গণতন্ত্রের নাটবোলটু আঁটাতে হবে
ড. গোলাম শফিক
প্রকাশ: ০৬ জুন ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ফাইল ছবি
গ্রিক পুরাণের সিসিফাস একটা পাথর পাহাড়ে তুলতে প্রাণান্তকর চেষ্টা চালিয়েছিল। কিন্তু যতই সে পাথরটি উপরে ঠেলে, ততই প্রকাণ্ড এ উপলখণ্ড গড়িয়ে গড়িয়ে নিচে নেমে আসে। কারণ সে ছিল অভিশপ্ত।
আমরাও কি আমাদের জাতীয় জীবনের প্রথম অগ্রসরমানতার লগ্নে অভিশপ্ত হয়ে গিয়েছিলাম? না হলে আমাদের রাজনীতি কিংবা গণতন্ত্র কেন হয়ে গেল ‘সিসিফাস মিথ’? এ প্রশ্নের উত্তর মিলবে না। খুব সাদামাটাভাবে চিন্তা করলেও বোঝা যায় একটি ঘর যখন বাঁধা হয়, তখন এর খুঁটি শক্ত না হলে কিংবা এ নির্মাণযজ্ঞে বিভিন্ন পয়েন্টে নাটবোলটু, পেরেকগুলো ঠিকমতো আঁটিয়ে না দিলে ঘরটি পড়ে যাবে ঝড়ে। পাকা ভবনের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। আমাদের গণতন্ত্রে অনেক নাটবোলটুর অভাব ছিল, যা-ও ছিল সেসব নাটবোলটু যথাযথভাবে আঁটানো হয়নি। না হলে কেন স্বাধীনতার ৫২ বছর অতিক্রান্ত হলেও নির্বাচন এবং জাতীয় জীবনের অন্যান্য বিষয়ে একইভাবে বিতর্কের ঝড় বয়ে যায়?
আমাদের নিশ্চয়ই স্মরণে আছে, ১৯৯৪ সালে কমনওয়েলথ মহাসচিবের প্রতিনিধি স্যার নিনিয়ান এসেছিলেন এদেশে, একটা সমঝোতা করিয়ে দিতে। কিন্তু পরিণতি কী হয়েছিল? অনেক চেষ্টাচরিত্র করে নিনিয়ান সাহেব তার মিশনে ইস্তফা দিয়ে বাংলাদেশ ত্যাগ করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে মার্কিন রাষ্ট্রদূত একটি উদ্যোগ নিয়েছিলেন অন্য বিদেশিদের নিয়ে। কিন্তু তিনিও ব্যর্থ হয়ে হয়তো ভেবেছিলেন, আমরা যতই পরাশক্তি হই না কেন, বাঙালি রাজনৈতিক নেতাদের মন গলানোর শক্তি আমাদের নেই।
কয়েক মাস আগে ব্রিটেনের টোরি লিডারশিপ নির্ধারণের ক্ষেত্রে আমরা কী দেখলাম? তাদের অনেক পর্যায় অতিক্রম করে যেতে হয়েছিল। দলীয়প্রধান, সরকারপ্রধান নির্বাচিত হন সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে। এর শর্টকাট কোনো পথ নেই। আবার মধ্যবর্তী পর্যায়ে সরকারপ্রধান আস্থা হারালে তাকে চলে যেতে হয়, বরিস জনসনের বিদায়ের মাধ্যমে আমরা এর প্রমাণ পেয়েছি।
গ্রেট ব্রিটেন, যুক্তরাষ্ট্র উভয় দেশের সরকার ও দল পরিচালনার ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক পদ্ধতির চরম প্রয়োগ লক্ষ করার যায়। প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক বা প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন কেউই দলীয় প্রধান নন। ক্ষমতার ভারসাম্য আনার উদ্দেশ্যে তারা এ ব্যবস্থাটি পাকাপোক্ত করে রেখেছেন। ঔপনিবেশিক প্রভুদের আমরা গালমন্দ করলেও তাদের জীবনচর্চার উত্তম দিকগুলো গ্রহণের ক্ষেত্রে কার্পণ্য থাকা উচিত নয়।
মূল বিষয়ে দৃক্পাত করলে দেখতে পাই গোড়াতেই আমাদের গলদ ছিল। স্বাধীনতার পরপরই সরকার ও রাষ্ট্র পরিচালনার যে নীতিগুলো নির্ধারণ করা হয়েছিল, সেখানে নাটবোলটুগুলো শক্ত করে আঁটানো বা গ্রথিত হয়নি। সংবিধান নিয়ে বিতর্ক আগেও ছিল, এখনো আছে। সবচেয়ে বেশি বিতর্কের জন্ম দিয়েছে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ। এ অনুচ্ছেদে জাতীয় সংসদে স্বাধীন ভোটাধিকার সীমিত করা হয়েছে। এটি সংসদ-সদস্যদের তাদের নিজ দলের বিপক্ষে ভোট দেওয়া থেকে বিরত রাখে। এ অনুচ্ছেদটি সংস্কারের দাবি বেশ পুরোনো।
২০১৭ সালে এ অনুচ্ছেদটিকে চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিটও করা হয়েছিল। এ রকম আরও অনেক অনুচ্ছেদ বিষয়ে জন-অসন্তোষ রয়েছে, যেসব গণতন্ত্রকে পাকাপোক্ত করার ক্ষেত্রে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব ও ক্ষমতা যেভাবে বিধৃত হয়েছে [অনুচ্ছেদ ৪৮ (রাষ্ট্রপতি সংক্রান্ত), ৫৫, ৫৬] তাতে এটি নিরঙ্কুশ হওয়ার সুযোগ পেয়ে যায়; এজন্য সব সরকারের আমলেই সংসদীয় গণতন্ত্রকে দুর্বল হয়ে যেতে দেখা যায়। আর আমাদের সংবিধানের বর্তমান যে অবয়ব তাতে করে বলা যায়, বিগত অর্ধশতাব্দীতে ১৭টি সংশোধন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এটি নিয়ে এক ‘হোলি খেলা’ অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
সামরিক শাসকরা যাচ্ছেতাইভাবে সংবিধান সংশোধন করেছিলেন, যেখানে জনমতের কোনোই প্রতিফলন ছিল না। আর আমরা এত যে গণতন্ত্রের কথা বলি, সেটিকে টেকসই করার জন্য সংবিধানের সংস্থান অনুযায়ী ন্যায়পালের পদই এখন পর্যন্ত সৃষ্টি করিনি। তাহলে কথায় কথায় একটি পুনর্বিবেচনাযোগ্য দলিলের দোহাই দেওয়ার এত প্রয়োজন কী? অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, এখনো আমাদের গোড়া থেকেই শুরু করতে হবে।
বাংলাদেশ একটি ছোট্ট দেশ-এ দোহাই দিয়ে এখানে অনেক কিছুই প্রবর্তনে বাধা দেওয়া হয়। যেমন-প্রাদেশিক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তন এবং বিচারব্যবস্থাসহ মূল শাসন কাঠামোগুলোর বিকেন্দ্রীকরণ। বাংলাদেশ যতই ছোট হোক, কোরিয়ার চেয়ে নিশ্চয়ই নয়। দক্ষিণ কোরিয়ার বেশকিছু প্রাদেশিক সরকারের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ করে জেনেছি, প্রাদেশিক সরকার কাঠামোর মাধ্যমেই তারা সক্ষম হয়েছেন প্রয়োজনীয় সেবা নাগরিকদের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে।
এরশাদ সরকারের আমলে এদেশে বিচার বিভাগ বিকেন্দ্রীকরণ হয়। কিন্তু পরে এ সংক্রান্ত সংবিধানের অষ্টম সংশোধনী বাতিলও হয়ে যায়। তখন রিটের ওপর আদালতের কী পর্যবেক্ষণ ছিল তা জানার জন্য শ্রেণিকক্ষে গাজী শামছুর রহমানকে প্রশ্ন করেছিলাম। তিনি বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের সরকারব্যবস্থা যেহেতেু এককেন্দ্রিক, তাই বিচারব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণ এখানে খাটে না, কাজেই অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানকে সংশোধন নয়-নবায়ন করা হয়েছে।’ তখন প্রশাসনকে বিকেন্দ্রীকরণ করা হলেও বর্তমানে স্থানীয় সরকার খুবই নুলো, মোটেও শক্তিশালী নয়। আর স্থানীয় সরকারের জেলা পরিষদ স্তরটিতে কোনো নির্বাচনই হয় না। এ জন্য আজকের জাতীয় দাবি হোক, প্রশাসনের যথাযথ বিকেন্দ্রীকরণ এবং প্রতিটি স্তরে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা।
এই যে নির্বাচন সেটির প্রকৃত স্বরূপ কেমন হওয়া উচিত? গণতন্ত্রকে সুসংহত করতে হলে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে যেমন বিজয়ের ব্যবস্থা থাকে, তেমনী সংখ্যানুপাতিক হারে বিভিন্ন দলের মধ্যে আসন ভাগাভাগির ব্যবস্থাও করা দরকার। আনুপাতিক হারে নির্বাচন হলে তাতে ভোটারদের ইচ্ছা যথাযথভাবে প্রতিফলিত হয়। এ দিকটিতে নজর দেওয়া ছাড়াও বিভিন্ন পেশা, শ্রেণি, বর্ণের মানুষের যাতে সংসদে প্রতিনিধিত্ব থাকে তারও ব্যবস্থা থাকা দরকার।
নির্বাচন পদ্ধতি ও ভৌত প্রক্রিয়া নিয়ে এখন যে বিতর্ক চলছে, সেটির জন্য জাতি মোটেও প্রস্তুত ছিল না। এর মাধ্যমে জাতিকে চরমভাবে দগ্ধ করা হচ্ছে। আশার বিষয়, ইভিএম বাদ দিয়ে এর কিয়দংশের সমাধান হয়েছে। কিন্তু মূল সমস্যার ক্ষত এখনো দৃশ্যমান। আসলে এত কথা বলার প্রয়োজনই বা কী? প্রয়োজনের অতিরিক্ত কথা বলা হয় বলে ইউরোপীয় পার্লামেন্টকে বলা হয়ে থাকে ‘টকিং শপ’।
আমরা কি সংসদের ভেতরে-বাইরে এখন টকিং শপে আছি, নাকি ময়মনসিংহ গীতিকার চিকন গয়ালানী, যার পরিচয় ‘দই-দুধ হইতে সে যে কথা বেচে বেশি’ (‘কমলা’ পালা)? এভাবে কখনো প্রসঙ্গটি টানা হতো না, যদি না একটি সেটেল্ড ইস্যু (নির্বাচনকালীন সরকার) নিয়ে এত কথা হতো।
আমরা তো বরাবর ঈশ্বরের দোহাই দিয়েই জাতীয় নেতাদের (সরকারি ও বিরোধীদলীয়) বলে থাকি, আপনারা একটা বিহিত করুন। এবারও বলছি। কারণ মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরে বাংলা একে ফজলুল হক এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন বিলিয়ে দেওয়া দীর্ঘদিনের আন্দোলনের ফসল এই দেশ। এখন যদি আমরা গণতন্ত্রের শস্যদানাকে রক্ষা করতে না পারি, তাহলে উদ্ভূত পরিস্থিতি এসব পবিত্র আত্মার জন্য হবে অপমানজনক। একটু সংবেদনশীল হলেই আমরা তাদের ক্রন্দন শুনতে পাব।
সব সমস্যা ছাপিয়ে আমাদের সামনে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনই প্রধান হয়ে দেখা দিয়েছে। তাই প্রত্যাশা, একটি গ্রহণযোগ্য পদ্ধতিতে যেন আগামী সংসদ নির্বাচনটি অনুষ্ঠিত হতে পারে এবং সে নির্বাচিত সংসদটি যেন ব্যাপক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে গণতন্ত্রের নাটবোলটুগুলো ঠিকমতো আঁটিয়ে দেয়, যাতে ভবিষ্যৎ নিষ্কণ্টক থাকতে পারে। আর নির্বাচনটি হোক অবাধ ও সুষ্ঠু। সেই নির্বাচনে যেন জনগণকেই আমরা বিজয়ী ভাবি। কখনো যেন ভোটদাতাদের চেয়ে ভোট গণনাকারীরা অধিক গুরুত্ব না পায়, যেন এহেন নৈতিকতার পরাকাষ্ঠা দেখাতে আমরা সক্ষম হই।
আমাদের নিষ্কণ্টক ভবিষ্যৎ হোক সুষম উন্নয়নের ধাত্রী। প্রাচীন গুরু এরিস্টটলের কথামতো ‘সময়ের ক্ষয়িষ্ণু ক্ষমতা’ দ্বারা যেন কেউ দিকভ্রান্ত না হয়। এটি এক যুগনিরপেক্ষ বাণী। সময় বা মহাকাল সবই ফিকে করে দেয়। সেদিকে আমাদের কর্ণপাত করতেই হবে। এদেশের জাতীয় সংস্কৃতিতে তালগাছ অতীব মূল্যবান ও জনপ্রিয় একটি বৃক্ষ। আপাতত এটিকে আমরা মনোজগৎ থেকে প্রতীকী অর্থে নির্বাসন দিয়ে রাখি, যাতে কেউ বলতে না পারি-বিচার মানি, কিন্তু তালগাছটা আমার। কায়মনোবাক্যে যদি গণতন্ত্র তথা শান্তি তথা আত্মোন্নয়ন আমরা চাই, তবে সেটা পাবই। সেজন্য অন্য কোনো রাজনৈতিক সুনামির আগেই চাই সত্যিকারের সমঝোতা, যেখানে পরস্পর বিশ্বাসযোগ্যতার পরিবেশ তৈরি হবে। অন্তত আরেকটিবারের জন্য আমরা জাতীয় ঐক্য চাই। ত্যাগহীনতা ও অসহিষ্ণুতার চর্চায় দেশ সত্যিই সংকটের দিকে নিপতিত হচ্ছে।
ড. গোলাম শফিক : লেখক ও গবেষক