থাইরয়েডজনিত সমস্যা নিয়ে অবহেলা আর নয়
ডা. শাহজাদা সেলিম
প্রকাশ: ২৫ মে ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
প্রতিবারের মতো এ বছরও ২৫ মে পালিত হচ্ছে বিশ্ব থাইরয়েড দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় হলো থাইরয়েড ও জিনগত ত্রুটি।
থাইরয়েড বিষয়ে জনসচেতনতার ঘাটতি রয়েছে। থাইরয়েডজনিত রোগের ব্যাপকতা ও গভীরতা বিবেচনায় এ বিষয়ে সম্যক ধারণা থাকা সময়ের দাবি।
ধারণা করা হয়, দেশে ৪-৫ কোটি মানুষ থাইরয়েড সমস্যায় আক্রান্ত। বিশ্বে প্রায় ৮০ কোটি মানুষ এ সমস্যায় ভুগছে। এ পরিপ্রেক্ষিতেই এ লেখা।
থাইরয়েড গ্রন্থি একটি অতি প্রয়োজনীয় অন্তক্ষরা (এন্ডোক্রাইন) গ্ল্যান্ড, যা গলার সামনের অংশে অবস্থিত। এটি মানব শরীরের প্রধান বিপাকীয় হরমোন তৈরিকারী গ্ল্যান্ড। থাইরয়েড থেকে নিঃসৃত প্রধান কার্যকরী হরমোনগুলো তৈরি করতে সাহায্য করে টিএসএইস নামক আরেকটি হরমোন, যা মস্তিষ্কের ভেতর পিটুইটারি নামের গ্ল্যান্ড থেকে নিঃসৃত হয়।
থাইরয়েড হরমোনের অন্যতম কাজ হচ্ছে শরীরের বিপাকীয় হার বা বেসাল মেটাবলিক রেট বাড়ানো। থাইরয়েড হরমোনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে স্নায়ুর পরিপক্বতা। গর্ভাবস্থায় থাইরয়েড হরমোনের স্বল্পতায় গর্ভের বাচ্চা বুদ্ধিদীপ্ত হয় না। যেসব উদ্দীপনায় বিপাক ক্রিয়া বেড়ে যায় যেমন-যৌবনপ্রাপ্তি, গর্ভাবস্থা, শরীরবৃত্তীয় কোনো চাপ ইত্যাদি কারণে থাইরয়েড গ্লান্ডের আকারগত বা কার্যকারিতায় পরিবর্তন হতে পারে।
থাইরয়েড গ্রন্থি থেকে মূলত দুই ধরনের সমস্যা দেখা দেয়-গঠনগত ও কার্যগত। এগুলো বিভিন্ন উপায়ে প্রকাশ পেতে পারে। গঠনগত সমস্যায় থাইরয়েড গ্রন্থি ফুলে যায়, যেটাকে গয়টার বা গলগণ্ড বলা হয়; যার আবার রয়েছে নানা প্রকারভেদ। এছাড়া থাইরয়েড গ্ল্যান্ডে গোটা বা নডিউল এবং ক্যানসার হতে পারে। কার্যগত সমস্যা দুই রকমের হয়ে থাকে, যা হলো-থাইরয়েড গ্ল্যান্ডের অতিরিক্ত কার্যকারিতা বা হাইপারথায়রয়েডিজম এবং থাইরয়েড গ্ল্যান্ডের কার্যকারিতা হ্রাস বা হাইপোথায়রয়েডিজম। এছাড়া থাইরয়েড গ্ল্যান্ডের প্রদাহ বা থাইরয়েডাইটিস হতে পারে।
থাইরয়েড গ্ল্যান্ডের অতিরিক্ত কার্যকারিতা বা হাইপারথায়রয়েডিজম
হাইপারথাইরয়েডিজম রোগে থাইরয়েড গ্ল্যান্ড বেশি মাত্রায় সক্রিয় হয়ে পড়ে। থাইরয়েড গ্ল্যান্ডের অতিরিক্ত কার্যকারিতার ফলে যেসব সমস্যা হতে পারে সেগুলো হলো-প্রচণ্ড গরম লাগা, হাত পা ঘামা, পরিপাকতন্ত্রের সমস্যা, খাওয়ার রুচি স্বাভাবিক বা বেড়ে যাওয়ার পরও ওজন কমে যাওয়া, ঘনঘন পায়খানা হওয়া, হার্ট ও ফুসফুসীয় সমস্যা, বুক ধড়ফড়, হৃদস্পন্দন বেড়ে যাওয়া, হার্ট ফেইলিউর, এনজাইনা বা বুকে ব্যথা, স্নায়ু ও মাংসপেশির সমস্যা : অবসন্নতা বা নার্ভাসনেস, মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাওয়া, উত্তেজনা, আবেগপ্রবণতা, সাইকোসিস বা মানসিক বিষাদগ্রস্ততা; হাত-পা কাঁপা, মাংসপেশি ও চক্ষুপেশির দুর্বলতা ইত্যাদি। এছাড়া হাড়ের ক্ষয় বা ওস্টিওপোরোসিস, মাসিকের সমস্যা, বন্ধ্যত্ব পর্যন্ত হতে পারে।
হাইপারথায়রয়েডিজমের কারণ
ক. গ্রেভস ডিজিস : একধরনের অটোইমিউন রোগ, যাতে থাইরয়েড গ্লান্ডের পাশাপাশি চোখ আক্রান্ত হতে পারে এবং চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে আসে।
খ. মাল্টিনডিউলার গয়টার।
গ. অটোনামাসলি ফাংশনিং সলিটারি থাইরয়েড বডিউল।
ঘ. থাইরয়েড গ্ল্যান্ডের প্রদাহ বা থায়রয়েডাইটিস।
ঙ. থাইরয়েড গ্ল্যান্ড ছাড়া অন্য কোনো উৎসের কারণ থাইরয়েড হরমোনের আধিক্য।
চ. ক্যানসার ও অন্যান্য।
হাইপারথায়রয়েডিজমের চিকিৎসা হচ্ছে অ্যান্টিথায়রয়েড ওষুধ, যা থাইরয়েড গ্রন্থির কার্যকারিতা কমিয়ে দেয়। ওষুধ ছাড়া কখনো কখনো সার্জারি করা প্রয়োজন হতে পারে। যখন অ্যান্টি থাইরয়েড ওষুধ ব্যবহার করা হয়, এটি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেড় থেকে দুই বছর ব্যবহার করা হয়। তারপর এ ওষুধ বন্ধ করে দিতে হবে। রোগী যদি স্বাভাবিক থাকে, তাহলে ভালো। কিন্তু যদি আবারও রোগ ফিরে আসে, তাহলে সাধারণত রেডিও আয়োডিন দিয়ে গ্ল্যান্ড নষ্ট করে দিতে হয়।
থাইরয়েড গ্ল্যান্ডের কার্যকারিতা হ্রাস বা হাইপোথায়রয়েডিজম
যেসব অঞ্চলে আয়োডিনের অভাব রয়েছে, সেসব স্থানে আয়োডিনের অভাবজনিত কারণে হাইপোথায়রয়েডিজম দেখা যায়। এছাড়া অটোইমিউন হাইপোথায়রয়েডিজমে থাইরয়েড গ্ল্যান্ডের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি সক্রিয় হলে গ্ল্যান্ড নষ্ট হয়ে যায় এবং থাইরয়েড গ্ল্যান্ড কাজ করে না। চিকিৎসাজনিত কারণেও এ অসুখ হতে পারে। অপারেশনের কারণে থাইরয়েড গ্ল্যান্ড বাদ দিতে হলে বা অন্য কারণে থাইরয়েড নষ্ট হয়ে গেলে এ সমস্যা হতে পারে। হাইপারথায়রয়েডিজমের ওষুধের ডোজ বেশি হলে তা থেকে হাইপারথায়রয়েডিজম হতে পারে। নবজাতক শিশুদের মধ্যে থাইরয়েড গ্ল্যান্ড তৈরি বা কার্যকর না হলে কনজেনিটাল হাইপোথায়রয়েডিজম দেখা যায়।
হাইপোথায়রয়েডিজমের লক্ষণগুলো হলো-অবসাদগ্রস্ত হওয়া, অলসতা, ঘুম ঘুম ভাব, ত্বক খসখসে হয়ে যাওয়া, শরীর অল্প ফুলে যাওয়া, ক্ষুধা মন্দা , চুল পড়া, ওজন অল্প বেড়ে যাওয়া- ৫-৬ কিলোগ্রাম বেড়ে যেতে পারে, স্মৃতিশক্তি কমে যাওয়া, শীত শীত ভাব, কোষ্ঠকাঠিন্য, মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাওয়া, উচ্চ রক্তচাপ বেগে যাওয়া, মাসিকের সমস্যা, বন্ধ্যত্ব সমস্যাও হতে পারে, গর্ভধারণকালে গর্ভপাত হতে পারে। কনজেনিটাল হাইপোথায়রয়েডিজমে শিশুর ব্রেনের বিকাশ হয় না।
থাইরয়েড ক্যানসার
থাইরয়েড গ্রন্থির কোনো অংশ টিউমারের মতো ফুলে উঠলে বলা হয় থাইরয়েড নডিউল। এসব নডিউলের ১ শতাংশ থেকে থাইরয়েড ক্যানসার হতে পারে। থাইরয়েড গ্রন্থির কোনো অংশের কোষ সংখ্যা অনিয়ন্ত্রিতভাবে বৃদ্ধি পেলে তাকে থাইরয়েড ক্যানসার বলে। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে থাইরয়েড গ্রন্থি বা এর অংশবিশেষ ফুলে ওঠা মানেই ক্যানসার নয়। থায়রয়েড ক্যানসারে যে লক্ষণগুলো দেখা দিতে পারে-
গলার সম্মুখভাগে ফুলে ওঠা। ফোলা অংশটি বেশ শক্ত হয়।
একটি বা একাধিক টিউমার হতে পারে। উভয় পাশে টিউমার হতে পারে, আশপাশের লিঙ্ক নোডগুলো ফুলে উঠতে পারে।
ওজন কমে যায়। খাওয়ার রুচি কমে যেতে পারে।
গলার স্বর পরিবর্তন হতে পারে। গলার স্বর মোটা বা ফ্যাসফেসে হতে পারে। তবে থাইরয়েড নডিউল বা ক্যানসার ছাড়াও গলার সামনে ফুলে উঠতে পারে। শ্বাসনালির ওপর চাপ সৃষ্টির ফলে শ্বাসকষ্ট হতে পারে।
খেয়াল রাখতে হবে, বংশে থাইরয়েড ক্যানসারের ইতিহাস থাকলে ক্যানসার স্ক্রিনিংয়ের জন্য অবশ্যই এন্ডোক্রাইনোলজিস্ট বা হরমোন বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে।
থাইরয়েড ক্যানসার এমন একটি রোগ, যা সময়মতো চিকিৎসা করলে ৯৫ শতাংশ ক্ষেত্রেই সম্পূর্ণ আরোগ্য সম্ভব। তবে অবশ্যই সময়মতো চিকিৎসা করাতে হবে। গলার সামনে ফুলে উঠলে যথাসম্ভব দ্রুত একজন এন্ডোক্রাইনোলজিস্ট বা হরমোন বিশেষজ্ঞ দেখানো উচিত। তিনি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখবেন এটা কোন ধরনের রোগ।
বিশেষভাবে জানা প্রয়োজন
থায়রয়েড গ্রন্থি মানব শরীরে প্রধান বিপাকীয় হরমোন তৈরিকারী গ্ল্যান্ড।
বাচ্চাদের ক্ষেত্রে হরমোনটি শারীরিক ও মানসিক বিকাশে বিশেষ ভূমিকা রাখে।
বড়দের ক্ষেত্রে প্রজননে অক্ষমতা, মহিলাদের মাসিকের সমস্যা, পেটের বাচ্চা নষ্ট হওয়াসহ নানা সমস্যা হতে পারে।
থায়রয়েড ক্যানসার এমন একটি রোগ, যা সময়মতো চিকিৎসা করলে ৯৫ শতাংশ সম্পূর্ণ আরোগ্য সম্ভব।
গর্ভবতী অবস্থায় মায়ের হাইপোথায়রয়েডিজমের কারণে বাচ্চা বোকা ও বুদ্ধিহীন হতে পারে।
ডা. শাহজাদা সেলিম : সহযোগী অধ্যাপক, এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়