Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

কোথায় সেই নিঃস্বার্থ শিক্ষক?

Icon

ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী

প্রকাশ: ০৭ জুলাই ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

কোথায় সেই নিঃস্বার্থ শিক্ষক?

প্রতীকী ছবি

খুব অদ্ভুত আমাদের মানসিকতা। শিক্ষার্থী তো সবাই আমাদের। ওদের সবাইকে নিয়েই তো স্বপ্নটা দেখতে হবে। তা না হলে স্বপ্ন স্বপ্নের মতোই ভেসে যাবে। কূলও পাবে না, কিনারাও পাবে না। আসলে বৈষম্যহীন সমাজ গঠনের কথা বললেও আমাদের মনের ভেতরে যে বৈষম্য জন্ম নিয়েছে, তার শিকড়টা কি উপড়ে ফেলা এত সহজ? আমরা মেধার চেয়ে মুখস্থবিদ্যার মূল্য দেই বেশি, ভালো মানুষ হওয়ার চেয়ে ভালো ছাত্র হওয়ার দিকটাকেই বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। ভালো ছাত্র হওয়া আর মেধাবী হওয়া যে দুটো ভিন্ন বিষয়, সেই কঠিন সত্যটা আমরা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারি না।

মিথ্যা ভাবনার মোহের কাছে মনের ভাবনা বারবার হেরে যায় বলেই হয়তো এমনটা ঘটে। বিশ্ববিদ্যালয়ে রেজাল্ট ভালো না অথচ খুব মেধাবী, এমন অনেক ছাত্রের উজ্জ্বল মুখ আমরা হয়তো দেখি। তবে কতটা আমরা তাদের মূল্যায়ন করি? ওদের স্বপ্নগুলো গড়ে ওঠার আগেই ভেঙে দেওয়ার একটা ঔপনিবেশিক মনোভাব নিজেদের মধ্যে গড়ে তুলি। এমন অনেক ছাত্র আছে, যারা ভালো ছাত্র না, মেধাবীও না, তাদের মধ্যে হয়তো একটা ভালো মনের মানুষ থাকে। সে মনটাকে কতটাইবা আমরা বোঝার চেষ্টা করি? বরং মন গড়ার বদলে ভেঙে দেওয়ার দিকেই বেশি ঝুঁকে পড়ি। ছাত্রের চেয়েও তার বড় পরিচয় রক্ত-মাংসের মানুষ, সে মানুষটার জীবনের চেয়ে পরীক্ষার খাতায় মূল্য যেন অনেক বেশি।

খুব অদ্ভুত আমাদের মনস্তত্ত্ব। জিপিএ দিয়ে আমরা শিক্ষার্থীদের মধ্যে একটা বিভক্তিরেখা টেনে দেই। জিপিএ-৫ যেন সব, যাদের জিপিএ-৩ এর উপরে তাদের বড় বড় স্বপ্ন দেখাই, যাদের ৩-এর নিচে, তাদের নিজেদের আচার-আচরণে বুঝিয়ে দেই-তাদের দ্বারা কিছুই হবে না। অথচ ওই ৩-এর নিচের বা আরও পেছনের সারির শিক্ষার্থীরা যে লেখাপড়ার বাইরেও আরও অনেক নতুন নতুন পৃথিবী, নতুন নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি করতে পারত, তা আমাদের অযত্ন, অবহেলা, অপমানে মাথা তুলে দাঁড়ানোর আগেই ভেঙে পড়ে। আমরা ভুলে যাই, আমাদের শিক্ষায় মেধাকে মূল্যায়ন করার বদলে পরীক্ষার খাতার লেখাকে মূল্য দেওয়া হয়। মাত্র তিন ঘণ্টার একটা পরীক্ষায় আমরা ভালো-মন্দের বিচারক হয়ে যাই, জীবনের পরীক্ষা যে এর চেয়েও বড়, সেটা ভুলেই যাই।

একজন শিক্ষার্থীর অনেক গুণ নিয়েই যে শিক্ষা, সে শিক্ষা আমাদের কাছে অর্থহীন। শিক্ষাদানের মধ্যেই যেখানে শিক্ষার সীমারেখা অবরুদ্ধ, সেখানে নতুন জ্ঞান সৃষ্টির ভাবনার মূল্যইবা কতটুকু? খুব কষ্ট হয় যখন শিক্ষার্থীদের মুখগুলোয় অসহায়ত্ব ফুটে ওঠে, ওদের যন্ত্রণাগুলো ওদের যখন কুরে কুরে খায়, ওদের হাতগুলো যখন স্বপ্নের হাত খুঁজতে খুঁজতে ক্লান্ত হয়ে যায়। ওদের মাথায় হাত বুলিয়ে স্বপ্ন দেখানোর মানুষ খোঁজে ওরা। ওদের মনের ভেতরের পুঞ্জীভূত কথাগুলো কেউ খুব আগ্রহ নিয়ে শুনবে বলে ওরা অধীর হয়ে থাকে। কিন্তু সব যেন মরীচিকা। শিক্ষক এখন যন্ত্র, শিক্ষক এখন লোভী, শিক্ষক এখন স্বার্থপর। সবাই যে এমনটা তা-ও নয়, তারপরও একটা সংকট, একটা ক্রান্তিকাল। ভালো শিক্ষকদের এখন পিছু হটার দিন, স্বার্থপর শিক্ষকদের এখন জয়জয়কার। সমাজটাই যে এমন, পচন খেতে খেতে পচনটাকেই বেশি ভালোবাসে।

আমি খুব সাধারণ একজন শিক্ষক, হয়তো পৃথিবীর সবচেয়ে পেছনের সারিতে পড়ে থাকা একজন। নিজেকে শিক্ষক বলার চেয়ে ছাত্র বলাটাই সমীচীন হবে হয়তো। কারণ, প্রতিদিন আমি শেখার মধ্যে ডুবে থাকি। তবে নিজের আত্মসমালোচনা করতেও লজ্জা পাই না।

২.

খুব কষ্ট হয়, যখন শিক্ষার্থীদের অসহায় মুখগুলোর দিকে তাকাই। ওদের চোখে-মুখে স্বপ্ন জয়ের যে আশা, সেটা বোঝার মতো শিক্ষক এখন আর প্রায় নেই বললেই চলে। অথচ টিস্যু পেপারের মতো ওদের ব্যবহার করে স্বার্থ উদ্ধার শেষে ছুড়ে ফেলে দেওয়ার মতো শিক্ষকের অভাব নেই। শিক্ষার্থীদের কথা আর কী বলব। ওরা যখন ছাত্র থাকে, তখন সেটা বুঝতে পারে না, সাময়িক সুবিধা যে তার ব্যক্তিত্ব আর মেরুদণ্ড ইতোমধ্যে অনেকটা ভেঙে দিয়েছে সেটি বুঝতে পারে ডিগ্রি শেষ করার পর। তখন ভাঙা মেরুদণ্ড আর ব্যক্তিত্ব মেরামত করে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা যাবে কিনা সেটা বলা দুষ্কর। সবাই সত্যটা বুঝতে পারে, যখন বোঝে তখন অনেক দেরি হয়ে যায়। প্রাচীরে বন্দি শিক্ষকরা যে চিন্তাতেও অনেক ছোট হয়ে গেছে, সেটা তখন বোঝা যায় যখন তাদের সঙ্গে তুলনা করতে হয় খোলা আকাশের নিচে শিক্ষাদানকারী সক্রেটিস, প্লেটো, অ্যারিস্টটলের মতো বড় মনের শিক্ষকদের। আমাদের শিক্ষার্থীদের দুর্ভাগ্য, তারা এমন এক সময়ে জন্মেছে, যে সময়টাতে শিক্ষকদের কাছ থেকে জ্ঞান আহরণের চেয়ে রাজনীতি বেশি শিখতে হচ্ছে। সেটা গতানুগতিক রাজনীতি নয়, বরং সুতোয় বন্দি পুতুলের মতো নিয়ন্ত্রণের রাজনীতি, যেখানে ডানা মেলা পাখির মতো স্বপ্নগুলো খাঁচায় বন্দি হচ্ছে প্রতিদিন।

যদি তারা সক্রেটিস, প্লেটো, অ্যারিস্টটলের সময় জন্মাতো, তাহলে হয়তো তাদের মধ্য থেকে বেরিয়ে আসত একেকজন বিশ্ববিখ্যাত দার্শনিক। দুর্ভাগ্য আমাদেরও, শিক্ষক হতে হলে যে দার্শনিক হতে হয় সেটা বোধহয় আমরা ভুলতে বসেছি। এখন শিক্ষার্থীদের পড়াতে বইও লাগে না, গবেষণালব্ধ জ্ঞানও লাগে না, শিল্প-কারখানার বাস্তব অভিজ্ঞতাও লাগে না, মৌলিক চিন্তাও লাগে না। বই পড়ার মতো এত সময় কি আর শিক্ষকদের আছে? গুগল, ইয়াহুতে সার্চ দিলেই হাজার হাজার স্লাইড নিমিষেই হাতের নাগালে চলে আসছে। সেটাও দেখার সময় হয়তো অনেকের নেই। ক্লাস চলছে যন্ত্রের মতোই, সেখানে নতুন জ্ঞান সৃষ্টির কোনো ভাবনা নেই।

ওরা এখন আর কেবল বইয়ের ভেতর বন্দি হয়ে থাকতে চায় না, বরং সেখান থেকে বেরিয়ে এসে গবেষণায় নিজেদের সম্পৃক্ত করতে চায়। কিন্তু কে শেখাবে তাদের গবেষণা, কে কান পেতে শুনবে তাদের নতুন নতুন উদ্ভাবনের গল্প। এত সময় কি আর এ করপোরেট দুনিয়ার আছে? ওদের কাদামাটির মতো মন আবিষ্কারের নেশায় উন্মুখ হয়ে থাকে। ওরা পৃথিবীর সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিজেদের এগিয়ে নেওয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকে। কিন্তু সেই নিঃস্বার্থ শিক্ষক কি আর আছে? মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে শিক্ষার্থীদের জীবন বদলে দেওয়ার মতো শিক্ষক কি আর আছে? শিক্ষার্থীদের প্রতিদিনের নিজের সঙ্গে নিজের লড়াইটা দেখার মতো শিক্ষক কি আর আছে? ওদের সুখ-দুঃখের কথা শোনার মতো কেউ কি আর আছে? সবাই যে রোবট হয়ে গেছে। রোবট থেকে রোবটেরও জন্ম হয় না, মানুষেরও জন্ম হয় না। কিন্তু কে শুনবে কার কথা, সবাই যে নিজের জালে বন্দি, অথচ স্বাধীন মানুষ সাজার অভিনয়টাতে কেউ কারও চেয়ে কম নয়।

৩.

ছোটবেলায় একটা গল্প পড়েছিলাম। পুরোপুরি গল্পটা মনে নেই, তবে মূল কনসেপ্টটা মনে আছে। স্বাধীনতা মানে কী-বিষয়টি বোঝাতে গিয়ে গল্পটার অবতারণা করা হয়েছিল। গল্পটা অনেকটা এ রকম : মা তার ছেলের হাতে দুটো আম দিয়ে বললেন, আম দুটো তোমরা দুই ভাইবোন মিলে ভাগ করে নেবে। অর্থাৎ একটি আম তুমি খাবে, আরেকটি তোমার বোন খাবে। ছেলেটা আম দুটো হাতে নিয়ে দেখল একটি আম ভালো আছে, আরেকটি পচে গেছে। স্বভাবতই পৃথিবীর নিয়ম হচ্ছে ভালোটা নিজে রেখে খারাপটা অন্যের হাতে গছিয়ে দেওয়া। স্বার্থপর পৃথিবীতে এমনটাই ঘটার কথা।

সে যাই হোক, ছেলেটা কিছুক্ষণ ভাবল, তারপর পচা আমটা সে নিজে নিয়ে ভালো আমটা তার বোনকে খেতে দিল। ভালো আমটা খেতে খেতে বোনের মুখটা যখন হাসিতে ভরে উঠল, তখন ছেলেটা অনেক আনন্দ পেল। ভালো কাজ করতে পারার মধ্যে যে সুখ লুকিয়ে থাকে, ছেলেটা সেটি খুব গভীরভাবে অনুভব করতে পারল। এমন একটা মহৎ কাজ করতে পেরে ছেলেটার নিজেকে অনেক হালকা মনে হলো।

স্বাধীনতা সেটাই, যা আমাদের নিজের চেয়ে অন্যের ভালোর জন্য ভাবায়, নিজের স্বার্থের চেয়ে সামগ্রিক ও দেশের স্বার্থের জন্য কাজ করতে অনুপ্রেরণা জোগায়। স্বাধীনতা মানে ত্যাগ করতে শেখা, নিজের সর্বস্ব বিলিয়ে দিয়ে দেশপ্রেমের পরীক্ষায় পাশ করা।

আমরা সবাই স্বাধীনতা নিয়ে গর্ব করতে শিখি। স্বাধীনতার মধ্যে যে প্রকৃত সুখ নিহিত আছে তা হৃদয় দিয়ে অনুধাবন করি। স্বাধীনতা অনেক বড় বিষয়। সবসময় মনে রাখতে হবে, স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে স্বাধীনতা রক্ষা করা অনেক কঠিন।

ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী : অধ্যাপক, ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর

 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম