দেশপ্রেমের চশমা
দেশে সক্রিয় সুশীল সমাজের অভাব দেখা দিয়েছে
মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার
প্রকাশ: ০৭ জুলাই ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
প্রতীকী ছবি
সুশীল সমাজ জাতির বিবেক হিসাবে বিবেচিত। গণতান্ত্রিক বিশ্বের দেশে দেশে তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। অবদান রাখেন দেশের উন্নয়নে। সামাজিক স্থিতিশীলতা রক্ষায়। দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে। গণতন্ত্র বিকাশে। মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠায়। তারা সত্যের প্রশংসা ও মিথ্যার নিন্দা করতে কুণ্ঠিত হন না। তারা এসব ভালো কাজ করেন স্বাধীনভাবে মতামত প্রকাশের মাধ্যমে। সরকারকে পরামর্শদানের মাধ্যমে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিজের মতামত তুলে ধরার মাধ্যমে। প্রিন্ট মিডিয়ায় নির্ভীকভাবে লিখিত মতামত প্রকাশ করার মাধ্যমে। ইলেকট্রনিক গণমাধ্যমে অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার কণ্ঠে সাহসী প্রতিবাদের মাধ্যমে। তারা হতে পারেন বিভিন্ন পেশাজীবী। অভিজ্ঞ, সৎ, দক্ষ, মানবতাবাদী, গণতান্ত্রিক, দেশপ্রেমিক অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব হিসাবে তারা সমাজে প্রতিষ্ঠিত। তারা সাধারণ মানুষকে ভালোবাসেন। মানুষের উপকারের জন্য কাজ করেন। সরকার, বিরোধী দল বা অন্য যে কোনো পক্ষ অন্যায় আচরণ করলে এরা তার প্রতিবাদ করেন। সাদাকে সাদা এবং কালোকে কালো বলতে এরা ভয় পান না। দেশ ও জাতির ক্রান্তিলগ্নে এরা বিপদের কাণ্ডারি হিসাবে ভূমিকা পালন করেন। নাগরিক সমাজে এরা শ্রদ্ধেয় হিসাবে গণ্য। এ কারণে গণতান্ত্রিক বিশ্বে সুশীল সমাজের সদস্যরা রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা, সত্যাশ্রয়ী রাজনৈতিক সংস্কৃতি বিনির্মাণ ও চর্চা, মানবিক মূল্যবোধ সৃষ্টি, গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ এবং রাজনৈতিক ক্ষমতার নিয়মতান্ত্রিক পালাবদলের ধারাবাহিকতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকেন।
স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে সুশীল সমাজের কেউ কেউ সাহস করে সরকারি কাজের সমালোচনা করেছেন। অগণতান্ত্রিক কাজের সমালোচনা করেছেন। দুর্নীতির বিরোধিতা করেছেন। একদলীয় বাকশাল গঠনের বিরোধিতা করেছেন। একইভাবে এখনো তারা এ দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। তবে যে বিষয়টি উল্লেখ করার তা হলো, ক্রমান্বয়ে সুশীল সমাজের সদস্যদের চরিত্রে পরিবর্তন পরিলক্ষিত হচ্ছে। এদের অনেকে সাম্প্রতিককালে সুবিধাবাদী, আবার কেউ কেউ সুবিধাভোগীতে পরিণত হয়েছেন। সুশীল সমাজের কোনো সদস্য যদি দেশ ও দেশের মানুষের স্বার্থ তুলে ধরার নামে ব্যক্তিস্বার্থ হাসিলের চেষ্টা করেন, তাহলে তাকে সুশীল সমাজের সদস্য বলে অভিহিত করা যায় না। ওপরে ওপরে জনগণের কল্যাণে কাজ করার নামে নিজের ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিলের এজেন্ডা বাস্তবায়নে কাজ করা ব্যক্তিকে সুশীল সমাজের অন্তর্ভুক্ত করা যায় না। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের সময়কাল থেকে উদাহরণ দিয়ে বলা যায়, যে ভূমিকা প্রফেসর আবদুর রাজ্জাক বা আহমদ ছফা পালন করতে পেরেছিলেন, এখন কি তেমন সাহসী ব্যক্তিত্বের উদাহরণ দেওয়া যায়? পরবর্তীকালে ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন, ব্যারিস্টার রফিক-উল-হক, আকবর আলি খান, আসফউদ্দৌলা, নির্মল সেন, বদরুদ্দীন উমর, এমনকি এবিএম মূসারাও যেভাবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন, বর্তমান সময়ের শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, প্রশাসক ও রাজনীতিকরা কি তেমন ভূমিকা পালন করতে পারছেন?
সাম্প্রতিক সময়ে সুশীল সমাজের তকমাধারী অনেকের অবস্থাই ‘মুখে শেখ ফরিদ বগলে ইটে’র মতো। উপরে জনদরদি সেজে তাদের অনেকে সুশীল সমাজের পরিচয় ভাঙিয়ে ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিলে ব্যস্ত। নিজের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন না করে অনেকে জনগণের উপকারের জন্য সময় ব্যয় করেন। এটা এক রকম ভণ্ডামি। কারও নাম উল্লেখ না করে বলা যায়, মনে করুন আপনি একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক। আপনার প্রথম এবং প্রধান দায়িত্ব হলো ছাত্র পড়ানো। যত্নের সঙ্গে ক্লাস নেওয়া। আপনি যদি সে কাজ না করে দেশের বড় বড় সমস্যা নিয়ে ভাবেন, মতামত দেন, টকশো করেন, তাহলে তো বলতে হবে আপনি একজন ফাঁকিবাজ। মূল কাজে ফাঁকি দিয়ে আপনি হয়তো কোনো নিজস্ব এজেন্ডা বাস্তবায়নে অথবা পদ-পদবির জন্য সুশীল সমাজের সদস্য পরিচয়ে ভালোত্ব জাহিরের মাধ্যমে সে স্বার্থ হাসিলে চেষ্টা করছেন।
সুশীল সমাজের সদস্য হতে হলে প্রথমে দেশপ্রেমিক হতে হবে। নিজের দায়িত্বের জায়গায় নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে হবে। তারপর নিজ কর্মক্ষেত্রে কোনো অন্যায়-অবিচার যাতে না হয়, সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। অনিয়ম হলে তার প্রতিবাদ করে সেই অনিয়ম দূর করে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। নিজের পায়ের নিচে অন্ধকার রেখে, অর্থাৎ নিজ কর্মক্ষেত্রে দুর্নীতি-অনিয়মের প্রতিবাদ না করে ব্যক্তিস্বার্থ হাসিলের মনোবাসনা নিয়ে জাতীয় শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় মনোযোগী হওয়ার মতো ভণ্ডামি করলে তেমন ব্যক্তিকে সুশীল সমাজের সদস্য বলা যাবে না।
সবকিছুতে ভেজালের সঙ্গে এখন সুশীল সমাজের সদস্যদের মধ্যেও ভেজালের অনুপ্রবেশ ঘটেছে। সমাজে সুশীল সমাজের সদস্য পরিচয়ধারী নিজের ব্যক্তিগত সুবিধা অর্জনের এজেন্ডা বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে কাজ করে যাওয়া ব্যক্তির সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। এ কারণেই এখন আহমদ ছফা নেই। শিক্ষাবিদ হিসাবে নিঃস্বার্থভাবে দেশের স্বার্থ তুলে ধরে কথা বলার মতো শিক্ষাবিদ খুঁজে পাওয়া যায় না। ঘাটতি রয়েছে আসফউদ্দৌলা, ব্যারিস্টার রফিক-উল-হক ও আকবর আলি খানের মতো ব্যক্তিত্বের। তারা জনহিতকর কাজ করে মানুষের শ্রদ্ধা পেয়েছেন। সাদাকে সাদা আর কালোকে কালো বলতে ভয় পাননি। এখন তাদের মতো করে খুব কম ব্যক্তিত্বই কাজ করতে পারেন। খুব কমসংখ্যক ব্যক্তিত্বই সত্যের পক্ষে উচ্চারণ এবং মিথ্যার প্রতিবাদ করতে পারেন।
এখন বেড়েছে সুবিধাবাদী প্রশাসক, সুযোগসন্ধানী সাংবাদিক, সত্য প্রতিষ্ঠার ফরজ দায়িত্বপালনে ভীত ইমানি জজবাবিহীন আলিম ওলামা সম্প্রদায়ের নেতা, অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে কলম না ধরে প্রতিবাদী সাহিত্যের ধারাকে গোরস্থানে পাঠানো প্রেমপূজারি কবি-সাহিত্যিক, দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতিবিদ এবং প্রো-এস্টাবলিশমেন্ট প্রশাসক এবং প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা ও কর্মচারী। এদের অনেকের অন্তরে অদৃশ্যভাবে সরকারদলীয় পক্ষাবলম্বন থাকলেও বাহ্যিকভাবে এরা নিরপেক্ষতার লেবাস ধারণ করে নিজ স্বার্থসিদ্ধির লক্ষ্যে কাজ করেন। ক্ষমতাসীন দল এদের ব্যবহার করে এদের মাঝে সুযোগ-সুবিধা বিতরণ করে নিজ ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার সুযোগ পায়। এভাবে সরকারের কৃপাদৃষ্টি লাভ করে সুশীল সমাজের এসব সদস্য গাড়ি-বাড়ি করেন। বিদেশি ব্যাংকে টাকা জমান। বড় বড় সরকারি কাজের ওয়ার্ক অর্ডার পান। কেউ কেউ নিজের জন্য পদ-পদবি খুঁজে নেন। এদের অনেকে ছেলেমেয়েদের বিদেশে লেখাপড়া করান।
সুশীল সমাজের এমন সব সদস্যেরই আবার সরকার বেকায়দায় পড়লে বা ক্ষমতাচ্যুত হলে চোখ উলটাতে মোটেও সময় লাগে না। রাজনৈতিক অঙ্ক কষে এরা নিজেদের মতাদর্শ পরিবর্তন করতে খুব একটা সময় নেন না। লেখার ধরন ও বলার ভঙ্গিমা বদলাতে এরা যথেষ্ট দক্ষ। তবে তার আগেই আবহাওয়াবিদদের মতো লক্ষণ বিবেচনা করে এরা রাজনীতির হাওয়া বদলের আভাস পেলে নিজেদের সক্রিয়তা কমিয়ে নীরব হয়ে যান। বর্তমান সময়কালকে কেউ কেউ এমন সময় বললে অত্যুক্তি হবে কি? নাম ধরে উদাহরণ দেওয়া যায়। কিন্তু আমাদের লক্ষ্য কাউকে নাম ধরে অসম্মান করা নয়। নাম উল্লেখ না করে বলছি, বেশ কয়েকজন বুদ্ধিজীবী, যারা সরকারের নীতির পক্ষে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ঘন ঘন কলাম লিখতেন, কিন্তু এখন তারা অনেকটাই নীরব। তাদের কলাম খুব একটা চোখে পড়ে না। আবার এদের মধ্যে এমনও সরকারসমর্থক লেখক আছেন, যাদের কলাম একই দিন বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত হতো। এখন কদাচিৎ তাদের কলাম চোখে পড়ে। তারা অনেকটাই নীরব। ইলেকট্রনিক গণমাধ্যমের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা দেখা যায়। রাতের অনেক জনপ্রিয় টিভি টকশোগুলোয় অনেকেই ধীরে ধীরে তাদের সরকারের প্রতি সমর্থনের ভঙ্গিমাকে নরম করে আনছেন বলে কারও কারও সতর্ক দৃষ্টিতে প্রতীয়মান হচ্ছে।
বলার অপেক্ষা রাখে না, সুশীল সমাজ একটি দেশে ন্যায়ভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণ ও গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের পথ সহজ করে। দেশ পরিচালনায় ক্ষমতাসীন সরকারকে সুপরামর্শ দিয়ে সহায়তা করে। নিজ নিজ অবস্থানে থেকে তারা এ কাজ করে থাকেন। অন্যায়ের প্রতিবাদী হিসাবে, দুর্নীতির সমালোচনাকারী হিসাবে, সত্য ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার কাজে জড়িত হয়ে তারা সমাজে ইতিবাচক ও গণতান্ত্রিক পরিবর্তনের সূচনা করেন। প্রকৃত সুশীল সমাজের অনুপস্থিতি অথবা ভণ্ড সুশীল সমাজের উপস্থিতি শাসকদলকে স্বৈরতান্ত্রিক ভূমিকা গ্রহণ করে দেশ পরিচালনার সুযোগ করে দেয়। এর ফলে বিরোধীদলীয় কার্যকলাপ ব্যাহত হয়। সুশীল সমাজ সক্রিয় থাকলে গণতান্ত্রিক সরকার স্বৈরতান্ত্রিক পন্থায় দেশ পরিচালনা করতে বাধাগ্রস্ত হয়। এজন্য প্রতিটি গণতান্ত্রিক দেশে সক্রিয় সুশীল সমাজ থাকা উচিত। এমন সুশীল সমাজ থাকা উচিত, যে সমাজের সদস্যরা নিজের ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করার পরিবর্তে জনগণ, দেশ ও গণতন্ত্রের স্বার্থে কথা বলার মতো সৎসাহস রাখেন। নিজের আখের গোছাতে তাদের অবস্থানকে ব্যবহার করেন না। সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে তাদের মতাদর্শ পরিবর্তিত হয়ে যায় না। এ দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করে বলা যায়, বাংলাদেশের সুশীল সমাজ যুগপৎ জনগণ এবং ধারাবাহিক গণতান্ত্রিক উন্নয়নের লক্ষ্যে কাজ করছে বলে প্রতীয়মান হয় না। এ দেশের সুশীল সমাজের সদস্যদের অনেকে বণিকবৃত্তি ও সুবিধাবাদ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে পড়েছেন। আর এ কথা সুবিদিত, দেশের সুশীল সমাজ যদি সুবিধাবাদ দ্বারা প্রভাবিত আর ষড়যন্ত্রের অংশ হয়, তাহলে ওই দেশে গণতন্ত্র ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা এবং তা টেকসই করার প্রক্রিয়া বিলম্বিত হয়। এজন্য দেশের সার্বিক গণতন্ত্রায়ন, টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠায় একটি দেশপ্রেমিক, নির্ভীক ও সক্রিয় সুশীল সমাজ থাকা জরুরি।
ড. মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার : অধ্যাপক (এলপিআর), রাজনীতিবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
akhtermy@gmail.com