Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

বেঁচে আছি বিচারহীনতার সংস্কৃতির ভেতর

Icon

মনজু আরা বেগম

প্রকাশ: ২৩ জুলাই ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

বেঁচে আছি বিচারহীনতার সংস্কৃতির ভেতর

‘রোগীদের জিম্মি করে চিকিৎসক ধর্মঘট’। ১৮ জুলাই যুগান্তরের প্রথম পাতার খবর। ভুল চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যুতে তিন চিকিৎসককে গ্রেফতারের ঘটনায় ১৭ ও ১৮ জুলাই দুই দিনব্যাপী রাজধানীসহ সারা দেশে প্রাইভেট হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া ও চেম্বারে রোগী দেখা বন্ধ করে দেন চিকিৎসকরা।

শুধু তাই নয়, প্রাইভেট চেম্বার ও হাসপাতালের সার্জারি বন্ধের পাশাপাশি চিকিৎসকরা প্যাথলজিক্যাল টেস্টের রিপোর্ট দেখাও বন্ধ রাখেন। এর ফলে সারা দেশে লাখ লাখ রোগী চরম ভোগান্তিতে পড়েন। বর্তমানে করোনার মতো ডেঙ্গুও ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। প্রতিদিন মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে।

হাসপাতালগুলো রোগী জায়গা দিতে পারছে না। মানুষের দুর্ভোগ চরম আকার ধারণ করেছে। এমন এক পরিস্থিতিতে দুদিন ধরে চিকিৎসকদের লাগাতার ধর্মঘট পালন করা কতটা মানবিক হয়েছে, জনমনে এমন প্রশ্ন ওঠা অত্যন্ত স্বাভাবিক। কোনো সমস্যার উদ্ভব হলে দাবি-দাওয়া আদায় বা প্রতিবাদের বিভিন্নরকম পথ বা ভাষা আছে। কিন্তু সেবার ব্রত নিয়ে রোগীদের জীবনকে জিম্মি করে এ ধরনের ধর্মঘট ডাকা বা পালন করা কোনোভাবেই কারও কাম্য হতে পারে না। চিকিৎসকরা যখন এ পেশায় আসেন, তখন মানবতার সেবায় নিজেকে নিয়োজিত রাখার শপথ নিয়েই আসেন। এ শপথের সঙ্গে রোগীদের জীবনকে জিম্মি করে ধর্মঘটের কর্মসূচির ডাক দেওয়া কতটা যৌক্তিক হয়েছে?

স্বাস্থ্যসেবার দুরবস্থার খবর প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো পত্রিকায় প্রকাশিত হচ্ছে। ১৯ জুলাই যে হাসপাতালের চিকিৎসক গ্রেফতারের কারণে ধর্মঘট ডাকা হয়েছে, সেই একই হাসপাতালে অন্য একজন চিকিৎসকের অবহেলায় ডেঙ্গু-আক্রান্ত শিশুর মৃত্যুর খবর পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। এবার তারা কী জবাব দেবেন? দেশে স্বাস্থ্যসেবা খাতের দৈন্যদশা, দুর্নীতি ও মানবতাবিবর্জিত কার্যকলাপের কারণে সাধারণ মানুষ হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসাসেবা নিতে গিয়ে প্রতিদিন বিভিন্ন ধরনের হয়রানি ও সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন। গত বছরের ২৯ সেপ্টেম্বর পত্রিকার খবরে শিরোনাম ছিল ‘হাসপাতালে ভুল চিকিৎসা, একমাত্র সন্তান হারিয়ে পাগলপ্রায় মা’। ৮ বছরের কন্যাসন্তানকে জ্বরের কারণে হাসপাতালে ভর্তি করা হলে হাইপাওয়ার অ্যান্টিবায়োটিক ছোট্ট শিশুটির শরীরে পুশ করে তার মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। স্বাস্থ্যসেবাটা এখন আর সেবাধর্মী কাজ না হয়ে এটি মূলত পরিণত হয়েছে বাণিজ্যের প্রধান উপকরণে। রোগী মারা গেলে লাশ আটকে রেখে বিল আদায় করা হয়। হাসপাতালের জন্য বরাদ্দকৃত ওষুধ গরিব রোগীরা পায় না, কিন্তু বাজারে কিনতে পাওয়া যায়। অধিকাংশ বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসা বিল সাধারণ মানুষের আয়ত্তের বাইরে। স্বাস্থ্যখাতে চরম অব্যবস্থাপনা, চিকিৎসক, নার্স, জনবল সংকট, ওষুধের মূল্যবৃদ্ধি, হাসপাতালগুলোতে মানসম্পন্ন চিকিৎসক এবং চিকিৎসার অভাব, মানসম্পন্ন যন্ত্রপাতির অভাব, দক্ষ জনবল/টেকনিশিয়ানের অভাব ইত্যাদি নিয়ে গত বছর আগস্ট মাসে সংসদে এমপিরা অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন। শুধু তাই নয়, ভুল চিকিৎসার কারণে রোগীর হয়রানি, মৃত্যু ইত্যাদি কারণে প্রতি বছর লাখ লাখ মানুষ ভারতসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যাচ্ছেন চিকিৎসার জন্য। এর ফলে দেশ থেকে একটা উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা চলে যাচ্ছে বাইরে। ইতোমধ্যে অনেক সময় পেরিয়ে গেলেও এ সমস্যাগুলোর তেমন কোনো সমাধান হচ্ছে না। ফলে চিকিৎসাসেবা নিতে গিয়ে সাধারণ মানুষ চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন।

গত ৪ এপ্রিল এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান এবং সাবেক সচিব বদিউর রহমান স্বাস্থ্যসেবার বাস্তব অবস্থা নিয়ে যুগান্তরে লিখেছেন, ‘চিকিৎসায় যান্ত্রিকতা, কমেছে আন্তরিকতা’। চিকিৎসাসেবা নিতে গিয়ে সাধারণ মানুষ প্রতিদিন কী পরিমাণ শারীরিক, আর্র্থিক ও মানসিক যন্ত্রণার শিকার হচ্ছেন তা তিনি অত্যন্ত স্পষ্ট করে তুলে ধরেছেন। ডাক্তারের অবহেলার কারণে প্রতিদিন কত মানুষের ভোগান্তি, কত মানুষের প্রাণহানি ঘটছে তার সব খবর পত্রিকার পাতায় আসে না। আর এলেও এ বিষয়ে কী শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে তা-ও আমাদের জানা নেই। আমরা আমজনতা বড় অসহায়। আমাদের কষ্টের কথা কাকে জানাব? কে আমাদের সমস্যার প্রতিকার করবে তা-ও জানি না। তবে এর মধ্যে অনেক ভালো এবং মানবিক গুণসম্পন্ন ডাক্তারও আছেন, যাদের সাহায্য-সহযোগিতায় অনেকে মৃত্যুর দ্বারপ্রান্ত থেকে ফিরেও এসেছেন। তবে এমন মানবিক গুণসম্পন্ন ডাক্তারের সংখ্যা অনেক কম। পত্রিকান্তরে জানা যায়, আন্দোলনরত চিকিৎসকরা বলেছেন, নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে তারা এ কর্মসূচি পালন করছেন। নিজেদের নিরাপত্তা চায় প্রত্যেকেই। এটি দোষের কিছু নয়। কিন্তু তারা কি একবারও ভেবে বলেছেন, রোগীদের নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব তারা কতটুকু দিচ্ছেন বা দিতে পারছেন? ডাক্তারদের অবহেলা, অমানবিকতা এবং ভুল চিকিৎসায় প্রতিদিন কত রোগী প্রাণ হারাচ্ছেন, তার জবাবদিহিতা কোথায়? রোগীদের নিরাপত্তা দেওয়ার কথা যাদের, তারা নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ধর্মঘট ডাকছেন, কিন্তু তাদের ভুলে যখন রোগী মৃত্যুবরণ করছেন, তখন তাদের কোনো শাস্তি হবে না, গ্রেফতার করা যাবে না, এটা কী ধরনের বিচার? আইন সবার জন্য সমান। চিকিৎসকরা কি আইনের ঊর্ধ্বে? তারা তো মানুষ। তাদের স্বজনরা যখন কোনো না কোনো চিকিৎসকের ভুল চিকিৎসায় মারা যাবেন, তখন কি তারা বিচার চাইবেন না? এরকম বিচারহীনতার সংস্কৃতি আর কতকাল চলবে? অপরাধী যেই হোক, অন্যায় করলে সাজা হবে, এটাই তো স্বাভাবিক। অপরাধের শাস্তি না হলে অপরাধপ্রবণতা বাড়তে থাকবে। তা না হলে এ সমাজ একসময় বসবাসের অযোগ্য হয়ে যাবে। আমাদের অনেক চিকিৎসক রয়েছেন, যারা রোগীদের মানুষ বলেই গণ্য করেন না। তাদের দুর্ব্যবহারের কারণে অনেকে হাসপাতালে যেতে ভয় পায়। ডাক্তার, নার্স, এমনকি আয়াদের অবহেলা, দুর্ব্যবহার, তুচ্ছতাচ্ছিল্যভাব রোগীদের মানসিকভাবে আরও অসুস্থ করে তোলে। তারপরও যেতে হয়। কারণ, মানুষ সুস্থ-সুন্দরভাবে বেঁচে থাকতে চায়। আর এ বেঁচে থাকার জন্য শেষ সম্বলটুকুও দিয়ে হলেও স্বজনরা রোগীকে বাঁচানোর চেষ্টা করে।

স্বাধীনতার পর থেকে দেশে বিভিন্ন খাতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। স্বাস্থ্য খাতও এর ব্যতিক্রম নয়। স্বাস্থ্যখাতের উন্নয়নের ফলে আমাদের গড় আয়ু বেড়েছে। শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার কমেছে। স্বাধীনতার পর এ দীর্ঘ সময়ে আমরা আরও এগিয়ে যেতে পারতাম। কিন্তু বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে একশ্রেণির লোভী, বিবেকবর্জিত ডাক্তার এবং কিছু দুর্নীতিপরায়ণ কর্মকর্তা-কর্মচারী। আমাদের অর্জনগুলো ম্লান হয়ে যাচ্ছে। অথচ স্বাস্থ্যসেবা জনগণের মৌলিক অধিকার। আমাদের সংবিধানে পাঁচটি মৌলিক অধিকারের মধ্যে স্বাস্থ্যসেবা একটি। স্বাস্থ্যখাতের উন্নয়নে অব্যবস্থাপনা শক্ত হাতে দমন করতে হবে। ভালো কাজের জন্য পুরস্কার এবং খারাপ কাজের জন্য তিরস্কার বা শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। অপরাধ করে কেউ যাতে পার না পায়, সে বিষয়ে প্রখর দৃষ্টি রাখতে হবে। অপরাধীর কোনো দল নেই। অপরাধী সবার দৃষ্টিতেই অপরাধী। অপরাধীর বিচার হতেই হবে। বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। তা না হলে প্রকৃতির বিচারে আমরা কেউই পার পাব না।

মনজু আরা বেগম : লেখক; সাবেক মহাব্যবস্থাপক, বিসিক

monjuara2006@yahoo.com

 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম