Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

সমাজে সাম্প্রতিক কিছু প্রবণতা

Icon

ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী

প্রকাশ: ১৪ জুন ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

সমাজে সাম্প্রতিক কিছু প্রবণতা

খুব অদ্ভুত একটা বিষয়। মিথ্যাকে সত্যের মতো করে বলা যায়, মিথ্যাকে সত্য বানাতে প্রমাণের পর প্রমাণ তৈরি করা যায়, সত্যকে মিথ্যা দিয়ে ঢেকে ফেলা যায়। সবচেয়ে নির্মম বাস্তবতা হলো-সাধারণ মানুষ মিথ্যাকে সত্য বলে যতটা সহজে বিশ্বাস করে নেয়, সত্যকে সত্য বলে ততটা সহজে মানতে পারে না। সত্যের কোনো প্রমাণ থাকে না, সত্য যে সত্যই, সেই সত্যকে প্রমাণ করা খুব কঠিন।

মনস্তত্ত্ব হলো, মানুষ মিথ্যা বলতে পারে, কারণ মিথ্যা বলতে সাহস লাগে না, সত্য বলতে সাহস লাগে। মানুষ সাহসী হওয়ার চেয়ে কাপুরুষ হতে ভালোবাসে। সাহসী হলে অনেক কিছু হারাতে হয়, কাপুরুষ হলে মানুষের যা পাওয়ার কথা নয় তা পেয়ে যায়।

সত্য প্রায় সব সময় মিথ্যার কাছে অসহায় হয়, বিব্রত হয়, পরাভূত হয়। মিথ্যা যা ঘটেনি তা ঘটাতে পারে, সত্য যেটা ঘটে যায় সেটা ফিরিয়ে আনতে পারে না। এমন করেই অনেক সত্য মিথ্যা হয়ে যায়, অনেক মিথ্যা সত্য হয়ে যায়। পৃথিবী তার নিয়মেই চলে, হয়তো পৃথিবীর মানুষ কোনোদিনও জানতে পারে না-সত্যটা মিথ্যার কাছে কোণঠাসা হতে হতে একদিন মিথ্যাকেই সত্য বলে প্রতিষ্ঠিত করেছিল।

সত্য বলতে গিয়ে মানুষকে যতটা প্রতিকূল পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়, মিথ্যাকে আশ্রয় করে মানুষ ততটাই নিজের জন্য অনুকূল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে। মিথ্যা মানুষের মাথায় আদরের হাত বুলিয়ে আপন করে তার দিকে টানতে পারে, মায়াজাল সৃষ্টি করে লোভ দেখাতে পারে। সত্যের সমস্যা হলো, সত্য আপন-পর, শত্রু-মিত্র বোঝে না, সত্য সত্যের মতো জ্বলে উঠতে গিয়ে আপনজন হারায়, বন্ধু হারায়, নিজের অজ্ঞাতে শত্রু বাড়ায়।

মিথ্যাও এক ধরনের আর্ট। যে মানুষ সেই আর্টকে যতটা ব্যবহার করতে পারে, সে সমাজের চোখে তত বড় মানুষ হয়ে উঠতে পারে। যে মানুষ নিজের ভেতরে যা জমিয়ে রেখেছে, বাইরে ঠিক তার বিপরীত মনোভাব পোষণ করছে-তার গ্রহণযোগ্যতা সমাজে অনেক বেশি থাকে। কারণ মিথ্যা অভিনয় করতে পারে, সত্য অভিনয় করতে পারে না। সত্যে বাস্তবতা খুব কঠিন হয় বলে মানুষ সত্যকে এড়িয়ে গিয়ে মিথ্যার মোহে পড়ে যায়। মিথ্যা একটা মোহ, যে মোহের ভেতর মানুষকে ডোবানো সহজ। মানুষ যত সেই মোহে ডুবতে থাকে, সত্য ততই মানুষের ভেতর থেকে বিতাড়িত হতে থাকে।

সত্যের পক্ষে মানুষ খুব কম থাকে, মিথ্যার পক্ষে জনস্রোত থাকে। প্রতিদিন সত্যকে মিথ্যার কাছে হারতে হচ্ছে। তারপরও সমাজের মানুষ মিথ্যাকে সত্য বলে মনে মনে মেনে নিয়ে আত্মতৃপ্তিতে ভুগছে। সবার ভেতর থেকে সত্য নির্বাসিত হলেই এমনটা ঘটার কথা। তার মানে কী? সবাই কি ছোট-বড় মিথ্যার জালে জড়িয়ে পড়েছে? সবার ভেতরেই কি দুধরনের বিপরীতমুখী মানুষ তৈরি হয়েছে? সবাই কি ব্যক্তি ও গোষ্ঠী স্বার্থকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে মিথ্যাকে নিজেদের জয়ের অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করছে? মিথ্যার বন্দনা করতে আসিনি, মিথ্যাকে চেনাতে এসেছি। মিথ্যাকে চেনাতে এসে সত্যকে নগ্ন করেছি। কাচের টুকরোর ওপর পা ফেলে ফেলে মুখে মিথ্যার হাসি ধরে রেখে সত্যের কষ্টটাকে একবারের মতো হলেও মানুষের ভেতর জাগ্রত করতে এসেছি।

সবাইকে বলব, বিষয়গুলো নিয়ে ভাবতে। কারণ মিথ্যার পরিধি বাড়তে বাড়তে তা যদি সমুদ্র হয়ে যায়, সে সমুদ্রে ডুবতে প্রথম প্রথম অনেক ভালো লাগতে পারে, নিজেকে হিরো হিরো মনে হতে পারে; কিন্তু সেটা যদি হাবুডুবু খাওয়া হয় কিংবা এমনভাবে মানুষকে ডুবিয়ে ফেলে যে সেখান থেকে আর ফিরে আসা যায় না, তাহলে একদিন মানুষেরই অস্তিত্ব হারিয়ে যাবে, ভবিষ্যৎ প্রজত্মকে হাতে হারিকেন ধরিয়ে দেওয়া হবে। যে হারিকেন ততক্ষণ আলো জ্বালানোর লড়াই করতে পারবে, যতক্ষণ সেখানে কেরোসিন নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে পারবে।

২.

একটা খুব মূল্যবান কথা পেলাম-দেশে পাশের হার বেড়েছে, তবে শিক্ষিতের হার কমেছে। দেশের প্রখ্যাত কবি আসাদ চৌধুরী এমনটাই বলছেন। কথাটা অদ্ভুত হলেও খুব মূল্যবান, খুব ভারী-যেটার ভার হয়তো অনেকেই বহন করার মতো ক্ষমতা রাখে না। এ ভার বহন করতে হলে মাথাকে বহন করার মতো দেহে শক্তি থাকতে হয়। দেহের শক্তিকে চিনতে হলে মাথার শক্তিকে আগে চিনতে হয়। পেশিশক্তি দেহে থাকে, মেধাশক্তি মাথায় থাকে। মাথার শক্তির চেয়ে দেহের শক্তিকে প্রাধান্য দিলে মানুষ এমনভাবে ভেঙে পড়ে যে সেখান থেকে আর কখনো মেরুদণ্ড শক্ত করে উঠে দাঁড়ানো যায় না। মেধাচর্চা করলে মাথা উর্বর হয়, পেশিশক্তির চর্চা করলে মাথা অনুর্বর হয়। পেশির চর্চা পাশের হার বাড়ায়, মেধার চর্চা প্রকৃত শিক্ষার হার বাড়ায়। তবে মেধার সঙ্গে মানুষটাকেও থাকতে হয়, মনুষ্যত্বও থাকতে হয়, নিজেকে চেনার মতো জ্ঞানও থাকতে হয়।

কাগজের একটা সার্টিফিকেট, কতটুকুইবা মূল্য তার, অথচ সেটা পাওয়ার লোভে মানুষ পরীক্ষায় পর পরীক্ষায় বসে। উদ্দেশ্য একটাই-পরীক্ষায় পাশ করে সিঁড়ির পর সিঁড়ি অতিক্রম করে এলিট শ্রেণির মানুষ হিসাবে নিজেকে প্রমাণ করা। এ সমাজে যার যত বেশি সার্টিফিকেট, সে তত বেশি মূল্যবান। পাশ করলেই শিক্ষিত হওয়া যায় না, শিক্ষিত হতে হলে জ্ঞানের গভীরে প্রবেশ করতে হয়। সেখান থেকে জ্ঞানের আনন্দকে বের করে এনে মনুষ্যত্বকে বিশুদ্ধ করতে হয়। সার্টিফিকেট পুড়িয়ে ফেলার এক ধরনের নেতিবাচক প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে, যা কখনোই কল্যাণকর হতে পারে না। মানুষ জ্ঞানের চেয়ে সার্টিফিকেটকে মূল্য দেওয়ার কারণেই এমনটা ঘটছে। যার ভেতরে জ্ঞান আছে, তার ভেতরে আত্মবিশ্বাস আছে। এ আত্মবিশ্বাস তাকে জানিয়ে দিতে পারে, জীবন ধারণের জন্য চাকরি একমাত্র উপায় নয়, বরং অনেক উপায়ের মধ্যে একটি।

যে শিক্ষায় মানুষ নেই, সে শিক্ষা অর্থহীন। অথচ সেটা কতটুকুইবা মানুষ বুঝতে পারে। মানুষ যতই নিজেকে বড় ভাবতে থাকে, ততই সে তরতরিয়ে নিচে নামতে থাকে। অথচ সেই নিচে নামাটাকে মানুষ উপরে উঠছে ভেবে ভুল করে বসে। বড় বড় বই মুখস্থ করে মানুষ মাথার ভেতরে নকলের বোঝাটা চাপিয়ে নেয়, তারপর পরীক্ষার খাতায় সেগুলো উগলে দেয়। কী আছে এ শিক্ষার, যেখানে জ্ঞানের চেয়ে জ্ঞানের মৃত্যু বেশি ঘটে? পাসের শিক্ষা ভোগবাদী মানুষ তৈরি করে, যেটা মানুষের ভেতরের মানুষটাকে বের করে দিয়ে সেখানে দানবের জত্ম দেয়। তার কাছে পৃথিবীর সবকিছুই পণ্য, যেগুলো টাকা দিয়ে কেনা যায়। পাশের শিক্ষায় মানুষ টাকা দিয়ে মানুষ কেনে, টাকা দিয়ে ক্ষমতা কিনে, টাকা দিয়ে টাকা বানায়। মানবিক মূল্যবোধের সেখানে কোনো মূল্য নেই।

যারা ফেল করে, মানুষ তাদের স্বপ্ন গড়ার বদলে স্বপ্ন ভেঙে দিতে হায়েনার মতো চারপাশ থেকে আক্রমণ করে। কতটা বুঝতে পারে মানুষ তাদের। এতটুকুও নয়, যতটুকু হওয়া উচিত ছিল। যদি জ্ঞান আহরণ করতে গিয়ে ফেল করতে হয়, তাহলে সে জ্ঞান অমূল্য। যদি জ্ঞানের মাধ্যমে নিজের ভেতরের মানুষটাকে চিনতে গিয়ে ফেল করতে হয়, তাহলে সে জ্ঞান মহাসম্পদ। যদি জ্ঞান আহরণের মাধ্যমে মানবিক গুণাবলির উন্মেষ ঘটাতে গিয়ে ফেল করতে হয়, তাহলে সে জ্ঞান অমৃত সমান।

আমাদের শিক্ষা পাশ-ফেলের শিক্ষার মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছে, সেখানে শিক্ষার মাধ্যমে জ্ঞান অর্জন ও মানুষ হওয়ার মতো উদার দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হচ্ছে না। পাশের সংখ্যা যত বাড়ছে, শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা তাই ততই কমছে। তারপরও যেটা মুখ হাঁ করে ঝুলে থাকছে, সেটা কী, কেন ঘটছে, কীভাবে ঘটছে, কার কারণে ঘটছে, কখন ঘটছে, কতটা ঘটছে-এত চিন্তা করার সময় কি আর মানুষের আছে? সবাই যে বিক্রি হয়ে গেছে। আর একবার বিক্রি হলে বিক্রীত পণ্য কখনো ফেরত নেওয়া হয় না।

৩.

খুব অদ্ভুত মিল ছিল জন কিটস ও সুকান্ত ভট্টাচার্যের মধ্যে। দুজনেই ক্ষণজত্মা কবি ছিলেন। দুজনেই যক্ষ্মায় ভুগে মারা গেছেন। সুকান্ত ২১ বছর আর কিটস ২৫ বছর বয়সে মারা যান। কিটস ছিলেন সুন্দরের কবি, সুকান্ত ছিলেন বিপ্লব-বিদ্রোহের কবি। সুকান্ত বাংলা ভাষায় আর কিটস ইংরেজি ভাষায় কবিতা লিখেছেন। সবচেয়ে আক্ষেপের বিষয় হলো, তাদের সময় যক্ষ্মার চিকিৎসা আবিষ্কৃত হয়নি, এখন যক্ষ্মার ওষুধ আবিষ্কৃত হয়েছে। সময় খুব নিষ্ঠুর হয়, ঠিক যে সময় যা হওয়া দরকার ছিল, তা হতে দেয় না। ফুল ফোটাবার আগেই এভাবে ঝরে পড়ে, রেখে যায় আক্ষেপ, কষ্ট, পাওয়া না পাওয়ার যন্ত্রণা। তাদের কাছে অল্প সময়ে পৃথিবী যা পেয়েছে, আরও বেশি সময় বেঁচে থাকলে হয়তো অনেক কিছুই পেত!

আধুনিক মোবাইল ফোনের আবিষ্কারক মার্টিন কুপার যে সময় এ ডিভাইস আবিষ্কার করেছিলেন, সে সময় হয়তো ভেবেছিলেন তার আবিষ্কার মানুষের জন্য মঙ্গলজনক হবে। এখন আক্ষেপ হচ্ছে তার মানুষকে ক্রমেই মোবাইলের দাসে পরিণত হতে দেখে। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, মানুষ যে এভাবে সারাক্ষণ ফোনের দিকে তাকিয়ে থাকবে, তা তিনি আগে ভাবতে পারেননি। সময় তাকে ভালো অভিজ্ঞতাটা দিতে পারেনি। নিজের আবিষ্কার নিয়ে তিনি এখন নিজেই আক্ষেপ করছেন, কষ্ট পাচ্ছেন। মানুষের সঙ্গে এক সময় মানুষের সম্পর্ক ছিল, এখন যন্ত্রের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক। সময় দিয়েছে বেগ, কেড়ে নিয়েছে আবেগ।

আমাদের, সাধারণ মানুষের জীবনটাও বুঝি তা-ই-যে সময় মানুষের প্রয়োজন থাকে, সে সময় মানুষ অসহায় থাকে, সুখ ধরা দিতে চায় না। যে সময় মানুষের কিছুই আর চাওয়ার থাকে না, সে সময় মানুষ অনেক কিছু পেয়ে যায়। তখন এ পাওয়াটা সুখের হয় না, বোঝা হয়ে যায়।

ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী : অধ্যাপক, ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম