Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

নীতি দুর্নীতি অর্থনীতি

সাবধানতা অবলম্বনের বিকল্প নেই

Icon

ড. আর এম দেবনাথ

প্রকাশ: ৩০ এপ্রিল ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

সাবধানতা অবলম্বনের বিকল্প নেই

টানা পাঁচদিন ছুটির পর গত সোমবার অফিস-আদালত, ব্যাংক-বিমা খুলেছে। ঘরমুখো মানুষ এখন ঢাকায় ফিরছে। তারা সংখ্যায় কত?

একটি কাগজে দেখলাম, এবার ঈদ উপলক্ষ্যে ১৮ এপ্রিল পর্যন্ত ঢাকা থেকে গ্রামে গিয়েছে ১ কোটি ১৩ লাখ ৮৮ হাজার ৫৮৭ জন। ভাবা যায়, এত বিপুলসংখ্যক লোক ৫-৭ দিনের ব্যবধানে ঢাকা ছেড়েছে এবং তারা এখন ফিরছে। খুবই আনন্দের কথা, এবার যাতায়াতের কষ্টের অভিযোগ শোনা যায়নি। রেল, বাস, লঞ্চ, বিমান কোনো খাতেই যাত্রীদের ভোগান্তির কথা বিশেষ শোনা যায়নি। নির্বিঘ্নে সবাই এই গরমে ‘দেশে’ গিয়েছে। সবচেয়ে আনন্দের বিষয় ছিল পদ্মা সেতু পারাপারের ঘটনা। লাখ লাখ মানুষ পদ্মা সেতু দিয়ে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে গিয়েছে।

এই যে এত লোক গ্রামে গেল, তারা কি খালি হাতে গিয়েছে? প্রশ্নই ওঠে না। অনেকদিন পর স্বাভাবিক ঈদ উপলক্ষ্যে মানুষ দেশে গেছে যার যার সাধ্যমতো ‘ক্যাশ’ নিয়ে। ‘ক্যাশ’ কোত্থেকে এলো, কত ক্যাশ-এর কোনো নির্ভরযোগ্য হিসাব নেই। তবে ১৫-২০ লাখ সরকারি-আধাসরকারি কর্মচারী-কর্মকর্তা, দুই লাখের উপর ব্যাংক কর্মকর্তা-কর্মচারী, আধা লাখের মতো বিমা ও নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী-কর্মকর্তারা এপ্রিলের বেতন-ভাতা-বোনাস নিয়ে দেশে গিয়েছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে পোশাক শিল্পের ৩০-৪০ লাখ নারী শ্রমিক। বলাই বাহুল্য, এখানে হাজার হাজার কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক তো ১৫ হাজার কোটি টাকার নতুন নোট বিনিময় করেছে। সঙ্গে আছে ৩০০ কোটি ডলার রেমিট্যান্স, যা বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশিরা মার্চ-এপ্রিল মাসে পাঠিয়েছে সরকারিভাবে। বেসরকারিভাবেও এসেছে প্রায় সমপরিমাণ টাকা।

ঈদের আগে গিয়েছে পহেলা বৈশাখ, বাঙালির প্রাণের উৎসব। পবিত্র ঈদের কারণে পহেলা বৈশাখের বাজার কিছুটা ম্লান হলেও পহেলা বৈশাখ উপলক্ষ্যে সারা দেশে সুতি শাড়ি, ফতুয়া, হস্তজাত পণ্য, মাটির তৈরি জিনিসপত্র বিক্রি হয়েছে। সারা দেশে হাজার হাজার বৈশাখী মেলা, শিবের গাজন অনুষ্ঠিত হয়েছে। আনন্দই আনন্দ। সরকারি কড়া ব্যবস্থার ফলে নির্বিঘ্নে অনুষ্ঠিত হয়েছে পহেলা বৈশাখ। এবার ইলিশের দাপট ছিল না; তবে মাছের বাজার, মাংসের বাজার কিছুটা চাঙ্গাই ছিল। পহেলা বৈশাখের পর পবিত্র ঈদের বাজার বেশ কিছুটা জমেছিল। সুতি শাড়ি, জামা-কাপড়, জুতা-মোজা, পাঞ্জাবি-কুর্তা, ঢাকাই শাড়ি, টাঙ্গাইলের শাড়ি ইত্যাদির বাজার শেষের দিকে জমেছিল। প্রথমদিকে বাজার ততো চাঙ্গা ছিল না। সর্বত্রই অভিযোগ ছিল উচ্চমূল্যের। বাজারে সব জিনিসের দাম খুবই চড়া। মূল্যস্ফীতি প্রায় ১০ শতাংশ। সেই হিসাবে মানুষের আয় বাড়েনি। তবু এরই মধ্যে পরিবহণ ব্যবসা মোটামুটি ভালোই হয়েছে। পর্যটন ব্যবসাও ভালো ছিল। রাঙামাটি, বান্দরবান, পটুয়াখালী, সিলেটের পর্যটন কেন্দ্রগুলো শত শত কোটি টাকার বাণিজ্য করেছে। সিলেটে পর্যটন ব্যবসায় কিছুটা মন্দা থাকলেও অন্যত্র বাজার ভালো ছিল। সেসব স্থানে হাজার কোটি টাকার আদান-প্রদান হয়েছে। বহুদিন পর মানুষ প্রাণখুলে একটু বেড়াতে পেরেছে। দেশের বাইরে লোক গেছে কিছুটা কম। বিমানের টিকিটের মূল্য অত্যধিক। রয়েছে ছেলেমেয়েদের পরীক্ষা, যা শিগ্গির শুরু হবে। এরই মধ্যে নব্য ধনীদের নতুন গন্তব্য স্থান দুবাই-আবুধাবিতে গিয়েছে প্রচুর লোক। অন্যান্য দেশে, প্রতিবেশী ভারতেও গেছে প্রচুরসংখ্যক লোক। ডলার সংকটের মধ্যেই তাদের যাত্রা। জামা-কাপড়ের বাজার আজিজ মার্কেট নামমাত্র ব্যবসা করেছে। ফুলের ব্যবসা ভালো হয়েছে। মিষ্টির ব্যবসাও কম যায়নি। বস্তুত ফুল ও মিষ্টির ব্যবসা ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।

গ্রামে লোডশেডিং ঢাকার তুলনায় অনেক বেশি। তবু মানুষ তা সহ্য করেছে। প্রথমদিকে প্রচণ্ড গরম থাকলেও ঈদের দিনে এবং পূর্ববর্তী দিনগুলোতে আবহাওয়া কিছুটা শীতল ছিল। কাপড়ের বাজার আমাদের প্রায় ৫০-৭০ হাজার কোটি টাকার। ব্যবসায়ীদের মতে, এই ব্যবসা ঈদ উপলক্ষ্যে মোটামুটি হয়েছে। তবে লক্ষণীয়, এই গরমের মধ্যে ফ্যান, এসি-ফ্রিজ বিক্রি বেশ ভালো হয়েছে। বেনারসি পল্লি, ঈশ্বরদী ও টাঙ্গাইল অঞ্চলের তাঁতিরা আগের মতো ব্যবসা করতে পারেনি। সর্বত্রই মূল্যস্ফীতির কারণ দেখানো হচ্ছে। খবরে দেখলাম, টাঙ্গাইলে এবার শাড়ি তৈরি হয়েছিল চার-সাড়ে চার লাখ। এর কিছু অংশ অবিক্রীত থাকবে বলে ধারণা। ঢাকাস্থ বড় বড় শপিংমলে ব্যবসা হয়েছে। তবে তা ছিল মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তের বেচা-কেনা।

এদিকে দেখা যাচ্ছে, বৃহস্পতিবার পর্যন্ত অফিস-আদালতে কর্মচারী-কর্মকর্তার উপস্থিতি স্বাভাবিক হয়নি। দোকানপাট এখনো সব খোলেনি। কাঁচাবাজারও স্বাভাবিক হয়নি। শুক্র ও শনিবার সাপ্তাহিক ছুটি। ৩০ তারিখ মাঝখানে খোলা। এরপর পহেলা মে শ্রমিক দিবস। অতএব অনুমান, মঙ্গল-বুধবারের দিকে সবকিছু স্বাভাবিক হতে পারে। ব্যাংক ব্যবসা চালু হয়েছে। ঈদের আগে যথারীতি মানুষ অনেক ‘নগদ’ টাকা ব্যাংক থেকে তুলেছে। বাজারে টাকার সংকট নয়, ঘাটতি ছিল। এ কারণে ‘কলমানি মার্কেটে’ (আন্তঃব্যাংক লেনদেন) সুদের হার সামান্য বেড়েছিল।

এদিকে ভালো খবর হচ্ছে, বৃহত্তর সিলেট, ময়মনসিংহ ইত্যাদি অঞ্চলে বোরো ফসল তোলা শুরু হয়েছে। সিলেট অঞ্চলের কৃষকরা এখন পর্যন্ত খুবই খুশি। অন্যান্য বছর এমন সময়ে অতিবৃষ্টি, বানের জল তাদের ফসল নষ্ট করে। এবার তা হয়নি। কৃষকদের সহায়তা করার জন্য সরকার ফসল তোলার ক্ষেত্রে যন্ত্রপাতির ব্যবহার বাড়িয়েছে। এ কারণে ইতোমধ্যে ৬০-৭০ শতাংশ বোরো কৃষকরা ঘরে তুলতে পেরেছেন। ঘটনাক্রমে বোরো আমাদের বড় ফসল। আগে তা ছিল না। আগে সবচেয়ে বড় ফসল ছিল আমন। এখন সবচেয়ে বড় ফসল বোরো, তারপর আমন এবং সবশেষে আউশ। সরকারি হিসাবে এ বছর ৫০ লাখ হেক্টর জমিতে বোরো চাষ করা হয়েছে। এতে ফসল আসবে ২ কোটি ১৫ লাখ টন। গত বছর তা ছিল ২ কোটি ২ লাখ টন। বর্ধিত উৎপাদনের কারণে সরকার এবার ১৫-২০ লাখ বোরো ধান-চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে। এটা নিঃসন্দেহে খাদ্য নিরাপত্তা রক্ষায় কাজে লাগছে। বলা বাহুল্য, এখন দেশে খাদ্যাভাব নেই। চালে আমরা মোটামুটি স্বয়ংসম্পূর্ণ। গম আমদানি করতে হয়। গমের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে এখন কিছুটা স্থিতিশীল। অবশ্য জ্বালানি তেলের মূল্য আবার বৃদ্ধির দিকে। এর ফলে আমাদের বাণিজ্য ঘাটতি হ্রাস পাচ্ছে না, বরং বাড়ছে।

বাণিজ্য ঘাটতির পাশাপাশি চলছে ব্যালেন্স অব পেমেন্ট সংকট। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ স্থিতিশীল থাকলেও প্রকৃত রিজার্ভ আইএমএফ’র হিসাবে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে কম। তারা এবার আমাদের সাড়ে চার বিলিয়ন ডলার ঋণ দেবে ডলারে। প্রথম দফায় তারা কিছু ঋণ ছাড় করেছে। খবরে দেখলাম, তাদের খবরদারি শুরু হয়েছে। এ মুহূর্তে তাদের একটা টিম আমরা চুক্তি মোতাবেক কাজ করছি কিনা তা দেখতে এসেছে। ২০২৩-২৪ অর্থছরের বাজেট আমরা কীভাবে করব, তা তারা জানতে চায়। রাজস্ব কীভাবে বাড়াব, তা জানতে চায়। কবে ব্যাংক ঋণের ওপর সুদের ঊর্ধ্বসীমা তুলে দেওয়া হবে, তা জানতে চায়। জুনের মধ্যে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রাখার জন্য তারা তাগিদ দিচ্ছে। বাংলাদেশ এ ব্যাপারে এখনো নিশ্চিত নয়। এ অবস্থায় সমস্যা রয়েই যাচ্ছে। আমদানি বাণিজ্যে নিয়ন্ত্রণ অব্যাহত রয়েছে। ‘মার্জিন’ বেশি করা হয়েছে। অনেক পণ্য আমদানি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু তারপরও আমদানি কমছে না আশানুরূপভাবে। আশঙ্কাজনক হচ্ছে, এরই মধ্যে মূলধনী যন্ত্রপাতি, শিল্পের কাঁচামাল আমদানি ভীষণভাবে হ্রাস পেয়েছে। ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, এতে শিল্প উৎপাদন হ্রাস পাবে। রপ্তানি বিঘ্নিত হবে। রপ্তানি আগের মতো বাড়ছে না। আমদানির পরিমাণ সেভাবে কমছে না। রেমিট্যান্স মার্চ-এপ্রিলে বেড়েছে কিছুটা। কিন্তু তা মনে হয় সাময়িক। কারণ এ দুই মাসে ‘রেমিট্যান্স’ এসেছে ঈদ উপলক্ষ্যে, যা বরাবরই আসে। এ কারণে আশঙ্কা, আগামী মাসগুলোতে রেমিট্যান্সের পরিমাণ হ্রাস পেতে পারে। উদ্বেগজনক খবর হচ্ছে, মানুষ বিদেশে যাচ্ছে বেশি, কিন্তু ‘রেমিট্যান্স’ আসছে কম। বিদেশেও বাংলাদেশিরা অন্যদের মতো সংকটে আছে।

দেখা যাচ্ছে, বেসরকারি বিনিয়োগও কিছুটা হ্রাস পাচ্ছে। ব্যাংকেও তারল্য সংকট আছে। সব ব্যাংকে নগদ টাকা নেই। উচ্চমূল্যে ডলার কিনতেই অনেক টাকা চলে যাচ্ছে। এরই মধ্যে খবর হচ্ছে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত মোতাবেক বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রাখতে হলে বাংলাদেশ ব্যাংক আর ডলার বাজারে বেশিদিন বিক্রি করতে পারবে না। তাহলে ডলারের মূল্য বাড়তে পারে। সঠিকভাবে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি যতোটা স্বাভাবিক মনে হচ্ছে, বাস্তবে ততটা স্বাভাবিক নয়। মুশকিল হচ্ছে, এরই মধ্যে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটের কাজ শুরু হয়েছে। আইএমএফ’র শর্ত মেনে বাজেট করতে হচ্ছে বহুদিন পর। আগে এমন দিন ছিল যখন প্রতিবছর বাজেটের আগে অর্থমন্ত্রীকে দলবল নিয়ে ছুটতে হতো ওয়াশিংটনে দাতাদের কাছে। তারা কত টাকা ঋণ দেবে তার ওপর নির্ভর করত আমাদের বাজেটের আকার। এ অবস্থা থেকে আমরা নিষ্কৃতি পেয়েছিলাম। বছরে গড়ে ছয়, সাড়ে ছয় শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হচ্ছিল। অবকাঠামো গড়ে উঠছিল। আমদানি-রপ্তানি বাড়ছিল। রেমিট্যান্স বাড়ছিল। সামাজিক-অর্থনৈতিক সূচকে আমরা অগ্রগতি দেখাচ্ছিলাম। দৃশ্যত মনে হয়েছিল, আমাদের আর সমস্যা নেই। কিন্তু প্রথমে করোনা মহামারি, এরপর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ আমাদের আচমকা বিপদে ফেলে দেয়। তেলের মূল্য, খাদ্যশস্যের মূল্য, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের মূল্য আন্তর্জাতিক বাজারে আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পায়। ফলে আমাদের মূল্যস্ফীতি ৫-৬ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশে উন্নীত হয়। বিরাট সংকটের মুখোমুখি এখন আমরা। তবে আশার কথা, এখনো আমরা পরিস্থিতি মোকাবিলা করে চলেছি। আন্তর্জাতিক বাজারে যদি জিনিসপত্রের দাম আর না বাড়ে, তাহলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে থাকবে। অন্যথায় নয়। কারণ আমরা আমদানিনির্ভর দেশ। ফলমূল, কাঁচামাল, ভোগ্যপণ্য, মূলধনী যন্ত্রপাতি, গম, কিছুটা চাল আমাদের আমদানি করতে হয়। এমনকি পেঁয়াজ, রসুন, আদাও। অতএব আগামী দিনে সাবধানতা অবলম্বন করা ছাড়া গত্যন্তর নেই।

ড. আর এম দেবনাথ : অর্থনীতি বিশ্লেষক; সাবেক শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম