কুরবানির ঈদকেন্দ্রিক পশুপালন দারিদ্র্যবিমোচনে অবদান রাখুক
সালাহ্উদ্দিন নাগরী
প্রকাশ: ২৪ জুন ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
করোনা মহামারিসহ বিভিন্ন কারণে বিগত ৩ বছর ঈদের পশু কেনাবেচা কম হয়েছে। কিন্তু প্রায় প্রতিবছর কুরবানিযোগ্য পশুর সংখ্যা বাড়ছে। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, এ বছর কুরবানিযোগ্য পশুর সংখ্যা ১ কোটি ২৫ লাখ ৩৬ হাজার ৩৩৩টি। দেশের ঢাকা ও চট্টগ্রাম নগরীতে যেমন সবচেয়ে বেশি মানুষের বসবাস, ঠিক তেমনি সেখানে বিলাসী ও সামর্থ্যবান মানুষের সংখ্যাও অনেক। তাই কুরবানির গরু ও অন্যান্য পশু এ শহর দুটিতে বিক্রিও হয় বেশি। সংগত কারণেই উত্তরবঙ্গের বেপারি ও খামারিরা ট্রাকে করে গরু নিয়ে বেশি লাভের আশায় এ দুই শহরেই আগে ছুটে আসেন।
করোনাকালের আগে হাটগুলো যেভাবে সরগরম ও ক্রেতা-বিক্রেতার পদচারণায় মুখরিত হয়ে উঠত, বিগত বছরগুলোতে তেমনটি হয়নি। ওই সময়ে ঈদের দিন সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করেও বিক্রি না হওয়ায় শত শত ট্রাক, পিকআপে হাজার হাজার গরু উত্তরবঙ্গে ফিরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। ব্যাপারিদের মতে, উত্তরবঙ্গ থেকে আসা গরুর অর্ধেকও বিক্রি হয়নি, তাদের লোকসান গুনে বাড়ি ফিরতে হয়েছিল। যাক, বিগত বছরগুলোর হতাশা কাটিয়ে পশু বিক্রেতারা এবার আশায় বুক বাঁধছেন। আর সেজন্য সরকারও জনগণের ঈদকেন্দ্রিক বিভিন্ন সুবিধা বৃদ্ধির চেষ্টা করে যাচ্ছে।
ঈদে কুরবানির পশু কেনাবেচার সময় বড় বড় লেনদেন হয়। হাটে স্বাভাবিক কারণেই ভিড়ের মধ্যে মানুষ ক্যাশ টাকা বহনে কিছুটা চিন্তিত থাকে। জনগণের এ চিন্তা লাঘবে বাংলাদেশ ব্যাংক ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৯টি হাটে ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ২টি হাটে ক্যাশলেস লেনদেন চালুর উদ্যোগ নিয়েছে। এখানে ডেবিট/ক্রেডিট কার্ড ও মোবাইল ফোনের মাধ্যমে লেনদেন করা যাবে।
একইভাবে ঢাকার বাইরেও ২৬টি জেলায় ডিজিটাল ব্যাংকিং সুবিধা পাওয়া যাবে। আগে কুরবানির পশু সাধারণত হাটে বিক্রি করা হতো। তবে এখন হাটে আনার পথে এবং বাড়িতেও বিক্রি করা যাবে, অর্থাৎ যে যেখানে বিক্রি করতে চায়। ক্রেতা-বিক্রেতা যেন নিজেদের পছন্দের পশু উপযুক্ত দামে কেনাবেচা করতে পারেন সেজন্য এ সিদ্ধান্ত। কিন্তু রাস্তায় বাজার বসিয়ে চলাচলের বাধা সৃষ্টি করা যাবে না। মহামারির সময় থেকে সরাসরি হাটের পাশাপাশি অনলাইন ও খামার থেকেও পশু কেনাবেচা বেড়েছে। শহরের অনেক বাসিন্দা তো হাটে যাওয়ার চাইতে খামারিদের কাছ থেকে কেনাই পছন্দ করছেন।
বিগত বছরগুলোর ঈদে বড় আকারের গরু খুব একটা বিক্রি হয়নি। বড় জাতের একেকটি গরুর পেছনে প্রতিদিন দু’আড়াই হাজার টাকা খরচ হয়। তাদের আপেল, কমলা, মাল্টা থেকে শুরু করে দামি দামি সব খাবার খাওয়াতে হয়। তাদের আবাসস্থল ছিমছাম ও পরিপাটি এবং গরম থেকে রক্ষার জন্য সিলিং বা স্ট্যান্ড ফ্যানের ব্যবস্থা রাখতে হয়। অসুখ-বিসুখে ভেটেরিনারি চিকিৎসকসহ সারা বছর প্রাণিসম্পদ অফিসের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতে হয়।
মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্য সচেতনতা বাড়ছে, ‘রেডমিট’ ও চর্বিযুক্ত মাংস পারতপক্ষে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করছেন। তাই পছন্দের তালিকায় বড় গরু পেছনে পড়ে যাচ্ছে। একইভাবে কৃত্রিম উপায়ে স্বল্প সময়ে বড় করা গরুর প্রতি মানুষের ধারণা খুব একটা ইতিবাচক নয়। তারা মনে করেন, বিভিন্ন ধরনের ওষুধ প্রয়োগ করে এবং রাসায়নিক দ্রব্য খাইয়ে বড় করা গরুগুলো মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়াচ্ছে। তাই বড় গরু বিক্রি কম হওয়ার পেছনে এ কারণগুলোর ভূমিকা থাকতে পারে।
বাণিজ্যিক ভিত্তিতে, পদ্ধতিগতভাবে গবাদিপশু লালন-পালনের কার্যক্রম আমাদের দেশে কিন্তু খুব একটা পুরোনো নয়। ২০১৪ সালের আগে পর্যন্ত পার্শ্ববর্তী দেশের গরুর ওপর আমাদের ব্যাপক নির্ভরতা তো ছিলই, তাছাড়া বাইরের গরু ব্যতীত কুরবানির ঈদ পার করা এক প্রকার অসম্ভব ব্যাপার ছিল। আর সেজন্য আমাদের সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে গরু বেচাকেনার বাজার ও খাটালগুলো সারা বছর সরগরম থাকত। ওই সময়ে বাইরের দেশ থেকে কুরবানির ঈদের আগে ২০-২২ লাখ গরু-ছাগল আসত এবং সারা বছরে এ সংখ্যা ৩০ লাখ অতিক্রম করত।
পরবর্তী সময়ে গরু আসা বন্ধ হয়ে গেলে অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটানোর লক্ষ্যে আমাদের দেশে ব্যাপকভিত্তিক গরু লালন-পালন শুরু হলে এখাতে নাটকীয় ইতিবাচক পরিবর্তন সূচিত হয়। গৃহস্থালি পর্যায়ে গরু, ছাগল পালন-পালন ছাড়াও আমাদেরও দেশে কয়েক বছরের ব্যবধানে লাখ লাখ খামার গড়ে ওঠে। গবাদি পশু উৎপাদনে সয়ম্ভরতা অর্জিত হয়েছে, অনেক মানুষ এ সেক্টরে যুক্ত হচ্ছে। তাই ভারত থেকে যেন দেশে গরু না আসে সে বিষয়ে সরকারকে পদক্ষেপ নিতে বলেছেন খামারিরা, না হলে দেশি গরুর বাজার পড়ে যাবে। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর ও সীমান্তবর্তী জেলাগুলোয় প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা খামারিদের আশ্বস্ত করেছেন যে, বাইরে থেকে কোনো গরু দেশে আসবে না।
প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রধান গবেষণা কর্মকর্তা বলেন, ‘দেড় থেকে আড়াই বছরের গরুকে ৩-৫ মাস বিশেষ খাদ্য ব্যবস্থাপনায় মোটাতাজা করার বিজ্ঞানসম্মত এ ব্যবস্থাটি আমাদের দেশে গ্রহণের আগে অযত্ন-অবহেলায় গরু লালন-পালন করা হতো। কিন্তু পরবর্তী সময়ে মোটাতাজা করার প্রযুক্তি ছড়িয়ে পড়লে এ খাতে প্রচুর উদ্যোক্তা তৈরি হয়।’ সাধারণ ব্যাপারিদের দুই, চার, পাঁচ, দশটি গরু নিয়ে আর বড় বড় উদ্যোক্তার খামার তৈরি করে শুরু হয় গবাদি পশুতে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের নতুন উদ্যোগ। বাইরে থেকে গরু আশা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় প্রকারান্তরে আমাদের দেশের জন্য ভালোই হয়েছে।
উদ্যোক্তা তৈরি হয়েছে, তাদের মাথায় নতুন নতুন ধারণা আসছে, আর সেজন্যই গরু-ছাগল ছাড়াও আমাদের দেশে ভেড়া, দুম্বা, গাড়লের খামার গড়ে উঠছে। এ খামারগুলোকে কেন্দ্র করে আরও নানা ধরনের সহায়ক ব্যবসা ও কার্যক্রম শুরু হয়েছে। বহু লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে। আর এর প্রভাবে আমাদের দেশের গ্রামীণ অর্থনীতিও চাঙা হয়ে উঠছে। পত্রিকায় দেখলাম, টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার উপজেলার নারী উদ্যোক্তা হামিদা আক্তার ৫২ মন ওজনের গরু নিয়ে এবার বাজারে আসছেন। দাম চাইছেন ১৫ লাখ টাকা। এটি বিক্রি করে বড় পরিসরে খামার তৈরির স্বপ্ন দেখছেন এ নারী উদ্যোক্তা। পড়ালেখার পাশাপাশি বাড়িতেই একটি মুদি দোকান করছেন। সেখানে ফ্লেক্সিলোড, বিকাশ লেনদেন ও দর্জির কাজ করেন। তার উপার্জনের একটি বড় অংশই তিনি ব্যয় করছেন এ কুরবানির পশুর পেছনে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দারিদ্র্যবিমোচনের সম্ভাব্য যত পথ আছে তার মধ্যে গবাদি পশু পালন অন্যতম। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের জনৈক অধ্যাপকের গ্রামীণ অর্থনীতি ও ঈদুল আজহায় পশু বিক্রিসংক্রান্ত গবেষণায় বলা হচ্ছে, গবাদি পশু বিক্রি গ্রামের অধিকাংশ মানুষের হাতে নগদ টাকার উৎস হিসাবে বিবেচিত হয়। এর মাধ্যমে একটি পরিবারের সারা বছরের নগদ টাকার চাহিদার একটা অংশ পূরণ হয়ে থাকে।
ব্যাপারি ও খামারিরা দুটো পয়সা লাভের আশায় ঋণ নিয়ে গরু লালন-পালন করেন। আর তাদের টার্গেট থাকে কুরবানি ঈদ, কিন্তু সে আশার গুড়ে যখন বালি পড়ে, তখন এ কষ্ট সহ্য করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। তাই তাদের সাহায্য করার জন্য সরকারের তরফ থেকে ন্যায্য দামে সেসব গরু ক্রয় করে সে মাংস বিদেশে রপ্তানির উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। এতে তারা যেমন লোকসানের হাত থেকে রক্ষা পাবেন, একই সঙ্গে রপ্তানির এ খাত অর্থনীতিকেও কিছুটা মজবুত করবে। বড় গরু লালন-পালন করতে ব্যাপারি ও গৃহস্থকে অনেক ঝুঁকি পোহাতে ও অর্থ খরচ করতে হয়।
তাই কুরবানির হাট থেকে ফেরত এনে পরবর্তী ঈদ পর্যন্ত এক বছর অপেক্ষা করা তাদের জন্য হতাশা ও অনিশ্চয়তার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। নৈমিত্তিক হাটে যথোপযুক্ত দামে এগুলো বিক্রিও করা যায় না। তারা তো কিছু লাভের আশায় এগুলো বড় করে। তাই উৎপাদনবান্ধব বাজার প্রবর্তন এবং যে আকার ও প্রকারের গরুর চাহিদা বেশি সে ধরনের গরু পালনে তাদের পরামর্শ দিতে হবে ।
গবাদি পশু, বিশেষত কুরবানির গরু ও অন্যান্য প্রাণী পরিবহণের সার্বিক ব্যবস্থা খুব একটা সন্তোষজনক নয়। গাদাগাদি করে তাদের ট্রাক, মিনি-ট্রাকে তোলা হয়। ট্রাফিক জ্যামের কারণে ওই অবস্থায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে থাকতে হয়। প্রখর রোদ ও বৃষ্টির মধ্যে অনেক সময় দীর্ঘ পথ হাঁটিয়েও আনা হয়। এরপর হাটেও তাদের রাখার ব্যবস্থা ভালো নয়। অনেক গরু অসুস্থ হয়ে পড়ে, গরমে হাঁসফাঁস করতে করতে মারাও যায়। তাই পশু পরিবহণ ও হাটে থাকার ব্যবস্থা মানসম্পন্ন পর্যায়ে উন্নীত করতে হবে। পশু মৃত্যুজনিত মালিকের ক্ষতি লাঘবে এসব পশুকে ইন্স্যুরেন্সের আওতায় আনতে হবে। প্রাইভেট ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিগুলোর এ ব্যাপারে গৃহীত কার্যক্রমকে আরও প্রসারিত, বেগবান ও ত্বরান্বিত করতে হবে।
সচ্ছলতার আশায় বেশিরভাগ উদ্যোক্তা ঋণ নিয়ে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে গবাদি পশু লালন-পালন করছেন। ঈদে অবিক্রীত কোনো পশুর বিপরীতে যদি কারও কোনো ঋণ থাকে, তবে সে ঋণ এমনভাবে পুনর্বিন্যাস করতে হবে যেন গৃহস্থ, ব্যাপারি বা খামারি কাউকেই কঠিন পরিস্থিতিতে পড়তে না হয়।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার প্রকাশিত তথ্যমতে, ২০২০ সালে গরু পালনে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১২ নম্বরে এবং লালন-পালনকৃত গরুর সংখ্যা ছিল ২ কোটি ৪০ লাখ। এখনো আমাদের দেশের অবস্থান ওপরের দিকেই। ব্যাপক সম্ভাবনাময় এ খাতটিতে আমাদের মনোযোগ ও প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে, নতুন ও গ্রামীণ উদ্যোক্তাদের প্রতি সহায়তার হাত আরও প্রসারিত করতে পারলে আমরাও হয়তো একদিন গবাদি পশু উৎপাদনে শীর্ষস্থানটি দখল করতে পারব।
সালাহ্উদ্দিন নাগরী : সরকারি চাকরিজীবী
snagari2012@gmail.com