শতফুল ফুটতে দাও
বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক সমাজ ও সমাজ সংস্থা
ড. মাহবুব উল্লাহ্
প্রকাশ: ০৮ জুন ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ফাইল ছবি
পৃথিবীর অনেক অঞ্চলের মানুষ বিশ্বাস করত এবং অনেকে এখনো বিশ্বাস করে যে, প্রত্যক্ষ দৈহিক বাস্তবতার পেছনে থাকে স্পিরিট। তারা বিশ্বাস করে, দৃশ্যত মৃত বস্তু যেমন শিলা অথবা মাটির মধ্যে রয়েছে এক ধরনের জীবন্ত শক্তি, যাকে বলা হয় ‘মানা’ (mana)। সিঁউ রেড ইন্ডয়ানরা এ মানাকে বলত ‘ওয়াকান’। কানাডার আদিবাসী অটোয়া নদীর তীরভূমিতে বসবাসরত আলগোনকিয়ান্সরা একে বলত ‘মানিতু’। ইরোকুইরা বলত ‘ওরেন্ডা’। এসব জনগোষ্ঠীর দৃষ্টিতে পুরো পরিবেশটাই জীবন্ত।
সভ্যতার তৃতীয় তরঙ্গে মানবজাতি এমন এক সভ্যতা সৃষ্টি করেছে, যাকে বলা যায় নব্য ইনকো-স্ফিয়ার। এর মাধ্যমে মৃত পরিবেশের ওপর আরোপ করা হচ্ছে বুদ্ধিমত্তা। এ বুদ্ধিমত্তা আদিবাসীদের মানা কিংবা জীবন নয়। একটা সময় ছিল যখন গ্রাম বাংলার মানুষ ভূত-প্রেত, জিন-পরি ও অশরীরী আত্মায় বিশ্বাস করত। এখনো সে রকম বিশ্বাস করা মানুষের সংখ্যা কমে গেলেও এদের কিছু না কিছু অস্তিত্ব আছে। এক সময় গ্রামে সন্ধ্যার পর নিকষ কালো অন্ধকার নেমে আসত। তখন জোনাকির আলো ছাড়া অন্য কোনো রকমের আলো ছিল না। এ অন্ধকারকে বলা হতো ভূতুড়ে অন্ধকার। সে সময় পথের পাশে অবস্থিত বিশাল বট, তেঁতুলগাছের নিচ দিয়ে রাতের অন্ধকারে চলতে গিয়ে অনেকের গা ছমছম করত। অন্ধকারের পথচারী মনে করত, প্রাচীন এ বৃক্ষে অশরীরী আত্মা বাস করে যা পথচারীর ঘাড় মটকে দিতে পারে। বর্তমানে গ্রামগুলো বেশ কিছুটা আলোকিত হওয়ার ফলে অশরীরী আত্মার ভয় অনেকটাই দূর হয়ে গেছে। বর্তমান পৃথিবীতে মৃত পরিবেশের চারদিকে আত্মা যুক্ত হয়নি, কিন্তু যুক্ত হয়েছে বুদ্ধিমত্তা। এ অগ্রগতির পেছনে রয়েছে কম্পিউটার। এটি হলো ইলেকট্রনিক মেমোরির সঙ্গে প্রোগ্রামের সংযোগ যা মেশিনকে বলে কীভাবে সংরক্ষিত তথ্য-উপাত্ত প্রক্রিয়াকরণ করতে হবে। বিগত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে কম্পিউটার ছিল এক ধরনের বৈজ্ঞানিক কৌতূহল। ১৯৫৫ থেকে ১৯৬৫ সময়কালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তৃতীয় তরঙ্গের ধাক্কা অনুভূত হতে থাকে। প্রথমদিকে কম্পিউটারগুলো ছিল পৃথকভাবে দাঁড়িয়ে থাকা একটি ইউনিট, যার সক্ষমতা ছিল সামান্য। তখন এ মেশিনগুলো দিয়ে আর্থিক হিসাব-নিকাশ করা হতো। অচিরেই ব্যাপক সক্ষমতাসম্পন্ন মেশিন আসতে শুরু করল এবং এগুলো করপোরেট সদর দপ্তরে নানামুখী কাজে ব্যবহৃত হতে শুরু হলো। ১৯৬৫ থেকে ১৯৭৭ সময়কাল সম্পর্কে বুজ এ্যালেন অ্যান্ড হেমিলটন ম্যানেজমেন্ট কনসালটেন্টের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট হার্ভে পোপেল বলেছেন, ‘Era of the large central computer...It represents the epitome, the ultimate manifestation of machines thinking. It is the crowning achievement-a larger super computer buried hundreds of feels beneath the centre (in a) Bomb proof...antiseptic environment...manned by a bunch of super technocrats.
কেন্দ্রীভূত দৈত্যতুল্য এ সুপার কম্পিউটারগুলো এতই মনোমুগ্ধকর ছিল যে, এগুলোকে কেন্দ্র করে সামাজিক পুরাণ তৈরি হলো। সিনেমা নির্মাণকারীরা, কার্টুনিস্টরা এবং বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি রচয়িতারা এগুলো ব্যবহার করে ভবিষ্যতের ছবি আঁকতে শুরু করল। এসব কল্পকাহিনিতে দেখা গেল, কম্পিউটার এক ধরনের সর্বক্ষমতাময় মস্তিষ্ক, যে মস্তিষ্কে ঘনীভূত হয়ে আছে অতি মানবিক বুদ্ধিমত্তা।
সত্তরের দশকে কম্পিউটারের বাস্তব অগ্রগতি কল্পকাহিনিকে ছাড়িয়ে গেল। বিদ্যুৎ গতিতে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্রকরণ অগ্রসর হতে থাকল। এ অগ্রসরমানতার অর্থ দাঁড়াল কম্পিউটারের সক্ষমতা আকাশছোঁয়া হয়ে যাওয়া এবং প্রতি ফাংশান অনুযায়ী দামের পতন ঘটা। এছাড়া ছোট সহজলভ্য এবং শক্তিমান মিনি কম্পিউটার সর্বত্র ছড়িয়ে পড়তে লাগল। প্রত্যেক শাখা ফ্যাক্টরি, ল্যাবরেটরি, বিক্রয় দপ্তর অথবা ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্ট দাবি করল তাদের এ ধরনের কম্পিউটার রয়েছে। অনেক ধরনের কম্পিউটার বাজারে আসতে শুরু করল। দেখা গেল উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলো ভুলে যেতে থাকল তারা কত ধরনের কম্পিউটার তৈরি করেছে। কম্পিউটারের মস্তিষ্কশক্তি একটি বিন্দুতে কেন্দ্রীভূত থাকেনি; এটা ছড়িয়ে পড়েছে।
কম্পিউটার বুদ্ধিমত্তার এভাবে ছড়িয়ে পড়া খুব দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ১৯৭৭-এ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা তথ্য প্রক্রিয়াকরণ, যাকে ইংরেজিতে বলা হয় Distributed data processing, অথবা (DBP) সংক্রান্ত ব্যয় যুক্তরাষ্ট্রে দাঁড়িয়েছিল ৩০০ মিলিয়ন ডলারে। ইন্টারন্যাশনাল ডাটা করপোরেশনের তথ্য অনুযায়ী, এ ব্যয়ের অঙ্কটি ১৯৮২ সালের মধ্যে তিন হাজার মিলিয়ন ডলারে পৌঁছানোর কথা। ক্ষুদ্র সস্তা মেশিনগুলো, যেগুলো চালাতে বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত কম্পিউটার বিশারদের প্রয়োজন হয় না, সেগুলো এখন টাইপরাইটারের মতো ব্যবহৃত হচ্ছে। আমরা আমাদের কাজের পরিবেশ স্মার্ট করে তুলছি। শেখ হাসিনা কি এভাবে স্মার্ট বাংলাদেশ নির্মাণের কথা বলেছেন?
শিল্প-কারখানা ও সরকারের বাইরে একটি সমান্তরাল প্রক্রিয়া চলছে, যেখানে সর্বত্র ব্যবহৃত হচ্ছে এমন একটি গেজেট যার নাম হোম কম্পিউটার। ১৯৭৫-এর পর কিছুটা সময়জুড়ে হোম কম্পিউটার বা পারসোনাল কম্পিউটারের ব্যবহার ব্যাপক ছিল না। অথচ পরবর্তী সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে এগুলোর ব্যবহার আমরা দেখছি বাসার ড্রয়িংরুমে, রান্নাঘরে এবং আড্ডাস্থলে। এ দৃশ্য আমরা দেখেছি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আইবিএন এবং টেক্সাস ইন্সট্রুমেন্টসের মতো কোম্পানির বিশালভাবে বিক্রয় প্রয়াস শুরু হওয়ার আগে। হোম কম্পিউটারগুলো অনেকটা টেলিভিশন সেটের মতো ব্যবহৃত হতে শুরু হয়েছে। এই চতুর যন্ত্রগুলো ব্যবহৃত হচ্ছে সর্বত্র পারিবারিক কর থেকে বাসায় ব্যবহৃত বিদ্যুৎ মনিটরিং করার জন্য, গেম খেলার জন্য, রান্নার রেসিপির ফাইল সংরক্ষণের জন্য, এগুলোর মালিকদের বিভিন্ন কার্যক্রমের অ্যাপয়েন্টমেন্ট সংরক্ষণের জন্য এবং সর্বোপরি একটি স্মার্ট টাইপরাইটার হিসাবে ব্যবহারের জন্য। এসব যত কাজ করা যায়, তার ক্ষুদ্রাংশ মাত্র।
টেলি কম্পিউটিং করপোরেশন অব আমেরিকা একটি সেবা দেয় যার নাম হলো The Source. সোর্স থেকে খুবই সামান্য খরচে কম্পিউটার ব্যবহারকারীরা নিউজ ওয়্যারে প্রবেশ করতে পারবেন। এ থেকে পাওয়া যাবে স্টক ও কমোডিটি মার্কেটের বিশাল ডাটা; শিক্ষণীয় প্রোগ্রাম যার মাধ্যমে শিশুরা অঙ্ক করতে শিখবে, সঠিকভাবে বানান করতে শিখবে, ফরাসি, জার্মান অথবা ইটালিয়ান ভাষা। এর মাধ্যমে কম্পিউটারাইজড ডিসকাউন্ট শপারস্ ক্লাবের সদস্য হওয়া যাবে এবং তাৎক্ষণিকভাবে হোটেল ও ভ্রমণের রিজার্ভেশনসহ অনেক কিছু করা যাবে। দ্য সোর্স খুব সামান্য ব্যয়ে কম্পিউটার টার্মিনালে অবস্থানকারী ব্যক্তিকে এ সিস্টেমে অবস্থানকারী অন্যান্য ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ করতে সাহায্য করে। ব্রিজ ও দাবা খেলোয়াড়রা ইচ্ছা করলে হাজার হাজার মাইল দূরবর্তী খেলোয়াড়ের সঙ্গে এর মাধ্যমে খেলতে পারবেন। কম্পিউটার ব্যবহারকারীরা অন্য একজনের কাছে ব্যক্তিগত সংবাদ পাঠাতে পারে। অথবা একসঙ্গে বিশালসংখ্যক ব্যক্তি এ কাজটি করতে পারেন। ভাবের ও চিন্তার সব প্রকার আদান-প্রদান ইলেকট্রনিক মেমোরিতে গচ্ছিত রাখা যায়। সোর্সের মতো ব্যবস্থার মাধ্যমে ইলেকট্রনিক কমিউনিটি তৈরি হয়। এ কমিউনিটির সদস্যরা তাদের স্বার্থের চর্চা করতে পারে পারস্পরিক অংশীদারত্বের মাধ্যমে। এক ডজন শহরে সোর্সের মাধ্যমে ইলেকট্রনিকভাবে এক ডজন ফটো বাফ একত্রিত হয়ে তৃপ্তিসহকারে ক্যামেরা, ইকুইপমেন্ট, ডার্করুম টেকনিক, লাইটিং ও কালার ফিল্ম নিয়ে আলোচনা করতে পারে এবং কয়েক মাস পর, তাদের মন্তব্যগুলো পুনরুদ্ধার করতে পারে বিষয় বস্তু, তারিখ অথবা অন্য কোনো শ্রেণি প্রকরণ অনুযায়ী।
ঘরে ঘরে কম্পিউটার পৌঁছে যাওয়ায় নতুন এক বুদ্ধিবৃত্তিজনিত পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু এটাই শেষ কথা নয়। যন্ত্রভিত্তিক বুদ্ধিমত্তার বিস্তার এমন এক স্তরে পৌঁছাবে যা সম্ভব হবে মাইক্রো প্রসেসর এবং মাইক্রোকম্পিউটারের মাধ্যমে, যে স্তরে লুকায়িত বুদ্ধিমত্তার ক্ষুদ্র চিপগুলো হয়ে যাবে আমরা যা কিছু করি অথবা যা কিছু ভাবি তারই অন্তর্গত বিষয়। গত কয়েক দশকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স) ব্যাপক অগ্রগতি হয়েছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা থেকে উপকৃত হওয়ার বিশাল সম্ভাবনা যেমন দেখা দিয়েছে, তেমনি বিশাল চ্যালেঞ্জের উদ্ভব হচ্ছে। বলা হচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে মানুষের কাজগুলো যদি মেশিন করে ফেলে, তাহলে মানুষ কোথায় কাজ করবে? এমনই পরিস্থিতিতে মানব সভ্যতাকে টিকিয়ে রাখার জন্য প্রয়োজন হবে নতুন এক ধরনের সমাজ সংস্থা। সেই সমাজ হতে পারে মেহনতমুক্ত আনন্দের সমাজ। (আলভিন টফলারের The Third Wave-এর একটি অধ্যায়ের আলোকে)
ড. মাহবুব উল্লাহ : শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ