Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

নীতি দুর্নীতি অর্থনীতি

ডিম ব্যবসায় করপোরেটের থাবা

Icon

ড. আর এম দেবনাথ

প্রকাশ: ১৯ আগস্ট ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ডিম ব্যবসায় করপোরেটের থাবা

ডিম আমদানির কথা শুনে আমার একটি গল্পের কথা মনে হলো। গল্পটা কে বলেছিল তা মনে নেই। তবে তা পাকিস্তানি (১৯৪৭-৭০) আমলের কথা। তখন বড় বড় রাস্তাকে বলা হতো ‘ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের’ রাস্তা। একবার ঝড়ে প্রচুর গাছপালা নষ্ট হয়। নষ্ট হয়ে অনেক বড় বড় গাছ রাস্তায় চলাচলে বিঘ্ন সৃষ্টি করে। এক গ্রামের পাশেই এমন একটি ঘটনা ঘটে। বিশাল একটা গাছ পড়ে রাস্তা বন্ধ হয়ে আছে। অথচ কেউ ওই গাছে হাত দিচ্ছে না।

প্রশ্ন, কার গাছ, কে তা কাটবে? এটা কি ইউনিয়ন কাউন্সিলের গাছ, না ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের গাছ, না বন মন্ত্রণালয়ের গাছ? এর উত্তর কারও জানা নেই। অতএব, অচলাবস্থা চলতে থাকে। সমন্বয়ের কোনো ব্যবস্থা নেই। মানুষের দুর্ভোগ বাড়ে। বলাই উচিত, আমরা ডিম আমদানি নিয়ে এমন একটি পরিস্থিতিতে পড়েছি। ডিম আমদানি কে করবে? করবে নাকি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। কিন্তু বাধা বন ও পশু মন্ত্রণালয়। তাদের অনুমতি লাগবে। কারণ তারাই ডিম উৎপাদনকারী খামারিদের স্বার্থ দেখে। আমদানি করলে খামারিরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে; তাই অনুমতি মেলে না।

অতএব, ডিম আমদানির সিদ্ধান্ত হয় না। সমন্বয় করার ব্যবস্থা কী? দুই মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমঝোতার কী ব্যবস্থা? ব্যবস্থা দৃশ্যত নেই। এদিকে বাণিজ্যমন্ত্রী বড় ব্যবসায়ী টিপু মুনশি অসহায়ভাবে বলছেন আরেক কথা। মানুষের অভিযোগ, ‘সিন্ডিকেটের’ অংশীদার বড় বড় ডিম ব্যবসায়ী কারসাজি করে ডিমের দাম বাড়িয়ে বাজার থেকে শত শত কোটি টাকা লোপাট করে নিচ্ছে। মাননীয় মন্ত্রী বলছেন, তিনি ‘সিন্ডিকেট’ ভাঙতে পারেন; কিন্তু এতে বড় ঝুঁকি রয়েছে। সিন্ডিকেটে হাত দিলে তারা ডিমের বাজার তছনছ করে দেবে। মানুষের ভোগান্তি আরও বেশি বাড়বে।

প্রায় একই যুক্তি তিনি পেঁয়াজের ক্ষেত্রে, কাঁচামরিচের ক্ষেত্রেও দিয়েছেন। দিয়েছেন সয়াবিন তেলের ক্ষেত্রেও। তার কথা এবং শিল্প প্রতিমন্ত্রীর কথা যোগ করলে বলা যায়, বাংলাদেশে ‘সিন্ডিকেট’ সরকারের চেয়ে শক্তিশালী। অথচ আমরা জানি, সরকার হচ্ছে সবচেয়ে শক্তিশালী সংগঠন। তাকে অবহেলা করে পার পাওয়া যায় এমন কোনো শক্তি নেই। থাকলে তা হবে ‘সমান্তরাল সরকার’ (প্যারালাল গভর্নমেন্ট), যা খুবই বিপজ্জনক বিষয়। প্যারালাল গভর্নমেন্ট থাকলে নিয়মিত সরকার দেশ চালাতে পারে না। দৃশ্যত মনে হচ্ছে, দেশে তাহলে সমান্তরাল একটি সরকার আছে। একে ‘সরকারের ভেতরে সরকার’ও বলা যায়, যার কথা প্রয়াত অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত কয়েকবার বলেছিলেন।

সব দেখে শুনে মনে হচ্ছে, ‘সিন্ডিকেটের’ ব্যবসায়ীরা দেশে একটা ‘সমান্তরাল সরকার’ প্রতিষ্ঠা করে বসে আছে। অথচ পণ্য উৎপাদন, বাজারজাতকরণ, গুদামজাতকরণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে একচ্ছত্র আধিপত্য যাতে কেউ বিস্তার করতে না পারে, সে জন্য কঠিন সব আইন রয়েছে। ট্যারিফ কমিশন, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন, প্রতিযোগিতা কমিশন ইত্যাদি রয়েছে। প্রতিযোগিতা কমিশনের আগে ছিল মনোপলি অ্যান্ড রেস্ট্রিকটিভ ট্রেড প্র্যাকটিসেস (গ্রিভেনশন অ্যান্ড কন্ট্রোল) আইন-১৯৭০। এসব আইনের অধীনে সরকারি অধিদপ্তরের বাজার মনিটর করার কথা।

প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ ব্যবসা ক্ষেত্রে রক্ষিত হচ্ছে কিনা, ক্রেতারা প্রতারিত হচ্ছে কিনা, ক্রেতা-ভোক্তাদের স্বার্থ রক্ষিত হচ্ছে কিনা-এসব দেখার কথা ওইসব প্রতিষ্ঠানের। দেখা যাচ্ছে, এসব আছে-তার মধ্যেই একশ্রেণির ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট তৈরি করে বাজার থেকে নিয়মিতভাবে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট করে নিচ্ছে। কোনো প্রতিকার নেই।

এ অবস্থা একদিনে সৃষ্টি হয়নি। বাঙালি ব্যবসা জানত না। ধীরে ধীরে সে বেচাকেনা, আমদানি-রপ্তানি, ঋণ গ্রহণ, শিল্পায়ন-এসব শিখেছে। শিখেছে পুঁজি বানানোর নানা পন্থা। অবাধ বাজার অর্থনীতি, অমানবতাবাদী অর্থনীতি তাদের এ কাজে উৎসাহিত করেছে। যেমন আমদানি ক্ষেত্রের ঘটনার কথাই বলি। স্বাধীনতার পর আমদানিকারক ছিল না। ছোট ছোট আমদানিকারকরা লাইসেন্স জোগাড় করে দল বেঁধে একসঙ্গে আমদানি করত। একা একা আমদানি করা ছিল অর্থনৈতিক ও ব্যবসায়িকভাবে অলাভজনক। তাছাড়া আমদানি করার জন্য বড় বড় ঋণপত্র খোলার সামর্থ্যও তাদের ছিল না। আর আজ? আজ ছোট ছোট ঋণপত্র নয়; ১০০, ২০০ কোটি টাকার ঋণপত্র (এলসি) খোলার সামর্থ্য আছে এমন ব্যবসায়ীর সংখ্যা অনেক।

অনেক ব্যবসায়ীর নিজের জাহাজও আছে। তারা ইচ্ছামতো পণ্য আমদানি করে। সরকারের নিয়মনীতি ভঙ্গ করে, সরকারের নিয়মনীতি পরিবর্তনে জোর খাটায়। দেখা যাচ্ছে, প্রায় সব নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানিতেই এখন বড় বড় ব্যবসায়ীর সিন্ডিকেট আছে। তেল, চিনি, পেঁয়াজ, রসুন, দুধ, ডাল ইত্যাদি থেকে শুরু করে সব পণ্যের বাজারই তারা নিয়ন্ত্রণ করে। তারা সারা দেশে একটা নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে। এর সঙ্গে জড়িত হয়েছে আড়তদার, পাইকারি বিক্রেতা, এমনকি বড় বড় খুচরা ব্যবসায়ীও। প্রযুক্তি তাদের সহায়তা করছে। মুহূর্তে মুহূর্তে বাজার আপডেট তারা পেয়ে যাচ্ছে এবং সেই অনুসারেই তারা কাজ করছে।

আমদানির কথা বাদ দিলে দেশের ভেতরের বাণিজ্যেও একই অবস্থা। চাল, ডাল, তেল, ডিম, দুধ, মাংস, মাছ, শাক-সবজি-সব ক্ষেত্রে বিশাল বিশাল ব্যবসায়ীর জন্ম হয়েছে। তাদের আর্থিক ক্ষমতা যেমন আছে, তেমনি অতি সহজেই তারা পেয়ে যাচ্ছে ব্যাংক ঋণ। এ দুই শক্তিতে তারা বাজারে একচেটিয়া অবস্থান তৈরি করে ফেলেছে। তাদের নেটওয়ার্ক এত শক্ত যে তারা সরকারকে ‘বৃদ্ধাঙ্গুলি’ দেখায়। ব্যাংক বাজারেও একই অবস্থা। ওষুধের বাজারেও একই অবস্থা। সব ব্যবসার আকার এখন বড় বড়। এটা দোষের কিছু নয়। মুক্তবাজার অর্থনীতিতে তা-ই ঘটে। ছোটরা সব মার খায়, বড়রা টিকে থাকে। তৈরি পোশাক শিল্প, বস্ত্রশিল্প ইত্যাদিতেও বড় বড় প্রতিষ্ঠান টিকছে। বাকিরা সব ঝরে পড়ছে। বড়দের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে তারা টিকতে পারছে না।

চিনির বাজার, সিমেন্টের বাজার, ইস্পাতের বাজার-এ সবেরও একই অবস্থা। যেমন, ধরা যাক ওষুধের ব্যবসা। আগে পাড়ায় পাড়ায় ছোট-মাঝারি ওষুধের দোকানে আমরা যেতাম। তারা নির্ভরশীল দোকানদার ছিল। আজ আর এ অবস্থা নেই। বড় বড় ওষুধের দোকানের যন্ত্রণায় ছোট ও মাঝারিরা টিকতে পারছে না। ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিকরাই ওষুধ কোম্পানির মালিক। তারা হাসপাতালে, হাসপাতালের ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ওষুধ বিক্রি করে। ওইসব ওষুধও ডাক্তাররাই ‘প্রেসক্রিপশন’ করে। ডাক্তার, ওষুধ কোম্পানি, হাসপাতাল, ডায়াগনস্টিক সেন্টার মিলে গড়ে উঠেছে বিশাল বাণিজ্য।

ছোট ছোট ওষুধের দোকান ধীরে ধীরে মারা যাচ্ছে। মুড়ি, চিড়া, খই, গুড় ইত্যাদি ছোট ছোট ব্যবসায়ীরা বিক্রি করত। ছোট ছোট উৎপাদকের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ ছিল। সেসব আজ নেই। এখন হচ্ছে বড় বড় সুপারশপ, শপিংমল। সব প্যাকেটজাত দ্রব্য-দেখতে চমকপ্রদ। গ্রাহকরা ওইসব পছন্দ করে। অতএব, এদের বাজার ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে, ছোট-মাঝারিরা মার খাচ্ছে।

মুশকিল হচ্ছে, এখন মূল্যস্ফীতির কারণে কোনো ছোট ব্যবসা করা সম্ভব নয়। কারণ ব্যবসা করতে প্রচুর পুঁজি লাগে। পাঁচ-সাত-দশ লাখ টাকায় ব্যবসা করা শহরে খুবই কঠিন। ছোট ছোট পুঁজিপতির পক্ষে দোকান করে ব্যবসায় টিকে থাকা কঠিন। শিল্পের অবস্থাও একই। ছোট ও মাঝারি শিল্পের দুর্দিন। যে পুঁজি এখন লাগে, তা ছোট ছোট কারখানা মালিকদের থাকে না। ব্যাংকাররাও তাদের প্রতি নজর দেয় না। এ কারণে ছোট ছোট উদ্যোগের প্রচুর সম্ভাবনা থাকলেও এ খাত আশানুরূপ অবদান রাখতে পারছে না। দেখা যাচ্ছে, কনজিউমার মার্কেট, শিল্প বাজার ধীরে ধীরে বড় বড় কোম্পানির হাতে চলে যাচ্ছে। তারা নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি করে বাজার সম্প্রসারণ করছে।

ছোটদের আর্থিক সাহায্য দিয়ে উৎপাদনে তারা সহায়তা করে। বাজারজাতকরণে সাহায্য করে। যেমন, আগে দাদন ব্যবসা ছিল গ্রামে কৃষির ক্ষেত্রে। ধান-পাট চাষের সময় কৃষকদের পুঁজি থাকে না। আবার পণ্য উৎপাদনের পর বাজার পাওয়া যায় না। সেখানে ‘দাদনওয়ালা’ এসে হাজির হয়। তারা অভাবী কৃষক-চাষিদের পুঁজি দেয় দুর্দিনে। পরিমাণমতো ও সময়মতো দেয়। ব্যাংকের মতো কোনো ঝুট-ঝামেলা এখানে নেই। উৎপাদনের পর কী দাম হবে, তা আগেই নির্ধারণ করা হয়। কৃষক যেহেতু উৎপাদনের পর বাজার পায় না, সাধারণত তারা দাদনওয়ালাদের আশ্রয় নেয়। ঠকে, কিন্তু কোনোমতে বেঁচে থাকে। ঋণ পায়, বাজার পায়, কোনোমতে টেকা যায়।

আগে শুধু ধান-পাটে এ ব্যবস্থা ছিল। এখন ধীরে ধীরে অন্য পণ্যেও এ ব্যবস্থা জায়গা করে নিচ্ছে। যেমন, গত ১৫ আগস্টের একটি খবরের শিরোনাম : রাজশাহীতে ডিমের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে ‘কন্ট্রাক্ট ফার্মিং’। খবরটিতে বলা হয়েছে-ডিম, মাংস ইত্যাদির দাম এখন ঠিক করছে বড় বড় ‘করপোরেট হাউজ’। ডিমের নামমাত্র মূল্য পাচ্ছে খামারিরা। বাকি লাভ খাচ্ছে ‘করপোরেট হাউজগুলো’। তাদের অস্ত্র হচ্ছে ‘কন্ট্রাক্ট ফার্মিং’। চুক্তিভিত্তিক এ ব্যবসায় খামারিদের বাসা, খাবার ও ওষুধ সরবরাহ করে বড় বড় কোম্পনি। মুরগি বড় হলে, ডিম দেওয়া শুরু করলে তারা পূর্বনির্ধারিত দামে এসব কিনে নেয় খামারিদের কাছ থেকে।

খামারিরা গরিব লোক অধিকাংশ ক্ষেত্রে। মুরগির বাচ্চা কেনা, খাবার ও ওষুধে আজকাল অনেক পুঁজি লাগে। অনেকেরই এ টাকা নেই। বাধ্য হয়ে তারা ‘করপোরেটের’ সঙ্গে চুক্তি করে। যারা তা করতে চায় না, তাদের নানাভাবে বাধ্য করা হয় চুক্তিতে আসতে। উত্তরবঙ্গে তামাক চাষের এ ব্যবস্থা চালু অনেকদিন থেকে। এখন ডিমের ক্ষেত্রে তা প্রসারিত হয়েছে। করপোরেট হাউজগুলো হাতে ডিম ও মুরগি পেয়ে যথেচ্ছভাবে দাম নির্ধারণ করে। কারা এসব কোম্পানি সবাই জানে। তাদের শক্তিশালী সংগঠন রয়েছে। কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে তারা তাদের নির্ধারিত মূল্য যে ঠিক, তার জানান দেয়।

এ অবস্থার মধ্যে আছি আমরা। সিন্ডিকেট, সিন্ডিকেট-সর্বত্র সিন্ডিকেট। ব্যবসায়িক ক্ষমতা কুক্ষিগত কিছু কোম্পানির হাতে। অবাধ বাজার অর্থনীতির এই হচ্ছে ফল। ছোটরা মরবে, চাকরি হারাবে, বাজার হারাবে-বড়রা টিকবে, বাজার নিয়ন্ত্রণ করবে, টাকা বানাবে এবং রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করবে। তাহলে উপায়?

ড. আর এম দেবনাথ : অর্থনীতি বিশ্লেষক; সাবেক শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম