Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

তিতাসের ব্যর্থতা ও ঢাকাবাসীর বিনিদ্র রজনি

Icon

ড. মাহবুব উল্লাহ্

প্রকাশ: ২৭ এপ্রিল ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

তিতাসের ব্যর্থতা ও ঢাকাবাসীর বিনিদ্র রজনি

গত সোমবার, ২৪ এপ্রিল ঢাকা নগরীর বাসিন্দারা বিনিদ্র রজনি কাটিয়েছেন। কিছু মানুষ আছে যারা শারীরিক বা মানসিক অসুস্থতা হেতু রাতে ঘুমাতে পারেন না। তাদের কথা আলাদা।

সংখ্যার দিক থেকে এ রকম মানুষের শতকরা হার ৪-৫ শতাংশের মতো হবে। নিদ্রাহীনতা সম্পর্কে কোনো গবেষণা হয়েছে কিনা তা আমার জানা নেই। সাধারণ পরিস্থিতিতে নিদ্রাহীন মানুষের সংখ্যাটি অনুমান করে বলতে হবে।

সোমবার রাতে যারা রাজধানী ঢাকায় ঘুমাতে পারেননি, তারা রাজধানী ঢাকার লোকসংখ্যার একটি উলে­খযোগ্য অংশ তো হবেনই। একসঙ্গে এত মানুষের নিদ্রাহীনতা খুবই ব্যতিক্রমী ঘটনা।

সেদিন রাতে যারা ঘুমাতে পারেননি, তারা সময় পার করেছেন নিদারুণ উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় ও আতঙ্কে। রাজধানী ঢাকায় নানা ধরনের বিপদ-আপদ মানুষের ঘুম কেড়ে নেয়। কেউ কেউ জানিয়েছেন সোমবার রাতের দুর্যোগের সময় আরও একটি মহাবিপদের আলামত, যা বাড়তি উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। একটি ভ‚মিকম্প নাকি হয়েছিল। তবে ভ‚মিকম্পটি মৃদু কম্পনের হওয়ায় অনেকেই বুঝতে পারেননি ভ‚মিকম্প হয়েছে। উচ্চমাত্রার ভ‚মিকম্প হলে, যা যে কোনো সময় ঘটতে পারে, তা যদি ঘটে তাহলে ৭০ শতাংশ দালান-কোঠা ধূলিসাৎ হয়ে যাবে। আমরা এ বিপদ মোকাবিলা করার জন্য কতটুকু প্রস্তুত? ভ‚-বিজ্ঞানীরা বলেছেন, ঢাকাসহ বাংলাদেশের একটি অংশ ভ‚মিকম্পজনিত মাঝারি আকারের ঝুঁকিতে পড়বে। গত কয়েক বছরে অগ্নিকাণ্ড, গ্যাস বিস্ফোরণ, কেমিক্যালের গুদামে আগুন এবং পোশাক কারখানা ধসে পড়ার ফলে বহু প্রাণহানি ঘটেছে। অনেকে পঙ্গুত্ব বরণ করে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। রানা প্লাজা ধসের ফলে বেশ কিছুসংখ্যক পোশাক কর্মীকে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে ইট-সুরকির জঞ্জালের চাপে। দুঃখজনক হলো, সাবেক একজন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তার দায়িত্ব পালনকালে বলেছিলেন, বিএনপির লোকেরা রানা প্লাজা ভবনটিকে ঝাঁকুনি দেওয়ায় এটি ভেঙে পড়েছে। মানুষের দুঃখ-কষ্ট ও জীবন নিয়ে এ রকম হাস্যকর কিন্তু মর্মন্তুদ উক্তির মধ্য দিয়ে যে সত্যটি বেরিয়ে আসে, তা চরম দায়িত্বহীনতার প্রকাশ।

সোমবার রাতের ঘটনায় অনেকেই প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছেন। রাত ১০টার দিকে গ্যাসের গন্ধ পাচ্ছিলাম। ভাবলাম, রান্নাঘরে গ্যাসের চুলাটি সঠিকভাবে বন্ধ না করার ফলে গ্যাস বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছে কিনা। রান্নাঘরে ঢুকে চুলা পরীক্ষা করে দেখলাম, এতে কোনো সমস্যা নেই। পরিস্থিতি আসলে কী দাঁড়িয়েছে তা বোঝার জন্য আমি আমার ফ্ল্যাট থেকে অ্যাপার্টমেন্ট ভবনের গ্রাউন্ডে নেমে আসি। দেখলাম, সেখানেও গ্যাসের গন্ধ বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। খুবই চিন্তিত ও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লাম। অ্যাপার্টমেন্ট ভবনের বাসিন্দারা ওই সময় অনেকেই ঘুমিয়ে পড়েছেন। আমি পাহারাদারদের বললাম, ইন্টারকমে সব ফ্ল্যাটে জানিয়ে দেওয়া হোক, গ্যাসের চুলা জ্বালানো চলবে না। চুলা জ্বালালে ভয়ংকর দুর্যোগ ঘটে যেতে পারে। ফ্ল্যাটের একজন বাসিন্দা বাইরে থেকে এসে জানালেন, তিনি পথে গ্যাসের গন্ধ পেয়েছেন। তার বক্তব্য শোনার পর চিন্তান্বিত হয়ে পড়লাম -আসলে কোথায় গ্যাস লিক করছে? সমস্যাটির উৎস আমাদের অ্যাপর্টমেন্টে, নাকি অ্যাপার্টমেন্টবহিভর্‚ত অন্য কোনো জায়গায়। ৭০টি অ্যাপার্টমেন্টের বাসিন্দাদের সজাগ থাকতে অনুরোধ করার পর আরেকটি বুদ্ধি মাথায় এলো। টেলিভিশন খুলে বুঝতে চেষ্টা করলাম গ্যাস কি শুধু আমাদের অ্যাপার্টমেন্টে ছড়িয়ে পড়েছে, নাকি অন্য কোথাও একই অভিজ্ঞতা সবার। টিভির স্ক্রলে দেখা গেল গ্রিন রোড, ধানমন্ডি, আজিমপুর, ইস্কাটন, খিলগাঁও, মহাখালীসহ ঢাকা নগরীর বিভিন্ন স্থানের এলাকাবাসী গ্যাসের গন্ধ পাওয়ার বিষয়টি জানিয়েছেন। এতক্ষণে বুঝতে পারলাম, সমস্যাটি শুধু আমাদের অ্যাপার্টমেন্টের নয়, এর ব্যাপকতা ঢাকা নগরীর আরও অনেক এলাকায়। মসজিদের মাইকে অনেক এলাকায় জানান দেওয়া হয়েছে যে, গ্যাস পাইপলাইন থেকে বেরিয়ে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছে। এ অবস্থায় নিরাপদ থাকার জন্য ঢাকাবাসীদের গ্যাসের চুলা না জ্বালাতে অনুরোধ করা হয়েছে।

এমন পরিস্থিতি কী করে সৃষ্টি হলো? মনে হয়েছিল, ঢাকার বাসিন্দারা আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখে বসে আছে। যে কোনো মুহূর্তে অগ্ন্যুৎপাত ঘটতে পারে। তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ ঢাকাবাসীকে অনুরোধ করেছেন চুলা না জ্বালাতে। তারা আতঙ্কিত না হওয়ারও পরামর্শ দিয়েছেন। এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে তিতাস গ্যাস জানিয়েছে, ঈদে শিল্পকারখানায় গ্যাস সরবরাহ বন্ধ থাকায় সঞ্চালন ও বিতরণ লাইনে গ্যাসের চাপ বেড়ে যাওয়ায় (ওভারফ্লো) গ্যাসের গন্ধ বাইরে আসছে। তিতাসের জরুরি ও টেকনিক্যাল টিম বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে। মঙ্গলবার (২৫ এপ্রিল) সকালে তিতাসের জিএম (অপারেশন) সেলিম মিয়া দৈনিক ইত্তেফাককে বলেন -গ্যাস লিকেজ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়েছে। এখন গ্রাহকরা চুলা জ্বালাতে পারবেন। লাইনে যে সমস্যা হয়েছিল, তার সমাধান করা হয়েছে।

সমাধান তো তারা করেছেন, কিন্তু নগরবাসী যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে রাত পার করল, তাদের ক্ষতিপূরণ দেবে কে? শারীরিকভাবে আহত হওয়ার তুলনায় মানসিকভাবে আহত হওয়া আরও দুঃসহ। অধুনা সমাজজীবনে অনেক পরিবর্তন এসেছে। গত শতাব্দীর ষাটের দশকের আগে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের কোথাও গ্যাস সরবরাহ ছিল না। মানুষজন রান্না করত লাকড়ির চুলায়। লাকড়ির চুলায় রান্না করা খুবই কষ্টকর ছিল। লাকড়ি যদি সঠিকভাবে শুকনা না হয়, তাহলে সেই লাকড়ি জ্বালানো আরও কষ্টকর হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় রাঁধুনিদের বাঁশের চোঙায় ফুঁ দিয়ে আগুন জ্বালানোর কসরত করতে হতো। ধোঁয়ায় চোখ জ্বালা করত এবং চোখ দিয়ে পানি নির্গত হতো। পরবর্তীকালে দেশের বিভিন্ন স্থানে গ্যাস সরবরাহ শুরু হয়। এর ফলে গৃহিণী ও রাঁধুনিদের কষ্ট লাঘব হয়। রান্নার কাজটি সহজ হয়ে পড়ে। এটি বিজ্ঞানের দান। বিজ্ঞান আমাদের জীবনযাত্রাকে বিভিন্নভাবে মসৃণ ও আনন্দদায়ক করে তুলেছে। তবে এই আনন্দ হঠাৎ করে বিয়োগান্ত হয়ে পড়তে পারে। যেমনটি হয়েছিল সোমবার রাতে। ভেবে দেখুন গ্যাস ওভারফ্লো করার ফলে বাড়তি চাপের মুখে গ্যাস লাইনের কোনো একটি বিন্দুতে বিস্ফোরণ ঘটলে বিস্ফোরণের অগ্নি গ্যাস লাইনের মধ্য দিয়ে ঢাকার সর্বত্র ছড়িয়ে পড়তে পারত। আমি বিজ্ঞানীও নই, প্রকৌশলীও নই। সাদামাটা মানুষ হিসাবে আমি এ আতঙ্কটি অনুভব করেছি এবং আমার সঙ্গে শতসহস্র ঢাকাবাসীও আতঙ্কিত হয়েছেন। সেই রাতে অনেকেই ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে জানিয়েছেন, তাদের নিজ নিজ এলাকায় বাতাসে গ্যাসের গন্ধ পেয়েছেন। এসব স্ট্যাটাস থেকে বুঝতে পারলাম সমস্যার ব্যাপকতা বিশাল। যারা স্ট্যাটাস লিখেছেন, তারা জানতে চেয়েছেন এই বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় কী? আতঙ্কিত না হওয়ার জন্য অনুরোধ করা হলেও বেশিরভাগ মানুষ যে আতঙ্কিত হয়েছিলেন, সে ব্যাপারে সন্দেহ নেই।

প্রতিবছর ঈদের ছুটি হয়। ঈদের ছুটিতে অনেক লোকজন গ্রামের বাড়িতে ছুটে যান আপনজনদের সঙ্গে ঈদ আনন্দ উপভোগ করতে। এই ছুটির সময় অনেক কলকারখানা বন্ধ থাকে। যথাযথভাবে নিয়ন্ত্রণ না করলে অব্যবহƒত গ্যাস উপচে পড়ে এবং তার ফলে শুধু গন্ধ পাওয়া নয়, বড় ধরনের দুর্ঘটনাও ঘটতে পারে। সোমবার রাতে ঢাকাবাসীর যে অভিজ্ঞতা হয়েছে, সে রকম অভিজ্ঞতা ঈদের ছুটিতে অথবা অন্য কোনো ধরনের ছুটিতে হয়নি। তাহলে সোমবারের ঘটনা কী করে ঘটতে পারল? সোমবার রাতভর তিতাসের টেকনিক্যাল ও অপারেশন কর্মীরা ভোর হওয়া পর্যন্ত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য কাজ করেছেন। এ কাজটি ছুটি শুরু হওয়ার অব্যবহিত পর করা হলে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হতো না বলে আমার মনে হয়। যদি বলা হয়, তিতাস কর্তৃপক্ষের অবহেলা ও দায়িত্বহীনতার কারণেই এমন ঘটনা ঘটেছে, তা কি অস্বীকার করা যায়? যদি কোনো ধরনের বিস্ফোরণ ঘটত, তাহলে গ্যাসের আগুন গোটা শহরে ছড়িয়ে পড়ত কি? ধামাচাপা দেওয়া নয়, এসব প্রশ্নের সদুত্তর নাগরিকদের দাবি। সমস্যার মূলে রয়েছে সুশাসনের ঘাটতি।

ড. মাহবুব উ ল্লাহ : শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম