Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

ডেঙ্গুর ভয়াবহতা রোধে গবেষণার বিকল্প নেই

Icon

ড. মো. গোলাম ছারোয়ার

প্রকাশ: ১৭ আগস্ট ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ডেঙ্গুর ভয়াবহতা রোধে গবেষণার বিকল্প নেই

বৃষ্টিপাত, তাপমাত্রা, আপেক্ষিক আর্দ্রতা এডিস মশার বংশবিস্তারে বড় ভূমিকা পালন করে। বর্তমান বাংলাদেশে এ উপাদানগুলোর প্রাচুর্যতা এডিস মশার সংখ্যা বৃদ্ধিতে যেমন ভূমিকা রাখছে, একইভাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সীমাবদ্ধতা আর উপর্যুপরি রাসায়নিক কীটনাশকের ব্যবহার এডিস মশাকে দস্তুর মতো ডেঙ্গু ভাইরাসকে অপরিসীম শক্তি জোগাতে উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করে অপ্রতিরোধ্য করে তুলেছে। এডিস মশা হেমাটোফেগাস, অর্থাৎ এরা হোস্ট বডি বা পোষকের শরীরের গন্ধ, তাপমাত্রা ও আপেক্ষিক আর্দ্রতা ইত্যাদি অনুভব করে তার অবস্থান নির্ধারণ ও রক্ত শোষণ করে থাকে। এ ধারাবাহিকতায় আমাদের পরিষ্কার ধারণা থাকতে হবে যে, অ্যাডাল্ট স্ত্রী মশাই আমাদের সার্বক্ষণিকভাব খুঁজে বেড়ায়। তাই যেখানে তার উপযুক্ত পোষক মানুষ থাকবে, তাকে অবশ্যই কামড়ানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে।

এখন প্রশ্ন হলো, এ চিহ্নিত শত্রুর ঝটিকা আক্রমণ থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য আমরা কতটুকু সচেষ্ট ও তৎপর? দুই দশকের বেশি সময় ধরে এ শত্রুর আক্রমণে আমাদের দেশে যে আড়াই লাখ মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন, তাদের ওপর গবেষণা করে হিস্ট্রি এনালিসিসের মাধ্যমে যদি তাদের আর্থসামাজিক অবস্থা পুরোপুরিভাবে জানা যেত, তাহলে পলিসি তৈরি করে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা অনেক সহজ ও সফল হতো। আর এজন্যই দেশে প্রয়োজন দক্ষ মেডিকেল এন্টোমোলোজিস্ট বা কীটতত্ত্ববিদ। গবেষণালব্ধ ফলাফল ও বিশ্লেষণেই বলে দিতে পারত কোন্ শ্রেণি-পেশার মানুষ এই এডিস মশার ভয়ংকর আক্রমণের মারাত্মক শিকার। আর সর্বমোট ৮৭০ জন মৃত ব্যক্তির হিস্ট্রি অ্যানালিসিস বলে দিত কোন আর্থসামাজিক অবস্থান ও পেশার মানুষ এ করুণ পরিস্থিতির শিকার। তখনই বের হয়ে আসত কোন রিস্ক ফ্যাক্টরগুলো এই ভয়াবহ পরিস্থিতি জন্য দায়ী। সেসব রিস্ক ফ্যাক্টরের ওপর যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করে এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় সমস্যা সমাধানের পথ অনেক সহজ হতো।

আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোয় বেশির ভাগ মানুষই নিজের স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন নয়। একান্ত প্রয়োজন না হলে স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতনতা দূরের কথা, চিকিৎসকের শরণাপন্নই হয় না অনেকে। দেশের সরকার ও রাষ্ট্রযন্ত্র যতক্ষণ চরম ব্যবস্থা গ্রহণ না করে, ততক্ষণ জনস্বাস্থ্যবিষয়ক ফ্রি অ্যাডভোকেসি সাধারণ মানুষের গভীর মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারে না। এ ধারাবাহিকতায় জনস্বাস্থ্য সমস্যায় সব সময় সরকারি বা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোই মুখ্য ভূমিকা পালন করে আসছে। তবে তার জন্য অবশ্যই সরকারের কাছে সঠিক গবেষণালব্ধ পরিসংখ্যান থাকতে হবে। উদাহরণস্বরূপ স্মরণ করা যায় কোভিড-১৯-এর সময় সরকারকে কতটা কঠিন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হয়েছিল জনগণকে অতিমারি সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করে তাদের রক্ষা করতে। তাই আক্রান্ত ও মৃত ব্যক্তির হিস্ট্রি অ্যানালিসিসের ফলের ভিত্তিতে গ্রুপিং করে সুনির্দিষ্টভাবে নেওয়া পদক্ষেপই বাঁচাতে পারে আমাদের এই অনিশ্চিত ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে।

তাই ডেঙ্গুর কেস ও ডেথ বিশ্লেষণ করে ভেক্টর ম্যানেজমেন্ট করতে গেলে আমাদের যা সবচেয়ে জরুরি, তা হলো ভেক্টর বিশেষজ্ঞ। জনস্বাস্থ্যর সঙ্গে সম্পৃক্ত ভেক্টর-প্যাথোজিন-পোশাক সম্পর্কে একমাত্র পরিচ্ছন্ন ও সঠিক ধারণা দিতে পারবে মেডিকেল এন্টোমোলোজিস্ট, যার বড়ই অভাব অনুভূত হচ্ছে রন্ধ্রে রন্ধ্রে। বাংলাদেশে এ ধরনের বিশেষজ্ঞ তৈরির বন্দোবস্ত কেন এতদিন করা হয়নি, তা সত্যিই এক মহা আশ্চর্যের বিষয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সব সময়ই বলে আসছেন, চিকিৎসাক্ষেত্রে গবেষণা বড়ই প্রয়োজন। মেডিকেল এন্টোমোলোজিই হতে পারে এক্ষেত্রে বেসিক ও অ্যাপ্লায়িড গবেষণার মাইলফলক।

দেশটা আমরা অনেক চড়া মূল্যে স্বাধীন করেছি। সব শ্রেণি-পেশার মানুষের সমন্বয়ে গঠিত এ শ্যামল দেশকে ক্ষুধা, দারিদ্র্য, অপুষ্টি ও সব ধরনের রোগজীবাণুর সংক্রমণ থেকে রক্ষা করে সুস্থ, সবল, কর্মোদ্যম জাতি গঠনের নিমিত্তে নিজেদের রক্ষা করার দায়িত্ব আমরা নিজেই নেব, তবে তা অবশ্যই বিজ্ঞানসম্মতভাবে। পরিবেশকে বাঁচিয়ে রাখার সব কলাকৌশল আমাদেরই গ্রহণ করতে হবে। আমাদের দেশের, বিশেষ করে ঢাকা শহরের এক বিশাল জনগোষ্ঠী অত্যন্ত সাধারণ মানের জীবনযাপন করে। স্বাস্থ্যবিধির অনেক উপাদানই সেখানে অনুপস্থিত। আমরা একটু ভেবে দেখি, অতি সকালে ঢাকা শহরে যে পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের দেখা যায়, যাদের সারাক্ষণ চলে ময়লা-আবর্জনা আর জীবাণুর সঙ্গে নিবিড়তা, তাদের স্বাস্থ্যসচেতনতার তৎপরতা কতটুকু? মাছের ও মুরগির বাজারে যারা সার্বক্ষণিক খালি হাতে মাছ ও মুরগি কাটাকাটি করছে, তাদের কাছে স্বাস্থ্যসচেতনতার গুরুত্ব কতটুকু? আমরা একবারও কি ভেবেছি, মর্গে যারা প্রতিনিয়ত মৃত লাশ কাটছে, যারা পরিষ্কার করছে আমাদের বাথরুমের ময়লা, তারা রোগজীবাণু ছড়ানো নিয়ে কতটা সজাগ? যে বৃহৎ জনগোষ্ঠী মশারি ছাড়া ফুটপাতে ঘুমায়, তাদের স্বাস্থ্যের কথা আমরা কি ভাবি? অতি প্রত্যুষে যে জনগোষ্ঠী একটি কোদাল আর শাবল হাতে ঢাকার রাস্তার মোড়ে মোড়ে বসে থাকে একটা কাজের আশায়, হয়তো এমন দিন যায়-কাজ না পেয়ে তাদের নিরাশার কষ্ট বুকে নিয়ে অনাহারের ভয়াবহ আশঙ্কায় ভগ্ন হৃদয়ে খালি হাতে ফিরে যেতে হয় নিরন্ন বিষণ্ন মুখে প্রিয়জনদের কাছে। এ মানুষগুলো কতটা ভাবতে পারে স্বাস্থ্যের উন্নতির কথা? যদি পরিষ্কার করে বোঝা যেত, এডিস মশার ভয়ংকর আক্রমণের শিকার জনগোষ্ঠীর মধ্যে কোন শ্রেণির আধিক্য কতটা; আর মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়া হতভাগ্য মানুষগুলো কোন গ্রুপের মধ্যে পড়ে, তাহলে পলিসি তৈরি এবং তা বাস্তবায়নের লক্ষ্যমাত্রা সঠিকভাবে নিরূপণ করা যেত। জাতি রক্ষা পেত এ ভয়াল পরিস্থিতি থেকে। আর জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের গবেষণালব্ধ ফলাফলে আসত সার্থকতা।

ড. মো. গোলাম ছারোয়ার : অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, কীটতত্ত্ব বিভাগ, জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান (নিপসম)

 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম