Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

শতফুল ফুটতে দাও

পুঁজি থাকলেই হয় না, সদ্ব্যবহার করতে জানতে হয়

Icon

ড. মাহবুব উল্লাহ্

প্রকাশ: ১৩ জুলাই ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

পুঁজি থাকলেই হয় না, সদ্ব্যবহার করতে জানতে হয়

আজ ১৩ জুলাই বিশিষ্ট ব্যবসায়ী, শিল্পোদ্যোক্তা ও জাতীয় উন্নয়নে অন্যতম কর্ণধার নুরুল ইসলামের মৃত্যু দিবস। ২০২০ সালের এই দিনে ভয়াল করোনার ছোবলে তার জীবনদ্বীপ নির্বাপিত হয়ে যায়। নিঃসন্দেহে বলা যায়, তার মৃত্যুতে বাংলাদেশ হারিয়েছে এক স্বপ্নচারী উদ্যোক্তাকে। মৃত্যুর সময় তার বয়স যে অনেক হয়েছিল এমনটি বলা যাবে না। তিনি ছিলেন একজন সুঠামদেহী সুপুরুষ। মৃত্যুর কাছে এত সহজে হার মানবেন, তা কখনো মনে হয়নি।

করোনার সঙ্গে প্রায় এক মাস লড়াই করার পর তাকে পরাজিত হতে হয়। তিনি আপনজন, শুভানুধ্যায়ী ও দেশবাসীকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে ইন্তেকাল করেন। তিনি যদি আর ১০টি বছর সময় পেতেন, তাহলে তিনি তার অসমাপ্ত স্বপ্নগুলোকে বাস্তবে রূপ দিয়ে যেতে পারতেন। এখনো তার হাতে গড়া অর্ধসমাপ্ত পাঁচতারা হোটেলটির ইট-সিমেন্টের কাঠামো আকাশের দিকে নির্বাক তাকিয়ে আছে। নুরুল ইসলামের প্রয়াণের পর এ বিশাল সৌধ কাঠামোতে এক তিল সিমেন্ট-বালুর আঁচড় পড়েনি। তারপরও তিনি যতসব অমর কীর্তি রেখে গেছেন, একজীবনে কোনো মানুষের পক্ষে তা করা সম্ভব বলে বিশ্বাস হয় না। তাই কবির ভাষায় বলতে হয়, ‘তোমার কীর্তির চেয়ে তুমি যে মহৎ/তাই তব জীবনের রথ, পশ্চাতে ফেলিয়া যায় কীর্তিরে।’

নুরুল ইসলাম একজন ধনাঢ্য পুরুষ ছিলেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশের বাঙালিদের জীবনবোধে এক বিশাল পরিবর্তন সূচিত হয়েছে। এ পরিবর্তনের বহিঃপ্রকাশ হিসাবে আমরা দেখতে পাই, এ দেশের বেশির ভাগ তরুণ আর্থিক সচ্ছলতা অর্জনে আগ্রহী। এরা দরিদ্র থাকতে চায় না। এরা হতে চায় প্রচুর অর্থবিত্তের মালিক। দরিদ্র জীবনের গ্লানি এরা একেবারেই পছন্দ করে না। এর পাশাপাশি এখনো একটি বিপরীতমুখী মনোভাব ক্রিয়াশীল রয়েছে। কেউ অর্থবিত্তের মালিক হলে তাকে দেখে অন্যদের চোখ টাটায়। এটাই হলো আমাদের জীবনের কন্ট্রাডিকশন। তবে এ কথা সত্য, সমাজের সবাই যদি পরস্পরের সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রাচুর্যের জীবনে উন্নীত হতে পারে, তাহলে তার মতো ভালো কিছু হতে পারে না। সমাজতন্ত্র সম্পর্কে পুঁজিবাদী সমালোচকরা বলত, সমাজতন্ত্র হলো দারিদ্র্যের বণ্টন। সমাজতান্ত্রিক দেশে সমতা এলেও মানুষের জীবনযাত্রা দারিদ্র‌্যাবস্থায় থেকে যায়। কিছু কিছু সমাজতান্ত্রিক দেশের অভিজ্ঞতা অনেকটাই এমন ছিল। ধনীদের জীবন লাগামছাড়া ভোগবিলাসের ফলে উচ্ছন্নে যেতে বাধ্য-এমন ধারণা আমাদের সমাজে এখনো বিদ্যমান। রবীন্দ্রনাথ শেষের কবিতায় তার ধনাঢ্য এক চরিত্রের অধস্তন তিন পুরুষের অধঃপাতে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট বলে উল্লেখ করেছেন। দেখা যাচ্ছে আমাদের সমাজে চিন্তায় ধনবান হওয়ার ব্যাপারে বহুকাল ধরেই নেতিবাচক মনোভাব বিরাজ করছে।

চীনের নেতা দেং শিয়াও পিং-এর একটি বিখ্যাত উক্তি হলো-‘ধনী হওয়া খারাপ নয় ‘To be rich is not bad’-এ উক্তিতে অনেকেই বিস্মিত হয়েছিলেন। তবে এ ধনী হওয়াকে তিনি সবাই মিলে ধনী হওয়াই বুঝিয়েছেন। তাই চীনের বর্তমান জাতীয় লক্ষ্য হলো ২০৫০ সালের মধ্যে একটি মডারেটলি প্রস্পারাস নেশনে পরিণত হওয়া। পুঁজিবাদী সমাজে জাত পুঁজিপতিরা একটি ডায়নামিজম নিয়ে আসেন। এ গতি বা চলার শক্তি সমাজ বিকাশের জন্য অপরিহার্য। মরহুম নুরুল ইসলাম তার প্রাথমিক পুঁজি কীভাবে সংগ্রহ করেছিলেন তা আমার জানা নেই। যেভাবেই সে পুঁজি সংগৃহীত হয়ে থাক না কেন, তাকে তিনি চমৎকারভাবে ব্যবহার করেছেন। গড়ে তুলেছেন নানারকম শিল্প। বাংলাদেশের অভ্যুদয়কালে বাংলাদেশ ছিল শিল্পে অত্যন্ত অনগ্রসর একটি দেশ। টাকাপয়সা ব্যবসা-বাণিজ্যে ব্যবহার করা যায়, টাকাপয়সাওয়ালারা অনেকেই ভাবতেও পারতেন না এই টাকাপয়সা শিল্পকারখানা গড়ার জন্য ব্যয় করা যায়। অর্থাৎ তারা টাকা দিয়ে টাকা করতে চেয়েছেন। কিন্তু টাকা দিয়ে পণ্য তৈরির ঝুঁকি তারা নিতে চাননি। এ অনগ্রসর মনমানসিকতার জগতে নুরুল ইসলাম রীতিমতো একটি বিপ্লব ঘটিয়ে দেন নানারকমের শিল্পকারখানা গড়ে তুলে। অর্থাৎ তিনি কাগজের মুদ্রার রূপান্তর ঘটিয়ে বস্তুগত পণ্য তৈরি করার ঝুঁকি নিয়েছিলেন। মার্কিন অর্থনীতিবিদ ফ্র্যাংক নাইটের একটি বিখ্যাত গ্রন্থের শিরোনাম হলো ‘Risk, Uncertainty and Profit’. এই গ্রন্থে ফ্র্যাংক নাইট দেখিয়েছেন, পুঁজিবাদী অর্থনীতির অনিশ্চয়তার মধ্যে যুক্তিগ্রাহ্য ঝুঁকি নিতে পারলে মুনাফা আহরণ করা যায়। এ মুনাফা উত্তরোত্তর বিনিয়োগ করে পুঁজিবাদী অর্থনীতি সমৃদ্ধ থেকে সমৃদ্ধতর হয়। এটাকেই কাল মার্কস বলেছেন, বর্ধিত পুনরুৎপাদন। বর্ধিত পুনরুৎপাদন না থাকলে পুঁজিবাদ হয়ে পড়ত বদ্ধ জলাশয়ের মতো স্থবির ও উৎপাদন বৃদ্ধিহীন। মরহুম নুরুল ইসলাম একের পর এক শিল্পকারখানা গড়ে প্রমাণ করেছেন বাংলাদেশের মতো দেশেও বর্ধিত পুনরুৎপাদন সম্ভব। তিনি একের পর এক নতুন নতুন শিল্পকারখানা গড়েছেন। যেমন যমুনা ফ্যান, অ্যারোমেটিক সাবান, পেগাসাস কেডস, পেগাসাস মোটরসাইকেলের মতো জনপ্রিয় বাংলাদেশি ব্র্যান্ড তৈরি করেছেন তিনি। শুধু গার্মেন্টস বা ডেনিম নয়, উৎপাদনের নানা বৈচিত্র্য এনেছেন স্বপ্নবান এ মানুষটি। গ্রামের মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন ফ্রিজের মতো নানা প্রয়োজনীয় পণ্য। পণ্যের মানের ব্যাপারে তিনি ছিলেন আপসহীন। তিনি সবসময় ভাবতেন, পণ্যের গুণগত মানের কারণে যে পণ্য মানুষ একবার কিনবে, প্রয়োজনে সে আবারও সেই পণ্য কিনতে দ্বিধা করবে না।

হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক জোসেফ এ শুম্পিটারের নামে একশ্রেণির উদ্যোক্তা বা এন্ট্রাপ্রেনিউরের বৈশিষ্ট্য পুজিবাদী অর্থনীতি প্রসঙ্গে বিশেষভাবে আলোচিত হয়। তিনি বলেছেন, উদ্যোক্তাদের ড্রাইভ, ইনিশিয়েটিভ ও ঝুঁকি গ্রহণের চরিত্র না থাকলে তারা প্রকৃত অর্থে উদ্যোক্তা হতে পারেন না। মরহুম নুরুল ইসলাম মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে ঝুঁকি গ্রহণ করতে শিখেছিলেন। শিখেছিলেন ড্রাইভ ও ইনিশিয়েটিভের মতো গুণাবলির চর্চা। যুদ্ধের ময়দানে যেসব চারিত্রিক গুণাবলির উৎকর্ষসাধন তিনি করেছিলেন, সেগুলো অব্যাহত রাখেন শিল্পোদ্যোক্তা হিসাবে জীবনযুদ্ধে। তিনি কখনো ঋণখেলাপি হননি। যে দেশে ঋণখেলাপি হওয়াই বেশির ভাগ তথাকথিত শিল্পপতিদের অভ্যাস, সেখানে বিরল ব্যতিক্রম হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন নুরুল ইসলাম। তার প্রতিষ্ঠিত দৈনিক সংবাদপত্র যুগান্তর ঋণখেলাপ, দুর্নীতি ও অর্থ পাচারের বিরুদ্ধে ক্রামাগত সংগ্রাম করে যাচ্ছে। তার নিজের জীবনে এসব পাপাচারের কোনো ঠাঁই ছিল না। তাই নিজের প্রতিষ্ঠিত দৈনিক পত্রিকার মাধ্যমে তিনি গড়ে তুলতে পেরেছেন এমন এক সমাজসচেতনতা, যা এসব পাপাচারকে ঘৃণা করে। তিনি যমুনা টেলিভিশন প্রতিষ্ঠা করেছেন। এটি প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে তাকে বিরাট বাধা মোকাবিলা করতে হয়েছে। আর্থিক ক্ষতিও কম হয়নি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি জয়ী হয়েছেন এই প্রথম শ্রেণির স্যাটেলাইট টেলিভিশন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠায়।

এক নদী রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব যে কোনো মূল্যে রক্ষা করতে হবে। কিন্তু কারা এ স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে পারে-সেটি এক বিরাট প্রশ্ন। আমার দৃষ্টিতে মনে হয়, তিনটি শ্রেণি স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষার বর্ম হিসাবে কাজ করে। এ শ্রেণি ৩টি হলো-জাতীয় শিল্পোদ্যোক্তা, কৃষক ও শ্রমিক শ্রেণি। জাতীয় শিল্পোদ্যোক্তা স্বাধীনতা রক্ষায় দাঁড়াতে চাইবে তার বাজার রক্ষার জন্য। কৃষক স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষায় কাজ করবে তার জমি ও ফসল রক্ষার জন্য। শ্রমিক শ্রেণি স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করবে তার শ্রমের বাজার অটুট রাখার জন্য। মরহুম নুরুল ইসলামের জন্ম ও জীবন ধন্য হয়েছে দেশপ্রেমিক শ্রেণির কাতারভুক্ত হওয়ার ফলে। নুরুল ইসলাম ছিলেন একজন প্রকৃত দেশপ্রেমিক, পুঁজির সদ্ব্যবহার করার মানুষ।

ড. মাহবুব উল্লাহ : শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম