শতফুল ফুটতে দাও
আইনটির মৌলিক পরিবর্তন হলো কি?
ড. মাহবুব উল্লাহ্
প্রকাশ: ১০ আগস্ট ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
বহু আলোচনা ও বহু বিতর্কের জন্মদানকারী ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পরিবর্তন করতে যাচ্ছে সরকার। এর বদলে যে আইনটি আসছে, তার নামকরণ করা হয়েছে ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন’। ডিজিটাল আইনের অধিকাংশ ধারা নতুন আইনে থাকছে। তবে যেসব ধারা নিয়ে তীব্র সমালোচনা ছিল, সেগুলোর কয়েকটি ক্ষেত্রে সাজা কমিয়ে আনা হয়েছে। জামিনের অযোগ্য কয়েকটি ধারাকে করা হয়েছে জামিনযোগ্য।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের পরিবর্তন নিয়ে অংশীজনদের যে প্রত্যাশা ছিল তা পূরণ হয়নি। সাংবাদিকসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের হয়রানির আদৌ অবসান ঘটবে কিনা তা নিয়ে সন্দিহান বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, ডিজিটাল আইন ব্যবহৃত হচ্ছে বিরোধী মত দমনে ও মুক্ত মতপ্রকাশ বাধাগ্রস্ত করতে। পুরোনো আইনটির গভীর সংস্কার না করে যে আইনের প্রস্তাব করা হয়েছে, তাতে হয়রানি কমবে বলে অংশীজনরা আস্থাশীল নয়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে ৭ আগস্ট ২০২৩ সোমবার তার কার্যালয়ে মন্ত্রিসভার বৈঠকে এ সংক্রান্ত প্রস্তাবে নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এখন এ আইনের খসড়া আইন মন্ত্রণালয়ে ভেটিংয়ের পর চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য আবারও মন্ত্রিসভায় উঠবে। পুরো প্রক্রিয়া অনুসরণ করে সংসদের আগামী সেপ্টেম্বরের অধিবেশনে নতুন আইন পাশ করা হবে বলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের জানিয়েছেন। আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের আগেই সাইবার নিরাপত্তা আইন পাশ হতে যাচ্ছে। ২০১৮’র জাতীয় নির্বাচনের আগে সমালোচিত তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন বদলিয়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাশ করা হয়েছিল সংসদে।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপপ্রয়োগের কারণে জাতিসংঘসহ দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংস্থা আইনটির যেসব ধারা বাতিল ও সংশোধনের দাবি করেছে, সেগুলো প্রায় সবই বহাল থাকছে। প্রস্তাবিত আইনের খসড়া পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, শুধু অজামিনযোগ্য ৮টি ধারা জামিনযাগ্য করা ও শাস্তির মাত্রা কমানো হয়েছে। এর বাইরে সাইবার নিরাপত্তা আইনের তাৎপর্যপূর্ণ খুব বেশি পরিবর্তন আসছে না। পরোয়ানা ছাড়া গ্রেফতারের বিধান, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত, রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তা ও নিরাপত্তা রক্ষা, বন্ধু রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের নামে যেসব ধারার কারণে ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনকে নিবর্তনমূলক আইন হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়েছিল, সেগুলো প্রস্তাবিত আইনেও থাকছে। সাইবার আইনে ডিএসএ’র মতো মোট ৬০টি ধারা থাকছে। এতে ৫টি ধারা অজামিনযোগ্য রাখা হয়েছে। অর্থাৎ নাম বদল করা হলেও আইনের চরিত্রগত বৈশিষ্ট্য পরিবর্তিত হচ্ছে না।
২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে পাশ হওয়া ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে প্রায় সাড়ে ৭ হাজার মামলা হয়েছে। এ আইনের মামলায় গ্রেফতার লেখক মুশতাক আহমেদ ২০২১ সালে কারাগারে মৃত্যুবরণ করেন। এ পর্যন্ত প্রায় তিনশ সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে (সমকাল, ০৮ আগস্ট ২০২৩)। ধর্মীয় ও অন্যান্য অনুভূতিতে আঘাতের মামুলি অভিযোগে মামলা ও গ্রেফতারের কারণে ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন নিয়ে দেশে-বিদেশে প্রচুর সমালোচনা হয়েছে। জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ফোলকার টুর্ক এ আইনকে স্থগিত করে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের শর্তের সঙ্গে সংগতি রেখে সংস্কারের আহ্বান জানিয়েছেন। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, রিপোর্টারস উইদাউট বর্ডারসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠন এ আইনের সমালোচনা করে তা বাতিলের দাবি জানিয়েছে বিভিন্ন সময়ে। জাতিসংঘ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২১ ও ২৮ ধারা সম্পূর্ণ বাতিল এবং ৮টি ধারার সংশোধন চেয়েছিল। এসবের পরিপ্রেক্ষিতে গত মে মাসে বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবসের এক অনুষ্ঠানে আইনমন্ত্রী জানান, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল হবে না। তবে যেসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, তেমন কিছু বিষয় সংশোধন হবে। শেষ পর্যন্ত মন্ত্রিসভা ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট পরিবর্তন করে সাইবার নিরাপত্তা আইন করার অনুমোদন দিল।
ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের বিতর্কিত ৪৩ ধারা পরিবর্তন করা হচ্ছে না। এ ধারা অনুসারে কোনো পুলিশ কর্মকর্তা যদি মনে করেন, কোনো স্থানে এ আইনের অধীনে কোনো অপরাধ সংঘটিত হয়েছে বা হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, তাহলে কোনো পরোয়ানা ছাড়াই তল্লাশি সরঞ্জাম জব্দ, দেহ তল্লাশি এবং সংশ্লিষ্টকে গ্রেফতার করতে পারবেন। এর পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে আইনমন্ত্রী বলেছেন, সাইবার অপরাধের ক্ষেত্রে যেসব সরঞ্জাম ব্যবহার করা হয়, তা জব্দ না করলে প্রমাণ নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। সে কারণে এটি অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। আলোচ্য আইনের এ ধারাটিতে পুলিশ কর্মকর্তাদের সুইপিং পাওয়ার দেওয়া হয়েছে। এর ফলে পুলিশ কর্মকর্তারা খুদে স্বৈরাচারীতে পরিণতি হবেন বলে আশঙ্কা হয়।
সাইবার নিরাপত্তা আইনের খসড়া পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ডিজিটাল আইনের প্রতিটি ধারা প্রতিস্থাপিত হচ্ছে। তবে অপরাধের শাস্তি কমানো হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২১, ২২, ২৩, ২৪, ২৬, ২৮, ৩১ ও ৩২ ধারা অজামিনযোগ্য হলেও প্রস্তাবিত আইনে জামিনযোগ্য করা হয়েছে। এ ছাড়া দ্বিতীয়বার একই অপরাধের ক্ষেত্রে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে থাকা দ্বিগুণ শাস্তির বিষয়টি প্রস্তাবিত আইনে রাখা হয়নি।
সাংবাদিকদের জন্য নিপীড়নমূলক ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের ২৯ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক মাধ্যমে মানহানিকর তথ্য প্রকাশ বা প্রচার করেন, তাহলে তিনি তিন বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন বা ৫ লাখ টাকা জরিমানা করা হবে। প্রস্তাবিত আইনে কারাদণ্ড থাকছে না। কিন্তু জরিমানা ৫ লাখ থেকে বাড়িয়ে ২৫ লাখ টাকা করা হয়েছে। জরিমানা অনাদায়ে ৩ মাসের কারাদণ্ড হতে পারে। ৩২ ধারায় সরকারি গোপনীয়তা ভঙ্গের অপরাধের শাস্তি আগে ছিল ১৪ বছর, সেটি কমিয়ে ৭ বছর করা হয়েছে। ৩৩ ধারা সম্পূর্ণ বিলুপ্ত করে হ্যাকিং সম্পর্কিত অপরাধ নামের নতুন ধারা প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। এ অপরাধের শাস্তি অনধিক ১৪ বছরের কারাদণ্ড বা ১ কোটি টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে।
সাইবার প্রযুক্তি যখন ছিল না, তখন কোনো সরকার কিংবা শাসকগোষ্ঠী সাইবার নিরাপত্তা আইন প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেনি। সাইবার নিরাপত্তা আইনের চৌহদ্দিতে কৃত অপরাধগুলো এ প্রযুক্তি আসার আগেও ছিল। তবে হ্যাকিংয়ের মতো অপরাধের বিষয়গুলো মানুষের চিন্তা-চেতনায় ছিল না। বলা যেতে পারে, প্রস্তাবিত সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্টের আওতাভুক্ত অধিকাংশ অপরাধ প্রচলিত আইনেই বিচার করা সম্ভব ছিল। নতুন প্রযুক্তিকে উসিলা করে শাসকগোষ্ঠী একটি কঠিন ও কঠোর নিবর্তনমূলক আইন চালু করল। বর্তমানকালে সাইবার প্রযুক্তি একটি শক্তিশালী প্রযুক্তি হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে। এ প্রযুক্তির আবির্ভাবে সমাজদেহে অনেক ক্রিয়া-বিক্রিয়ার উদ্ভব হয়েছে। সাইবার প্রযুক্তি বিশ্ব সভ্যতাকে নতুন দিগন্তে নিয়ে এসেছে। কিন্তু এ প্রযুক্তির সুফলের সঙ্গে অনেক কুফলের উদ্ভব আমরা দেখতে পাই। সভ্যসমাজ গড়তে হলে এসব অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এড়িয়ে চলতে হবে। অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাবলিকে প্রতিরোধ করার জন্য প্রয়োজন আইন-আদালতের মাধ্যমে প্রতিরোধ। দুর্ভাগ্যের বিষয়, শাসকগোষ্ঠী সাইবার প্রযুক্তির কুফলগুলোকে পুঁজি করে মানুষের মধ্যে মুক্তভাবে চিন্তাভাবনার চর্চাকে অবরুদ্ধ করতে চাচ্ছে। এর পরিণতি কোনোক্রমেই মঙ্গলজনক নয়।
বাংলাদেশে আইনের শাসন নিশ্চিত এবং বিচার বিভাগের দক্ষতা ও গতিশীলতা নিশ্চিত করতে পারলে প্রচলিত আইনেই সাইবার অপরাধগুলো প্রতিরোধ করা সম্ভব। রাষ্ট্র কাঠামোর দুর্বলতার জন্য নতুন নতুন নিবর্তনমূলক আইন দিয়ে গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব নয়। আমার মনে হয়, নতুন প্রযুক্তি এবং নতুন ধ্যান-ধারণা আসার ফলে সমাজে যে তরঙ্গ ওঠে, তার ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়া প্রতিরোধ করতে নিবর্তনমূলক আইনের বাইরে গিয়ে কীভাবে পরিস্থিতি মোকাবিলা করা যায়, তা নিয়ে আন্তরিক প্রয়াসের প্রয়োজন পড়েছে।
ড. মাহবুব উল্লাহ : শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ