Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

ঘোর অন্ধকারে কে দেখাবে আলো?

Icon

ড. মুহাম্মদ ইসমাইল হোসেন

প্রকাশ: ০৫ আগস্ট ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ঘোর অন্ধকারে কে দেখাবে আলো?

সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া ‘নতুন সূর্য আলো দাও, আলো দাও’ গানটি আজও আমার চেতনাকে শানিত করে। পরিবেশ-পরিস্থিতির কারণে মনের কোনায় যখন অন্ধকার জমাট বাঁধতে শুরু করে, আমি তখন গুনগুনিয়ে এ গানটি গাই আর সৃষ্টিকর্তার কাছে পরিবেশ-পরিস্থিতির ঘন অন্ধকার কাটিয়ে চারদিকে আকাশ ভরা আলো ফোটানোর প্রার্থনা করি। বিশেষ করে দেশ ও জাতির ভাগ্যাকাশে যখন অন্ধকার ঘনিয়ে আসে, তখন আমি বেশি বেশি করে গানের লাইনগুলো উচ্চারণ করি।

কারণ, গানের কথাগুলোর মধ্যে এক ধরনের মোহনীয় শক্তি আছে। যেমন -‘স্বার্থের লোভে মিথ্যারে করিস না যেন আশ্রয়/সত্যের পথ হোক না দুঃখময়/দুঃখ থাক, মিথ্যা যাক, আলো দেখাও/সত্যের পথ, মঙ্গল পথ তাই শেখাও’।

উলে­খ্য, আমরা যারা জীবনের বেশিরভাগ সময় পার করে এ দেশের মাটি আঁকড়ে পড়ে আছি এবং আমাদের অনেকেই যারা বিদেশে গিয়ে সুখে-স্বাচ্ছন্দ্যে জীবনযাপন করতে পারতাম, তারা যখন স্বদেশের ভাগ্যাকাশে কালো মেঘের ঘনঘটা দেখতে পাই এবং বুঝতে পারি যে, এ দুর্যোগ আমাদের দেশেরই একশ্রেণির মানুষ সৃষ্টি করে চলেছেন, তথন আমাদের মনে ভীষণ কষ্ট হয়। কারণ, আমাদের প্রায় সবাই বিভিন্ন পেশা বা বৃত্তির মাধ্যমে সঠিকভাবে এবং সঠিকপথে জীবনযাপনে অভ্যস্ত। আবার অনেকেরই সন্তানসন্ততি বিদেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে সেখানেই সুপ্রতিষ্ঠিত এবং বারবার তারা তাদের কাছে যাওয়ার জন্য অনুরোধ জানানো সত্তে¡ও আমরা তাদের আহ্বানে সাড়া না দিয়ে দেশের মাটিতেই পড়ে থাকি।

তাছাড়া বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার এসব মানুষের মধ্যে অনেকের আবার আর্থিক সংগতি ভালো থাকায় বছরে তারা প্রচুর অর্থ আয়কর প্রদান করার মাধ্যমে রাজস্ব খাতে অবদান রেখে দেশপ্রেমের পরিচয় দিয়ে চলেছেন। এ অবস্থায় দেশের অন্য আর একশ্রেণির মানুষ, শ্রেণি বা গোষ্ঠীস্বার্থে বারবার দাঙ্গা-হাঙ্গামা বাধিয়ে দেশটাকে বসবাসের অযোগ্য করে তোলার ঘটনা অত্যন্ত দুঃখজনক। কারণ, এ শ্রেণির মানুষ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের নামে থেমে থেমে মারামারি-হানাহানিতে লিপ্ত হওয়ায় দেশের নিরীহ নাগরিকরা তাদের অপকর্মের শিকার হচ্ছেন; অসহায় মানুষজন নিগৃহীত হচ্ছেন। আর এক্ষেত্রে রাজনীতির নামে জনগণকে বোকা বানিয়ে তাদের ধোঁকা দেওয়া হচ্ছে। কখনো নির্বাচনের নামে, কখনো আন্দোলনের নামে তাদের সঙ্গে এমনসব ধোঁকাবাজি করা হচ্ছে।

নির্বাচনের সময়, ‘ধান-চাল করে দেব সস্তা, সোনা দিয়ে মুড়ে দেব রাস্তা’ -এ ধরনের স্লোগান দিয়ে আমজনতাকে বোকা বানানো হচ্ছে, আবার রাস্তাঘাট তৈরির টাকা চুরি করা ঠেকানোর কথা বলে বা ধান-চাল, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে তাদের রাস্তায় নামানো হচ্ছে। আর এসবই করা হয় বা হচ্ছে দলীয় বা গোষ্ঠীস্বার্থে। কারণ, একেকটি নির্বাচন পার হলেই দলীয় ধান্দাবাজ লোকদের হাতে ক্ষমতার চাবিকাঠি তুলে দিতে দেখা যায়। আর দলীয় ধান্দাবাজরা তখন সরকারি টেন্ডার হাতিয়ে নিয়ে রাস্তাঘাট, দালানকোঠা, অবকাঠামো ইত্যাদি নির্মাণের টাকা চুরি করা থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের ভোগ্য চাল, ডাল, নুন, তেল ইত্যাদি পণ্যসংক্রান্ত ব্যবসাতেও কারসাজি শুরু করে দেওয়ায় সাধারণ মানুষের জীবনে ত্রাহি অবস্থার সৃষ্টি হয়।

এমনকি এক ধরনের রাজনৈতিক নেতা দরিদ্র মানুষের জন্য সরকারি বরাদ্দকৃত চাল, গম, ঢেউটিন ইত্যাদি পর্যন্ত চুরি করে থাকেন। আর করোনার সময়ও এ ধরনের চুরিচামারি হওয়ায় সেসব ঠেকাতে সরকারি সাহায্যসামগ্রী বিলিবণ্টনে জনপ্রতিনিধিদের বাদ দিয়ে সরকারি আমলা-কর্মচারীদের মাধ্যমে সে কাজটি করানো হয়।

আমাদের দেশে রাজনীতির নামে আরও যেসব অপকর্ম করা হয়, উদাহরণ দিলে তার তালিকা অনেক লম্বা হবে, বিধায় তার কোনো প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। তবে রাজনীতির নামে অপকর্ম কবে বা কীভাবে দূর হবে বা সুষ্ঠুভাবে একটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে কিছুটা আলোকপাত করা যেতেই পারে।

আমাদের দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের মূল সমস্যা হলো -রাজনীতি করা মানুষদের মূল টার্গেট থাকে অর্থ উপার্জন করা। রাজনীতিকে একটি লাভজনক পেশা হিসাবে গ্রহণ করে তারা রাজনীতি করে খান এবং রাজনীতি করে খেতে খেতে একসময় গোটা দেশটাকেই তারা গিলে ফেলতে চান! কারণ, এসব করে খাওয়া বা খেয়ে ফেলাটা তাদের অভ্যাসে পরিণত হয়ে যাওয়ায় এক সময় এ অভ্যাসটাকে তারা নিজেদের অধিকার হিসাবে বিবেচনা করেন। ফলে ন্যায়নীতি, মূল্যবোধ, সুবচন ইত্যাদি সবকিছু তারা নির্বাসনে পাঠিয়ে দেন; ক্ষমতা দখলের জন্য দিনরাত তারা একে অপরের প্রতি কটুবাক্য, ক‚টকৌশল প্রয়োগ করতে থাকেন।

আর এভাবে একসময় তা চ‚ড়ান্তরূপে মারামারি-হানাহানিতে পরিণত হলে দেশের সাধারণ মানুষ প্রমাদ গুনতে থাকেন; অপরাজনীতির হাত থেকে আমজনতা তখন মুক্তির পথ খোঁজেন। বর্তমান অবস্থাতেও দেশের তথা দেশের মানুষের অবস্থা সেই স্থানে এসে পৌঁছে গেছে বিধায় তাদের আবার মুক্তির রাস্তা খুঁজতে হচ্ছে। ক্ষমতালোভী রাজনৈতিক চক্রের হাত থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার মাধ্যমে তারা বুকভরে নিশ্বাস গ্রহণ করতে চাচ্ছেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, কে দেখাবেন সে পথ, জনসাধারণকে সঠিক ঠিকানাতেই বা কে বা কারা নিয়ে যাবেন? এক্ষেত্রে প্রশ্নটি সহজ হলেও উত্তরটি কিন্তু অত্যন্ত কঠিন ও জটিল।

কারণ, এদেশের রাজনীতি করে খাওয়া লোকগুলো অত্যন্ত স্বার্থপর, প্রয়োজনে তারা অত্যন্ত ভয়ংকর ও নিষ্ঠুর হয়ে ওঠেন। নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারে বিবদমান শিবিরে বিভক্ত হয়ে তারা যে কোনো মুহূর্তে মারামারি-হানাহানি, দাঙ্গা-হাঙ্গামা বাধিয়ে দেন। আর এসব করতে তারা সাধারণ মানুষের সুবিধা-অসুবিধার কথা ভেবে দেখেন না; বরং সাধারণ মানুষকে অসুবিধায় ফেলে তাদের ব্যবহার করেই তারা স্বার্থ হাসিল করেন। প্রয়োজনে তারা ঐতিহাসিক বা প্রাগৈতিহাসিক যুগের নিষ্ঠুরতা প্রদর্শন করতেও পিছপা হন না। ঐতিহাসিক ঘটনায় ক্ষমতা দখলের ক্ষেত্রে যেমন এক ভাই আরেক ভাইয়ের চোখ উপড়ে ফেলতেন, পুত্র হয়ে পিতাকে কারাবন্দি করতেন, বর্তমান অবস্থায়ও সেসবের তেমন কোনো হেরফের হয় বলে মনে হয় না। কিছুটা রকমফের হলেও হতে পারে।

যাক সেসব কথা। আসল কথায় ফিরে আসি। দেশের বর্তমান রাজনৈতিক সংকট মোকাবিলায় কার কী করণীয় এবং কে কী করছেন বা ভাবছেন সেসব বিষয়েও কিছুটা আলোকপাত করতে চাই। শুরুতেই উলে­খ করা প্রয়োজন, বর্তমান অবস্থায় আমাদের রাজনৈতিক দৈন্যদশা এবং দেউলিয়াত্বের কারণে বিদেশি শক্তি আমাদের ওপর জেঁকে বসেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, আমেরিকা তাদের কর্মতৎপরতা বহুগুণ বৃদ্ধি করে আমাদের দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে ঢুকে পড়েছে। আবার জাতিসংঘের বিভিন্ন অঙ্গ-সংগঠনও আমাদের রাজনীতি এবং নির্বাচনের ক্ষেত্রে নাক গলানো শুরু করেছে। আবার জাতিসংঘের অধীনে আসন্ন জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের ধুয়া তুলে কেউ কেউ কম্বোডিয়ার নির্বাচনের প্রসঙ্গ তুলে ধরছেন। কারণ, একটানা ৩৮ বছর ধরে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণে রেখে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া কম্বোডিয়ান পিপলস্ পার্টি দুই মাস আগে আরও একটি নির্বাচনে ১২৫ আসনের মধ্যে ১২০টি আসন নিয়ে নিজেদের পুনরায় নির্বাচিত ঘোষণা করায় সেখানে জাতিসংঘের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি জোরালো আকার ধারণ করেছে।

যদিও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এদেশটির সঙ্গে আমাদের ভ‚-রাজনীতির মিল খোঁজা ঠিক হবে না; কিন্তু তারপরও এসব প্রসঙ্গ টেনে তোলা হচ্ছে। কারণ, রাজনৈতিক সদিচ্ছার ক্ষেত্রে আমরাও অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়েছি; সবসময় ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনৈতিক নীতি গ্রহণের ফলে আমরাও ভেতরে ভেতরে ভীষণ বেকায়দায় পড়ে গিয়েছি। ক্ষমতাই এখন রাজনৈতিক দলগুলোর ধ্যান-জ্ঞান হয়ে ওঠায় কোনো দল বা গোষ্ঠী ক্ষমতার বাইরে অন্য কিছুই বুঝতে চাচ্ছে না। রাজনীতিতে ক্ষমতারোহণ মূল উদ্দেশ্য হলেও বর্তমান অবস্থায় যেনতেনভাবে আমরা ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য পাগল হয়ে উঠেছি। আর এক্ষেত্রে রীতিনীতি, নৈতিকতা বিসর্জন দেওয়ায় বিদেশি শক্তিও আমাদের পেয়ে বসেছে। আমাদের দেশের রাজনীতি এখন ‘গরিবের বউ সবার ভাবীতে’ পরিণত হয়েছে। এ অবস্থায় রাজনৈতিক ক্ষেত্রে দেশি-বিদেশি শক্তির রশি টানাটানির যে খেলা শুরু হয়েছে, তাতে কে জিতবে, কে হারবে, তা বলা মুশকিল।

সরকারে থাকা দলটির সাধারণ সম্পাদক বিভিন্ন স্থানে বক্তৃতা-বিবৃতিতে বলছেন, আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে তারা ৭০ শতাংশ ভোট পাবেন। এ অবস্থায় তার কথাটি আস্থায় নিয়েই বলতে চাই, সরকারের পক্ষ থেকে তাহলে একটি অবাধ, নিরপেক্ষ এবং সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যবস্থা না করার কোনোই কারণ নেই। তবে সে ব্যবস্থা যাতে এমনটি না হয় যে, তা কেবল সরকারি দলের কাছেই গ্রহণযোগ্য হয়। নির্বাচনের সার্বিক ব্যবস্থাপনা যাতে বিরোধী দলসহ দেশি-বিদেশি সবার কাছেই গ্রহণযোগ্য এবং বিশ্বাসযোগ্য হয়, তেমন ব্যবস্থা গৃহীত হলে কেবল তখনই আমরা শান্তির সঙ্গে বসবাস করতে পারব। বিশেষ করে উপেক্ষিত জনতা যেন বুঝতে পারেন, দেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে চলেছে বা হয়েছে।

অন্যথায় অবাধ, নিরপেক্ষ এবং সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে ব্যর্থ হলে কিন্তু তা একটি বিষবৃক্ষ রোপণের মতো ঘটনা হবে এবং দেশের শান্তি বিঘ্নিত হবে। আর দেশের মানুষের জন্য সেটাই হলো আশঙ্কার কথা। এ অবস্থায় এখন এমন একটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রয়োজন, যে ক্ষেত্রে আমরা যারা আওয়ামী লীগের কর্মী বা সমর্থক, শুধু তাদের আস্থা অর্জন করলেই চলবে না, সারা দেশের মানুষেরই আস্থা অর্জন করতে হবে। আমার মনে হয়, বঙ্গবন্ধু প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এ চ্যালেঞ্জটুকু নিতে পিছপা হবে না। কারণ, একটানা ১৫ বছর ক্ষমতায় থেকে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের বিপ্লব ঘটিয়ে এ চ্যালেঞ্জটুকু নেওয়াই যায়। তাছাড়া আওয়ামী লীগের যেসব জনপ্রতিনিধি একনাগাড়ে এতদিন ধরে জনসেবা করলেন, তারাই বা এক্ষেত্রে পিছপা হবেন কেন?

সুতরাং, সঠিকভাবে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক না; আমাদের দেশের একটি সুষ্ঠু নির্বাচন দেশ-বিদেশের মানুষ দেখুক না। দেশের এ রাজনৈতিক ক্রান্তিলগ্নে তেমনটিই প্রত্যাশা করে সবশেষে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের সেই গানের আরও দু’চারটি লাইন উদ্ধৃত করে লেখাটি এখানেই শেষ করছি -‘মানুষেরে যেন বঞ্চনা করে/নিজেরে করি না হীন/অন্যায় যেন হার মানে চিরদিন/অন্ধরাত করো প্রভাত, আলো দেখাও/মর্মে আমার শুভ্র প্রাণের ফুল ফোটাও/নতুন সূর্য, আলো দাও, আলো দাও’।

ড. মুহাম্মদ ইসমাইল হোসেন : কবি, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট

 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম