কিনা তা নিয়ে সংশয় আছে।

যে কোনো উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণের আগে প্রকল্প এলাকায় বসবাসরত জনগণের কাছ থেকে প্রকল্প সম্পর্কিত তথ্য গ্রহণ করতে হয়। এলাকায় বসবাসরত বাসিন্দারা যে অভিজ্ঞতা তাদের জীবনে অর্জন করেছেন, সেই অভিজ্ঞতাগুলো প্রকল্পের জন্য ক্রিটিক্যাল ইনপুট হিসাবে বিবেচিত হতে পারে। সংবাদপত্রের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, স্থানীয় বাসিন্দারা মনে করেন, নতুন এই রেললাইনে যে বাঁধ দেওয়া হয়েছে তার ফলে পাহাড়ি ঢলের পানি সহজে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় ব্রিজ ও কালভার্ট নির্মাণ করা হয়নি। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তরা মনে করেন, আরও বেশি কালভার্ট রাখার প্রয়োজন ছিল। যেগুলো তৈরি হয়েছে সেগুলো আরও প্রশস্ত করে তৈরি করলে ক্ষয়ক্ষতি কম হতো। স্থানীয় একজন কৃষক রেললাইনের সঙ্গে সমান্তরাল সড়ক বিভাগের রাস্তা দেখিয়ে বলেন, একই দূরত্বে সড়কের চেয়ে রেললাইনে কম কালভার্ট দেওয়া হয়েছে। যেগুলো দেওয়া হয়েছে সেগুলো রাস্তাগুলোর চেয়ে কম প্রশস্ত। রাস্তার যে দূরত্বে চারটি বড় কালভার্ট দেখা যায়, সেখানে তার বিপরীতে একই দূরত্বে দুটি কালভার্ট চোখে পড়ে।

নাগরিক সমাজের নেতৃস্থানীয় একজন বলেছেন, প্রকল্পে ডিজাইনের সময় স্থানীয় জনসাধারণের মতামত নেওয়া খুবই জরুরি। স্থানীয়রা যারা বলেছেন, কালভার্ট কম হয়েছে, ওপেনিং কম হয়েছে, সেটি নিয়ে তাদের সঙ্গে বসা দরকার ছিল। এখানে জনগণের অংশগ্রহণ ছাড়া প্রজেক্ট ডিজাইন করা সম্ভব নয়। এদেশে জনগণের অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানকে বিবেচনায় নেওয়া হয় না বলে উন্নয়ন প্রকল্পগুলো ত্রুটিপূর্ণ হয়। যদি কোনো ইঞ্জিনিয়ার মনে করেন, সাধারণ মানুষ তো ইঞ্জিনিয়ারদের মতো বইপুস্তক পড়েননি, কিংবা অঙ্ক কষেননি, এ ধরনের মানুষের কাছে কি পরামর্শ আশা করা যায়! বাস্তবে দেখা যায়, জীবনের অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানের বিকল্প খুব সামান্যই আছে। খনার বচনে মানুষের অভিজ্ঞতারাশি ধারণ করা আছে। এ কারণে খনার বচন এত মূল্যবান।

প্রকল্প পরিচালক মফিজুর রহমান দাবি করেছেন, রেললাইনে ১০০ কিলোমিটারে ১৭৩টি কালভার্ট, ৩৮টি ব্রিজ তৈরি হয়েছে। ১০০ কিলোমিটার রেললাইনে সাড়ে ৪ কিলোমিটার জায়গা পানি নিষ্কাশনের জন্য ওপেন রাখা হয়েছে। রেললাইনের ক্ষতির কারণ হিসাবে রেকর্ড বৃষ্টি আর পাহাড়ি ঢলকেই দায়ী করেছেন প্রকল্প পরিচালক। বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেছেন, ‘দুদিনে ৮০০ মিলিমিটার বৃষ্টি তো আগে কখনো হয়নি। এখন যদি আমাদের ক্লাইমেটের অদ্ভুত আচরণের জন্য হয়, এ জিনিসগুলো তো আমাদের আগে জানা ছিল না। আরও দুটি কালভার্ট যদি থাকত, তাহলে কী বন্যা হতো না?’

মফিজুর রহমান সাহেব ভাবতে পারেননি ২ দিনে ৮০০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হতে পারে। তিনি কি জানেন না, এখন জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে মাত্রাহীনভাবে? জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বৃষ্টিপাত অথবা খরা অথবা দাবানল সাধারণ সময়ের তুলনায় প্রচণ্ডভাবে তীব্র হয়ে উঠছে। এর ফলে অতি অল্প সময়ের ব্যবধানে ক্ষয়ক্ষতি অনেক বেশি হচ্ছে। এছাড়া রেললাইনটি বাংলাদেশের যে এলাকায় নির্মাণ করা হয়েছে, সেখানকার ভূ-প্রকৃতি বাংলাদেশের অন্যান্য এলাকার চেয়ে দৃশ্যমানভাবে ভিন্ন প্রকৃতির। এই বৈশিষ্ট্য প্রকল্প প্রণয়নের সময় বিবেচনায় রাখা জরুরি ছিল।

রেল কর্তৃপক্ষ ক্ষতির জন্য কেবল অতিবৃষ্টিকে দায়ী করলেও বিশেষজ্ঞরা বলছেন ভিন্ন কথা। ড. আইনুন নিশাতের মতে, এ ধরনের বৃষ্টিপাত এখন আর অস্বাভাবিক নয়। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অল্প সময়ে অনেক বৃষ্টির ঘটনা বাড়বে। তিনি আরও বলেছেন, এই যে রেললাইনটা বানানো হয়েছে, যেটা উত্তর-দক্ষিণে প্রলম্বিত আর পানির ঢল নেমে পূর্ব থেকে পশ্চিম দিকে এসে সাগরের যাবে, এটা ডিজাইন করার সময় বিবেচনায় নেওয়া প্রয়োজন ছিল। ড. নিশাত মনে করেন, রেললাইন প্রকল্প পরিকল্পনার সময় জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি মাথায় রাখা হয়নি।

ড. মাহবুব উল্লাহ : শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম